রাত বাজে তিনটা। আইযল শহরে ট্যাক্সি থেকে নেমে পড়লাম। ট্যাক্সিটা অবশ্য শেয়ারের ছিল। ইম্ফল শহর থেকে নিয়ে এসেছে আমাকে। পূর্ব ভারতের সাত রাজ্যের মধ্যে এরকম শেয়ার ট্যাক্সি চলে হামেশাই। তবে পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথের কারণে আসতে সময় লেগেছে প্রায় চৌদ্দ ঘণ্টা। আর আমার হাড়গোড়েরও চৌদ্দটা বেজে গিয়েছে। ইম্ফল থেকে বেরিয়েছি সকাল সাতটায়। তাও অনেক কান্ড করে। হোটেলে বলা ছিল যে আমাকে হোটেল থেকে যেন তুলে নেয়। এই রাজ্যের মানুষজন এতোই নরম স্বভাবের যে হোটেল থেকে ডেকে দিয়েছিল ঠিকই কিন্তু আমার দশ মিনিট নামতে দেরি হলো আর ট্যাক্সি আমায় ফেলে চলে গেল। আমি রিসিপশনের ছেলেটিকে দিলাম বকা- তুমি আমাকে জোর দিয়ে বলোনি কেন যে আমায় ফেলে চলে যাচ্ছে। সে বলে কিনা আমি অতিথি, আমার সঙ্গে জোর গলায় কথা বলা যায় না। তাই বলে ট্যাক্সি মিস করিয়ে দেবে!
ওরাই আবার আমাকে মূল ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে পাঠিয়ে দিলো পরের ট্যাক্সি ধরার জন্য। পূর্ব ভারতের সাত রাজ্যের প্রায় সব জায়গায়ই আমি এমন রাজকীয় অভ্যর্থনা আর আতিথেয়তা পেয়েছি।
এখানে ট্যাক্সি বলতে যা বোঝায় তা আদতে আমাদের দেশের মিনিবাস। আরামসে নয় দশজন এঁটে যায়। আমি সেই বাহনে চালকের পাশের সিট দখল করলাম। বর্ষার মৌসুম এখনো কড়া নাড়েনি তাই পথের ধুলা কয়েক পরত আবরণ তৈরি করে যাচ্ছে শরীরে।
সেই সকাল সাতটায় রওনা দিয়ে আইযল শহরে পৌঁছালাম রাত তিনটায়। মাঝখানে অবশ্য দুপুরের খাবারের বিরতি নেয়া হয়েছিল পাহাড়ের এক খাঁজের মাঝে ছোট এক রেস্তোরাঁয়। শাকাহারী ভোজন ও আমিষাশী ভোজনের জন্য পাশাপাশি দুটো আলাদা ছোট কাঠের তৈরি রেস্তোরাঁ। রেস্তোরাঁয় শ্রীবৃদ্ধি করার কোন চেষ্টাই নেই। কারণ পথিকের যাবার আর কোনো জায়গাও নেই। খিদে নিয়ে চালক যেমন গাড়ি চালাবে না তেমনি আমরাও নিশ্চুপ থাকব না।
আমি চুপচাপ শাকাহারী ভোজনালয়ে গিয়ে বসে পড়লাম। মনিপুরী বা মিজো খাবার নয়, এরা এসব রেস্তোরাঁয় সাধারণত পরিবেশন করে ডাল, ভাত, সবজি। তাই সই। বহুবছর দক্ষিণ ভারতে বসবাস করে আমি শাকাহারী ভোজনে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি। খেয়ে আবার পথ চলা। সন্ধ্যের পর মিজোরাম রাজ্যের প্রবেশ মুখে আমরা যারা বাইরের রাজ্য থেকে এসেছি তাদের ইনার লাইন পারমিট দেখল। আমারটা দেখল না। এরা বোধহয় ভেবেই বসে আছে আমি স্থানীয়।
