ফৌজিয়া বিথী, যিনি তার এলাকায় আপাদমস্তক মানবিক মানুষ হিসেবে পরিচিত! অসহায় মানুষের চিকিৎসা, গরিব পরিবারের ছেলে-মেয়েদের শিক্ষায় সহায়তা, বিধবা নারীদের পাশে দাঁড়ানো, বাল্যবিয়ে রোধ, কন্যাদায়গ্রস্ত বাবার পাশে দাঁড়ানো, নারী নির্যাতন বন্ধসহ সামাজিক কার্যক্রমের কারণে এলাকার সকলে তাকে মানবিক ম্যাডাম বলে চেনে।
ফৌজিয়া বিথী বগুড়ার ধুনট উপজেলার বেলকুচি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। তিনি মুক্তিযোদ্ধা ও অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মোজাম্মেল হকের মেয়ে এবং সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী রাজ্জাকুল কবিরের স্ত্রী। বেলকুচিতেই তার শ্বশুরবাড়ি। বাবার বাড়ি ওই উপজেলার চান্দারপাড়া গ্রামে।
অসহায় মানুষের বিপদে পাশে দাঁড়ানোর জার্নিটা তার শুরু হয়েছিল অনেক আগে। বাবার অনুপ্রেরণায়। দীর্ঘদিন নিভৃতে তার এলাকার বিপদগ্রস্ত অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়ালেও ২০২০ সালের করোনাকালীন তার সামাজিক কর্মকাণ্ডের কথা ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র।
করোনা মহামারির শুরু থেকে তিনি নিজ এলাকার সাধারণ মানুষদের সচেতন করতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে নিজের হাতে তৈরি করা কাপড়ের মাস্ক বিতরণ করেছেন। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছেন। লকডাউন চলাকালে খেটে খাওয়া মানুষদের রান্না করা খাবার বিলিয়েছেন। এখনও এলাকার মানুষের বিপদের খবর পেলেই ছুটে যান তার বাড়িতে। পরামর্শ, আর্থিক সহায়তা, সাহস যুগিয়ে অন্যের বিপদে পাশে দাঁড়ান। এমন সামাজিক এবং মানবিক কর্মকাণ্ডের জন্য ফৌজিয়া বিথী বেশ কিছু সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন।
আইপিডিসি অর্থায়নে আনসাং উইমেন ন্যাশন বিল্ডার্স অ্যাওয়ার্ড-২০২২ পেয়েছেন। প্রিয় শিক্ষক সম্মাননা ২০২২, রাজশাহী বিভাগীয় শ্রেষ্ঠ জয়িতা পুরস্কার ২০২২, ন্যাশনাল ডেভলপমেন্ট প্রোগ্রাম (এনডিপি) সম্মাননা ২০২৩, শ্রেষ্ঠ শিক্ষিকার সম্মাননা পেয়েছেন।
বেলকুচি এলাকার কৃষক জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘কোনো বিপদে পড়ে বীথি ম্যাডামকে ডাকলেই তিনি চলে আসেন। সাহায্য করেন। আমার বাচ্চার রক্তশূন্যতা দেখা দিয়েছিল। হাসপাতাল থেকে একটা সার্টিফিকেটের দরকার ছিল কিন্তু আমি সেটা উঠাতে পারছিলাম না। ম্যাডামকে বললে তিনি আমাকে সার্টিফিকেটটি তুলে দেন। পরে সেটি বগুড়ায় পাঠাই।’
ওই এলাকার আরজিনা বেগম বলেন, ‘আমি অনেক অসুস্থ ছিলাম। গলায় ভেতরে অনেক কিছু উঠেছিল। পরে বিথী আপার সঙ্গে বগুড়ায় হাসপাতালে যাই। সেখানে আমার টাকার সংকট দেখা দিলে বিথী আপা আমার জন্য তার টাকা খরচ করে চিকিৎসা করান। এ ছাড়া আমার মেয়েকে তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন নির্যাতন করতো। এমনকি একদিন আমার মেয়েকে এবং আমার স্বামীকে আমার জামাতা অনেক মারধর করে। বিষয়টি জানার পর বিথি আপা মেয়েকে উদ্ধার করে শেরপুর থেকে ধুনটে নিয়ে এসে চিকিৎসা করানোর ব্যবস্থা করান। চিকিৎসা চলাকালীন বিথী আপা তার বাড়ি থেকে ভাত রান্না করে আমার মেয়েকে খাইয়েছেন।’
