পরিবেশ বিপর্যয়, নির্বিচারে বন উজাড়, নাব্যতা সংকট ও অনাবৃষ্টির কারণে বিপর্যয়ের মুখে পড়তে যাচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম কৃত্রিম হ্রদ রাঙামাটির ‘কাপ্তাই হ্রদ’।
পার্বত্য রাঙামাটির দুর্গম উপজেলাগুলোর সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ করতে, অর্থনীতিতে গতি ফেরানো, মৎস্য সম্পদ আহরণ-বাজারজাতকরণ এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কৃত্রিমভাবে বৃহত্তম এই কাপ্তাই হ্রদ সৃষ্টি করা হলেও গত কয়েক বছরে গ্রীস্ম মৌসুমে স্থানীয় বাসিন্দাদের জন্য এটি দুঃখ আর দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গ্রীস্মে পানি স্বল্পতায় ৬টি নৌরুট বন্ধ, মাছ আহরণ বন্ধ, পণ্য আনতে দুর্গতি এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার দুর্ভোগে অতিষ্ট হয়ে উঠেছে জনজীবন। থমকে আছে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর স্বাভাবিক জীবনযাত্রা।
১৯৬০ সালে ৭২৫ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে সৃষ্টি কাপ্তাই হ্রদের এখন বয়স প্রায় ৬২ বছর। বয়সের ভারে নাব্য সংকটে পড়া কাপ্তাই হ্রদের ড্রেজিং নিয়ে শুধু কথার পিঠে কথা হয়েছে, কাজ শুরু করা যায়নি আজ পর্যন্ত। এই ৬২ বছরে বর্জ্য ও উজান হতে নেমে আসা পলিতে কাপ্তাই হ্রদের তলদেশ ভরাট হতে হতে প্রতি বছরই পুরনো চরগুলোর সাথে যোগ হচ্ছে নতুন নতুন চর। সংকুচিত হয়ে আসছে প্রতিটি নৌরুট। যার ফলে, চলতি বছর গ্রীস্ম মৌসুমে বাঘাইছড়ি, বরকল, লংগদু, নানিয়ারচর, জুরাছড়ি ও বিলাইছড়ি উপজেলার সাথে সংযুক্ত ৬টি নৌরুটে সম্পূর্ণরুপে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় লাখ লাখ বাসিন্দার দুর্ভোগ-দুর্দশা চরমে উঠেছে। দুর্বিষহ হয়ে পড়ে জীবনযাপন।
সংযুক্ত উপজেলার প্রশাসনিক কার্যক্রমে স্থবিরতা বিরাজ করছে। পাহাড়ি উৎপাদিত পণ্য, ব্যবসার মালামাল বহনে বেগ হতে হচ্ছে। যাত্রীবাহী লঞ্চ কিংবা বড় বড় নৌযান চলাচলে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ছোট ছোট নৌযান একমাত্র ভরসা। তারপরও ভেসে উঠা চর কিংবা টিলায় ছোট নৌযান আটকে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে যাতায়াতকারীদের।
অন্যদিকে, প্রতি গ্রীষ্মে কাপ্তাই হ্রদে পানি স্বল্পতার কারণে তিন মাস মাছ আহরণ ও বাজারজাত বন্ধ থাকায় এ খাতের সাথে জড়িত প্রায় ২৩ হাজার পরিবারে নেমে আসে দুর্ভোগ। জেলে পরিবারগুলোতে বিরাজ করছে অভাব-অনটন।
জানা গেছে, উপজেলাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে বাঘাইছড়ি, লংগদু, বরকল, বিলাইছড়ি ও জুরাছড়ি উপজেলার বাসিন্দাদের। এ উপজেলাগুলোর নৌরুটে পানি কমে যাওয়ার কারণে ঘণ্টার পর ঘণ্টা হেঁটে গন্তব্যে পৌঁছাতে হচ্ছে তাদের। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় ব্যবসা-বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে সেখানকার হাটবাজারগুলোতে। জিনিসপত্রের দাম বাড়ার কারণে জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে।
বরকল উপজেলার ব্যবসায়ী মো. জাহাঙ্গীর বলেন, পণ্য পরিবহনে ব্যয় বেড়েছে। তাছাড়া যাতায়াত কঠিন হয়ে পড়েছে। শ্রমিকদের মজুরি বেড়েছে। স্বাভাবিকভাবে এর প্রভাব পড়েছে নিত্যপণ্যের ওপর।
কাপ্তাই উপজেলার সংস্কৃতিকর্মী ঝুলন দত্ত বলেন, প্রতি সপ্তাহে আমাকে বিলাইছড়ি যাতায়াত করতে হয়। হ্রদের পানি শুকিয়ে যাওয়ায় এখন বিলাইছড়ি যেতে সময় লাগে ২-৩ ঘণ্টা। এতে করে সময় এবং অর্থ দুইটাই বেশি যাচ্ছে।
দেখুন ভিডিও: ৬২ বছরেও ড্রেজিং হয়নি, হুমকির মুখে কাপ্তাই হ্রদ
রাঙামাটি নৌযান শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক বিশ্বজিৎ দে বলেন, এখনো পর্যন্ত কাপ্তাই হ্রদে লঞ্চ চলাচল বন্ধ রয়েছে। লঞ্চ চলাচল বন্ধ হওয়ার ফলে লঞ্চ শ্রমিক ইউনিয়নের কার্ডধারী ২৮২ জন শ্রমিক বর্তমানে পুরেপুরি বেকার হয়ে পড়েছেন। কাপ্তাই হদকেন্দ্রিক ৬ উপজেলায় ৪২টি লঞ্চ রয়েছে। লঞ্চ বন্ধ থাকার ফলে শ্রমিকরা এখন কষ্টে দিনযাপন করছেন।
বাংলাদেশ আভ্যন্তরীণ নৌ-চলাচল (যাত্রী পরিবহন) সংস্থা রাঙামাটি জোনের চেয়ারম্যান মঈন উদ্দিন সেলিম বলেন, কাপ্তাই হ্রদের পানি শুকিয়ে যাওয়ার ফলে বর্তমানে ৬টি উপজেলায় লঞ্চ চলাচল সম্পূর্ণরুপে বন্ধ আছে।
তিনি বলেন, এই নৌ-রুটের সবগুলো রুটে এখন নৌ চলাচল বন্ধ। কাপ্তাই হ্রদ ড্রেজিংয়ের বিষয়ে বিআইডাব্লিইউটি ও জেলা প্রশাসনের কাছে আবেদন জানিয়েছি, কিন্তু এখনও ড্রেজিং বিষয়ে কোন সংস্থা কার্যক্রম গ্রহণ করেনি।
রাঙামাটি জেলা প্রশাসক মো. মিজানুর রহমান বলেন, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে কাপ্তাই হ্রদ এর ড্রেজিং বিষয়ে একটা প্রকল্প গ্রহণের জন্য ডিপিপি প্রণয়নের কাজ চলছে। প্রকল্প অনুমোদিত হলে পরবর্তী কার্যক্রম শুরু হবে।
কাপ্তাই হ্রদ ব্যবস্থাপনা কমিটির সাবেক সদস্য মনিরুজ্জামান মহসিন রানা বলেন, ড্রেজিং না হওয়ার ফলে কাপ্তাই হ্রদের নাব্যতা হারাচ্ছে। যার ফলে প্রতি খরা মৌসুমে দুর্ভোগ পোহাতে হয়। কাপ্তাই হ্রদকে বাঁচাতে হলে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।