একে তো সারাদিনের ভ্রমণের ধকল, তার উপর আবার আমি ভ্রমণ শুরু করেছি প্রায় এক মাস আগে। তাই ক্লান্তিতে চোখ বুজে এসেছিল। এর মাঝে নিদ্রাদেবীকে নাখোশ করে পৌঁছে গেলাম আইযল, আমার বহু বছরের স্বপ্নের শহর! আগে তো ট্যুরিস্ট আসতেই দিত না। এখন একটু একটু করে দিচ্ছে।
রাত তিনটা হলেও অন্যান্য যাত্রীদের যাবার যায়গা ছিল। এ যাত্রায় আমি একেবারেই ভবঘুরের মতো ভ্রমণে নত আছি। যেখানে রাত সেখানে কাত। কিন্তু এই মাঝরাতে দু’একজন স্থানীয় ট্যাক্সিচালক আর পথের সারমেয় ছাড়া আর তো কেউ নেই শুনশান শহরে। হোটেল খুঁজব কোথায়? সামনে দেখি একজন লম্বা মতোন, কাঁধ ছাপানো চুলের ব্যক্তি লম্বা লম্বা পা ফেলে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। দুষ্ট লোক নয় তো? পরক্ষণেই মনে হলো, ভারতের সবচেয়ে নিরাপদ রাজ্যগুলোর একটিতে আমি, আমার কোনো ভয় নেই। লোকটির নাম ফ্রান্সিস, পেশায় ট্যাক্সিচালক। আমাকে সামনের একটা হোটেল দেখিয়ে দিলো আর বলল পরে ঘুরে বেড়াতে যদি ট্যাক্সির প্রয়োজন পড়ে তাহলে তাকে যেন ডাক দেই, মোবাইল নম্বরও দিলো।
হোটেলে রুম বুঝে নিয়ে দিলাম এক ঘুম। যদিও এখন গরমকাল শুরু হইহই করছে তবুও এ পাহাড়ি অঞ্চলে রাতে বেশ ঠান্ডা পড়ে। সকালে কম্বলের নিচ থেকে উঠতেই ইচ্ছে করছিল না। হোটেল থেকে বেরিয়ে কাছেই স্থানীয় একটি রেস্তোরাঁ খুঁজে পেলাম। রাতে পথ-ঘাট কিছুই দেখা হয়নি। এ শহরটা দেখতে মফস্বল শহরের মতো। সরু পাহাড়ি পথ, উঁচু-নিচু হয়ে সামনে পেছনে চলছে গাড়ি, মোটরসাইকেল। আশেপাশে উঁচু ভবন নেই। ছোট ছোট দোকান সারি সারি। শহরের মূল সড়ক এটি। ট্রাফিক লাইট নেই কোথাও। তবে অত্র এলাকার একমাত্র ট্রাফিক পুলিশকে দেখলাম রাস্তার মাঝখানের ছোট গোলাকার ট্রাফিক ছাউনির নিচে দাঁড়িয়ে আছে। জীবন এখানে সরল ও সুন্দর।
পাহাড়ি পথ তাই খানিক হাঁটলেই হাঁপ ধরে যায়। অল্প কিছুক্ষণ ঘুরে ফিরে একটা খুবই ছোট রেস্তোরাঁ খুঁজে পেলাম একজনের বাড়ি লাগোয়া। বাণিজ্যিক রেস্তোরাঁর মতো নয় খুব সম্ভবত বাড়িতেই রান্না হয় আর বাইরের ছোট দোকানে পরিবেশন করা হয়। রেস্তোরাঁটি ছিমছাম, পরিচ্ছন্ন। চারিদিকে মেয়েলি ভাব স্পষ্ট। কোন নারী যে রেস্তোরাঁ চালান বোঝাই যাচ্ছে। ছোট ক্যাশ কাউন্টারে একজন বছর ত্রিশের নারী আরাম করে পা গুটিয়ে চেয়ারে বসে গান শুনছেন। ঘরজুড়ে দৌড়ে বেড়াচ্ছে দু’আড়াই বছর বয়সী একটি শিশু। আমি মিজোরাম রাজ্যের বিখ্যাত ব্রেকফাস্ট অর্ডার করেছি। ওয়েটার মেয়েটি অর্ডার নিয়ে, খাবার পরিবেশন করে শিশুটির সাথে খেলা শুরু করে দিলো। এ যেন বাড়ির পরিবেশ। নিজের বাড়িতে বসে নাস্তা করার মতো আমি আরাম করে স্যুপের বাটিতে চামচ ডুবিয়ে খাচ্ছি। ভুট্টা আর গরুর মাংস সেদ্ধ করে স্যুপ করা হয়েছে, নাম বাই। এত হালকা আর উপাদেয় যে এই নতুন খাবারের স্বাদ আরও পেতে ইচ্ছে করল। পরের ডিশ আরও সুস্বাদু খেতে, চালের গুঁড়োর স্যুপ উপরে পেঁয়াজের বেরেস্তা ছড়ানো। এর নাম সানপিয়াও। এরকম খাবার পেলে আমি সারাজীবন এখানে থেকে যেতে পারি।
নাস্তা খেয়ে রেস্তোরাঁ থেকে বের হয়ে ভাবলাম শহর প্রদক্ষিণ করি হেঁটে হেঁটে। আজ সারাদিন হন্টন দিবস। ভারতের এই এক কোণার রাজ্যে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগেনি বলে ভালো লাগছে। আমি পুরাতন ধারার মানুষ। আধুনিক বেশি কিছু আমায় টানে না। মূল শহরের রাস্তাও সরল। কোনো প্যাঁচ নেই। সোজা উপরে উঠে গিয়েছে, নয় নিচে। অটোরিকশা বা রিকশা পাহাড়ি এলাকায় চলতে দেখিনি। শুধু গাড়ি, বাস, মোটরসাইকেল চলে। হেঁটে হেঁটেই শহরের মিউজিয়ামে চলে এলাম। মিউওজিয়াম মেরামতের কাজ চলছে। বাইরের গেট রঙ করার দায়িত্বে আছেন দু'জন অতি সুন্দরী নারী। টি শার্ট আর লুঙ্গি পরে ছাতা মাথায় দিয়ে একমনে গেট রঙ করে যাচ্ছেন। বয়স ২০-২২ হবে। এঁরা এমনভাবে কাজ করছেন যে দেখে মনে হচ্ছে নিজের বাড়ির গেট রঙ করছেন। খুব উপভোগ করছেন কাজটি। নিজেদের মধ্যে কথা বলছে, হাসাহাসি করছে। কাজে বিরক্তি নেই। এত শান্তিময় পরিবেশ!
তিনতলা জুড়ে মিউজিয়ামের কোথাও কোন গার্ড বা দ্বাররক্ষী নেই। তার মানে কিছু চুরিও যায় না। এমনিতেই উত্তর পূর্ব ভারতের এই সাত বোনেদের রাজ্য নিরাপদ বলেই জানি। মিজোরাম আসার আগে সাত বোনের পাঁচজনকে দেখা হয়ে গিয়েছে। মিজোরাম ষষ্ঠ। এরপর যাত্রা শেষ করব ত্রিপুরা দিয়ে।
মিউজিয়ামে মিজোরাম রাজ্যের ইতিহাস, ঐতিহ্য, মানুষের জীবন যাপনের অতীত বর্তমান তুলে ধরা হয়েছে। প্রাচীন আসবাব, তৈজসপত্র, পোশাক, গহনাও রাখা আছে। বন্য পশুপাখি, বনজ সম্পদ ও গাছগাছালির নমুনাও আছে বিস্তারিত। আত্মরক্ষা ও দেশরক্ষার জন্য আদিম যুগ থেকে যা যা ব্যবহার করা হত সেসব হাতিয়ার সাজানো আছে শোকেসে।
মিজো জনগোষ্ঠীর আবির্ভাব হয়েছিল ছোট একটি আদিবাসী সমাজ থেকে। সেই ছোট গোষ্ঠী এখন মিজোরাম রাজ্যের বাসিন্দা। জনসংখ্যার দিক থেকে ভারতে সিক্কিমের পর মিজোরামেই সবচেয়ে কম জনবসতি রয়েছে। রাজ্যের ৯১ শতাংশ জুড়ে রয়েছে বনভূমি। এ অঞ্চলের মানুষজন যে শান্তিপ্রিয়, সমানাধিকারে বিশ্বাস করে তা কয়েক ঘণ্টা আগে এসেই বুঝে গিয়েছি। মিজোরাম রাজ্যকে বলা হয় ল্যান্ড লকড বা ভূমি অবরুদ্ধ রাজ্য। সমুদ্র নেই, নেই প্রবাহমান নদী। চারপাশে ভারতের আসাম, মনিপুর ও ত্রিপুরা রাজ্য। সীমান্তের একটা অংশ জুড়ে রয়েছে বাংলাদেশ আর মিয়ানমার।
মিজোরামের নারীপুরুষ সাধারণত শার্ট প্যান্ট পরেন। তবে নারী-পুরুষের ঐতিহ্যবাহী পোশাকও একই , লুঙ্গি বা পোয়ান আর উর্ধাঙ্গে ঢোলা কোমর সমান ফুল হাতা শার্ট। মিউজিয়ামে আমি ছাড়া এখন ৪-৫ জন স্থানীয় ছেলেমেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এদের চলাফেরা ভীষণ সাবলীল। কিছু জিজ্ঞেস করলে হেসে জবাব দিচ্ছে।
মিউজিয়াম ঘুরে ফিরে দেখে বের হলাম শহরের আরেক প্রান্তে সলোমন গীর্জা দেখার উদ্দেশ্যে। ভাবলাম বাসে চড়ে যাই। বাস স্ট্যান্ড কাছেই। বাসের জন্য অপেক্ষা করছি আর আশপাশের মানুষজন দেখছি। সবাই সুশৃঙ্খল, কারো মুখে বিরক্তি নেই, এক শান্তির পরশ চোখেমুখে বুলিয়ে এরা পথ চলছে। পাশেই একজন নারী টি শার্ট আর ট্রাউজার পরে বক্সে ভরে আইসক্রিম বিক্রি করছেন, পথে বসেই। অবশ্য আইসক্রিম বিক্রির চেয়ে তার মনোযোগ বেশি হাতে উলের সোয়েটার বোনায়। বাস চড়ার পর দেখি যাত্রী খুব বেশি নয়। অথচ আমাদের দেশে এই অফিসের সময়ে থাকে উপচে পড়া ভিড়।
সকাল থেকে নতুন জায়গায় মানুষজন আর তাদের আচার ব্যবহার দেখতে দেখতে মনেই ছিল না যে কাছে দূরে যেখানেই থাকি পাহাড় আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। বাস শহরের মধ্যে দিয়েই যাচ্ছে কিন্তু ফাঁকে ফাঁকে ঠিকই দেবতা দর্শনের মতো পাহাড়কে দেখিয়ে দিচ্ছে। উঁচু-নিচু মেঘের ছায়ায় ঘন সবুজ পাহাড় যেন দোল খাচ্ছে আকাশের গায়ে। আজ আকাশ পরিষ্কার। যেন পাহাড়ের দোলনা হবার জন্যই নেমে এসেছে ধরনীতে। এরকম আকাশ পাহাড় দেখলে আমার পাহাড়ের গায়ে মিশে যেতে ইচ্ছে করে। পাহাড়ের কী আনন্দ! দোল খায়, হাওয়ার সাথে পাল্লা দিয়ে গলা ছেড়ে গান গান, ঘুমায়, জাগে, হাসে। আর বুকের মাঝে ধরে রাখে কিছু সহজ সরল জীবন যাপন। কিছুদিন পাহাড়ের সাথে থাকলে, জনাকীর্ণ শহরের ফাঁদ থেকে মুক্ত হলে মানুষের মন হয় পাখির মতো, হালকা, উড়ন্ত আবার দিন শেষে নিজ ঘরে ফেরা। বাহ্যিক চাকচিক্য নেই, নেই কোনো কিছু শো অফের বালাই।
পাহাড় দেখতে দেখতে যখন আমি বিভোর তখন বাস চালক আমাকে সলোমন গীর্জার সামনে নামিয়ে দিলেন। এক জনহীন পাহাড়ের উপর একা দাঁড়িয়ে আছে সলোমন গীর্জা। ভারত ভ্রমণে যে রাজ্যেই গিয়েছি মানুষের অভাব হয়নি। এই উত্তর পূর্বের কয়েকটি রাজ্য দেখে মনে হলো যে রাজ্যগুলো শুধু প্রকৃতি মাতার নিমিত্তে বসবাস করে। আধুনিক মানুষের চিহ্ন দিয়ে বিরক্ত করতে শেখেনি কেউ। শুধুই প্রকৃতির রাজ।
সাধারণ গীর্জার মতো দেখতে সলোমন গীর্জা। স্থানীয় একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি জনসাধারণের প্রার্থনার জন্য নির্মাণ করেছিলেন এই গীর্জা। মিজোরাম খ্রিষ্টান জনবহুল রাজ্য। তবে সকাল থেকে ঘোরাঘুরি করে ভারত উপমহাদেশের অন্যান্য মানুষজনের মতো নিজের ধর্ম নিয়ে মেতে থাকতে কাউকেই দেখলাম না। কোনো অফিস বা বাড়ির সামনে ধর্মীয় চিহ্ন রাখা বা আঁকা নেই যাতে বোঝা যায় কোন বাড়ি কোন ধর্মাবলম্বী মানুষের। এখানকার মানুষ তো প্রকৃতির মতো অকপট, সরল। প্রকৃতি আর মানুষ যেন অবিচ্ছেদ্য।
গীর্জা মাঝারি আকারের ত্রিভুজাকৃতির, সাদা রঙ করা। তবে এমন ভুতুড়ে গীর্জা আমি কোনো দেশে, কোনো রাজ্যে দেখিনি। বিশাল এলাকাজুড়ে একটা মানুষও নেই। এই রাজ্যে কী সত্যিই মানুষ থাকে না ভূত! আশেপাশের কয়েক মাইল অবধি বোধহয় কেউ নেই। গীর্জার সামনে পাহাড় ঢালু হয়ে নিচে নেমে গিয়েছে। উঠোনে বেগুনি, গোলাপি পিটুনিয়া, ক্রিসেন্থিমাম ফুলের বাগান। প্রার্থনার সময় নিশ্চয়ই লোকজন আসে অথবা কেউ তো নিশ্চয়ই এসে বাগান করে যায়। আজ রোববার নয় তাই প্রার্থনার জন্য কেউ নেই, উপরন্তু গীর্জার সদর দরজা বন্ধ। গীর্জার চারিদিকে একবার চক্কর দিয়ে সামনে পাহাড়ের ঢালুতে গিয়ে বসে বসে পাহাড়ের কাছে অভিযোগ করা ছাড়া উপায় নেই। ফেরার বাস আসবে আরও এক ঘণ্টা পর।
বাস সময় মতোই এলো। আমিও ফিরে গেলাম মূল শহরে। আজ এটুকু ঘুরে বেড়াতেই বেলা পড়ে এলে। শহরে ফিরে মনে হলো দুপুরে কিছু খাওয়া হয়নি। রেস্তোরাঁও খুঁজে পেলাম। রেস্তোরাঁর মালিক, সেবক সবাই নারী। ওয়েটার মেয়েটিকে দেখে রীতিমতো হতভম্ব হয়ে গেলাম। বোম্বে শহরে এই মেয়েকে টপ মডেল বলে চালিয়ে দেয়া যাবে। যেমন রূপ তেমনি স্টাইলিশ, তেমন তার আচরণ। এই মেয়ে কিনা মিজোরামের এক রেস্তোরাঁর ওয়েটার, ঘোর অন্যায়!
এ রেস্তোরাঁয় স্থানীয় খাবার ছিল না। যা ছিল তাই খেতে খেতে রেস্তোরাঁ মালিকের সাথে আড্ডা দিলাম। নাম তার মামি। এ শহরে স্থানীয় রেস্তোরাঁ কম হবার কারণে মামি আগামীকাল রাতে আমাকে তার বাড়িতে নিমন্ত্রণ করল স্থানীয় খাবারের।
পরদিন আমি যাব ডার্টল্যাং পাহাড়ে। এখানে চারপাশেই পাহাড় তবুও শহরের বাড়িঘরের মাঝে পাহাড়কে ঠিক সেভাবে প্রাণভরে দেখা যায় না। ডার্টল্যাং যেতে হবে ট্যাক্সি করে। ফ্রান্সিসকে ফোন করলাম। সে অন্য যাত্রীদের বেড়াতে নিয়ে গিয়েছে। তাই ট্যক্সি স্ট্যান্ডেই আরেকটি ট্যাক্সি দেখে দরদাম করে ট্যাক্সিতে উঠে বসলাম। ট্যাক্সিচালক ছেলেটির নাম লুওয়াং। দেখে মনে হচ্ছিল ১৬ বছর পার হয়েছে কিনা সন্দেহ। আমি সরাসরি তার ড্রাইভিং লাইসেন্স চেয়ে বসলাম। লাইসেন্স অনুযায়ী তার বয়স দেখাচ্ছে ২১ বছর। এই ছেলে নাকি এর মধ্যে বিয়েও করে ফেলেছে। লুওয়াংকে গুরুজন ভেবে নানা ফ্রি উপদেশ দিতে দিতে দেখি ডার্টল্যাং এসে গিয়েছি। আমি লুওয়াংকে ছাড়িনি, যতক্ষণ পাহাড়ে আমি ঘুরে বেড়াব, সে অপেক্ষা করবে। ডার্টল্যাং এর অপরপাশে দেখা যায় আইযল শহর, শহরে পাহাড়ের সবুজ ঢালে ছোট ছোট বাড়িঘর।
স্থানীয় গাছগাছালির মাঝে এক রাশি নিঃসঙ্গ পাহাড় এলোমেলো হতে চাইছে। যতদূর চোখ যায়, সবুজের সমারোহে ঝুলন্ত আকাশ ভেঙে পড়তে চায় পাহাড়ের গায়ে। মেঘ কিছু কিছু জায়গায় ছুঁয়ে ছুঁয়ে আবার হারিয়ে যায়। একেক সময় একেক রূপ তার। তবে কেউ স্থায়ী নয়। একমাত্র পাহাড়ের সারি সারি সবুজের বিন্যস্ত এবং অবিন্যস্ত বৃক্ষরাজিই আটকে আছে পাহাড়ের গায়ে, হেলেদুলে বলে যাচ্ছে পাহাড়ের সাথে কথা।
এই পাহাড়ে বোধহয় কেউ ট্রেকিং করতে আসে না। প্রায় তিন ঘণ্টা পাহাড়ের অলিগলিতে ঘুরেফিরে একটা মানুষের দেখা পেলাম না।
লুওয়াংকে কয়েক ঘণ্টা পর কল করতেই কোথাকার কোন পাহাড় ফুঁড়ে গাড়ি নিয়ে একেবারে ডার্টল্যাং এর পার্কিং এ এসে হাজির। এত নিষ্ঠার সাথে কাজ করতে ভারতের খুব কম রাজ্যে দেখেছি। পথে গাড়িঘোড়া খুবই কম দেখতে পেলাম। জনসংখ্যা যেমন কম তেমনি গাড়ির সংখ্যাও কম। লুওয়াং আমাকে ডাউনটাউনে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল। আমি এখানকার বাজারে ঘুরতে থাকলাম। স্থানীয় ফল বলতে কমলা আর প্রচুর তাজা শাকসবজি। পোশাক, জুতা, ব্যাগ, খেলনা সবই চীনের তৈরি। ভারতীয় জিনিসপত্র হয়তোবা আছে তবে কম। বহু বছর ধরে ভারতের এই সেভেন সিস্টারস মূল ভূখণ্ড থেকে আলাদা হয়ে যাবার জন্য আন্দোলন করছে কিন্তু তেমন লাভ হচ্ছে না। এদিকে সরকারি সহায়তা নাকি একেবারেই আসে না৷
বাজারে ঘুরতে ঘুরতে বিকেল হয়ে এলো। আমার মামির বাড়িতে দাওয়াত আছে। বাড়ির ঠিকানা দিয়ে দিয়েছে, রেস্তোরাঁর কাছেই। সাধারণ একতলা বাড়ি মামির। ফুল বাগানের উঠোন পেরিয়ে মূল বাড়ির দরজা এবং দরজা খোলাই। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কার নাম ধরে যে ডাকি ভাবতে ভাবতে মামি চলে এল। এ বাড়িতে তার স্বামী এবং দুই কন্যাও থাকে। আমি ভেবেছি মামি সিঙ্গেল। মামি বা অন্য যে কোনো মিজো নারীর মতো আত্মবিশ্বাস, স্বয়ংসম্পূর্ণতা আমি উত্তর বা দক্ষিণ ভারতের কোনো নারীর মধ্যে দেখিনি।
মামির স্বামীটির আলাদা ব্যবসা আছে, মামির আলাদা ব্যবসা, কেউ কারো ব্যবসায় নাক গলায় না। মিজোরামে একসময় মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা ছিল কিন্তু এখনো সেই ব্যবস্থাই বজায় আছে মনে হচ্ছে। গল্প হলো অনেক এবং যে কারণে আমি মামির বাড়ি এসেছি তা সম্পন্ন করতে দেয়া হলো আমাকে। খাবার টেবিলে ভাতের সাথে ছোট ছোট বাটিতে নানা পদের সবজি সেদ্ধ। মিজোরামের জনগণের প্রধান খাবার ভাত, সাথে সবজি সেদ্ধ। আমি হঠাৎ বোকার মতো প্রশ্ন করে ফেললাম, ‘তোমরা কুকুরের মাংসের আচার খাও না?' আমার কথা শুনে মামি একচোট হেসে নিলো। আমার কি দোষ, ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় আমার কয়েকজন মিজো সহপাঠী ছিল। ওরা একদিন লাঞ্চের সময় বয়াম ভরতি কুকুরের মাংসের আচার এনেছিল। ভালোবেসে খেতে সেধেও ছিল।
মামির বাড়িতে এই মুহূর্তে কুকুরের মাংসের আচার নেই। কারণ সে আচার তারা খায় না। মিজোরামের কেউ কেউ অবশ্য খায়।
আমাকে এদের স্পেশাল গ্রিল করা হাঁসের মাংস বা স্থানীয় ভাষায় আরসা বুচিয়ার খেতে দেয়া হলো। আমাদের দেশে যেমন উৎসবে বা নেমন্তন্নে পোলাউ কোরমা খাওয়ানোর চল আছে এখানে খাওয়ানো হয় ভাতের সাথে আরসা বুচিয়ার অথবা ভোকসা র্যাপ। এটিও মাংসের একটি বারবিকিউ করা খাবার। সাথে থাকে সবজি সেদ্ধ, স্যুপ ইত্যাদি। আমি ভাতের সাথে প্রথমে ব্যাম্বু শুট সেদ্ধ দিয়ে খাওয়া শুরু করলাম। ব্যাম্বু শুট এদের অতি প্রিয় সবজি। খেতে গিয়ে দেখি শুধু সেদ্ধ নয় এই পদে অনেক অর্গানিক মসলা মিশিয়ে সেদ্ধ করা হয়েছে বলে বেশ উপাদেয়, স্যুপ হিসেবেও খাওয়া যায়। আরও অনেক ছোট ছোট বাটিতে ছিল লাউ সেদ্ধ, বরবটি সেদ্ধ বা স্যুপ, গাজরের তারকারি। সবার বাড়িতেই ছোটখাটো মসলার বাগান আছে। নিজেদের প্রয়োজনের ভেষজপাতা বা ডাল নিজ বাগান থেকেই পাওয়া যায়।
আস্ত হাঁসের পেটের ভেতরে স্থানীয় বিভিন্ন মসলা ভরে তারপর কাঠ কয়লায় গ্রিল করা হয়েছে এই আরসা বুচিয়ার। সে কারণে মাংসে এক ধরনের স্মোকি বা ধোঁয়াটে ফ্লেভার আসছে। সঙ্গে আছে আমাদের মতো শহুরে লোকদের কাছে অজানা বনজ নানা মসলার স্বাদ এবং ঘ্রাণ। এমন সুস্বাদু গ্রিলড ডাক আমি কখনোই খাইনি। খাবার শেষে মিষ্টি হিসেবে এলো পিঠা। এরাও পিঠাকে পিঠাই বলে। চাল, গুড় দিয়ে কলাপাতায় মুড়িয়ে ভাপানো পিঠা।
গল্পগুজব করে, খেয়েদেয়ে আমি বিদায় নিলাম মামির বাড়ি থেকে। এমন খাবারের স্বাদ নিয়ে চললাম যা মুখে লেগে থাকবে আরও কয়েকদিন।