ধুনটের মর্জিনা বেগম বলেন, ‘আমার স্বামী অসুস্থ। গরিব মানুষ। একদিন কাজ করতে গেলে আরেক দিন করতে পারে না। আমরা খুব অভাবের মধ্যে থাকি। আমার বাড়িঘর ছিল না। বিথী ম্যাডাম আমাকে ঘরের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। আমার ছেলে-মেয়ের পড়াশোনার খরচ দেন। ছেলে-মেয়ের ফরম ফিলাপের টাকা, খাতা কলমের টাকা ম্যাডাম দেন। তারা কি খেল, না খেল তার খোঁজ খবর নেন।’
ফৌজিয়া বিথী বলেন, ‘বাবা বলতেন নিজে বাঁচার নাম জীবন নয়, সবাইকে নিয়ে বাঁচাই জীবন। বাবার এই কথা সবসময় মনে ধারণ করে চলি। বাবার অনুপ্রেরণাতেই স্কুলের চাকরি পাওয়ার পর থেকে সমাজের অবহেলিত, নির্যাতিত, অসুস্থ মানুষকে নিয়ে কাজ করি। একজন বিপদগ্রস্ত ব্যক্তিকে সহযোগিতার পর যখন তিনি ভালো থাকেন, তখন সেই অবস্থা দেখে আমি মানসিকভাবে শান্তি পাই, তৃপ্তি পাই। এ সব কাজের মাঝেই আমি বেঁচে থাকার আনন্দ খুঁজি।’
এ সব কাজ করতে গিয়ে প্রতিবন্ধকতা এসেছে কি-না, আসলে কীভাবে সেটাকে পাশ কাটিয়েছেন জানতে চাইলে ফৌজিয়া বীথি বলেন, ‘অনেক ধরণের প্রতিবন্ধকতার শিকার হতে হয়েছে। যেমন আমার গ্রামের ৪ বছরের একটি শিশু ধর্ষণের শিকার হয় ৬৫ বছরের একজন বৃদ্ধের দ্বারা। যখন আমি মেয়েটিকে উদ্ধার করে নিয়ে আসি, তখন আমাকে রাজনৈতিকভাবে শক্তি প্রয়োগ করা হয়; যাতে আমি মেয়েটিকে নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছাতে না পারি এবং আমি যাতে থানায় নিয়ে যেতে না পারি। আমাকে অনেক ভয়ভীতি দেখানো হয়, এরপরও কিন্তু আমি মেয়েটাকে নিয়ে থানায় যাই, হাসপাতালে চিকিৎসা করাই এবং অভিযুক্তকে আইনের আওতায় নিয়ে আসার ব্যবস্থা করি। এছাড়া আমার গ্রামের আশপাশে মাদক কারবারিদের নিরাপদ আস্তানা। আমি অনেক মাদক কারবারিকে শিক্ষার্থীদের দিয়ে ধরিয়ে থানাতেও দিয়েছি। এ কারণে আমি অনেক মাদক কারবারির রোষানলে পড়েছি। তারা আমাকে ভয়ভীতি দেখিয়েছে।’
মানুষকে বিভিন্নভাবে সাহায্য সহযোগিতা করছেন, এতে টাকার দরকার। টাকার যোগান আসে কোত্থেকে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার বেতন থেকে মানুষের জন্য কাজ করার চেষ্টা করি। আমার মানুষের জন্য করার সাধ আছে। যখন দুস্থ অসহায় মানুষের জন্য কিছু করতে গিয়ে সাধ্যে কুলায় না, তখন খুব খারাপ লাগে। আমি যদি এসব কাজে সরকারি এবং বিত্তবান মানুষের সহযোগিতা পাই তবে আমার কাজগুলোকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি।’
বেশ কিছু সম্মাননা পুরস্কার পেয়েছেন, কেমন লাগছে জানতে চাইলে ফৌজিয়া বিথী বলেন, ‘পুরস্কার সব সময়ই ভালো লাগার। আর যে সম্মাননাগুলো পেয়েছি এগুলোর কারণে আমার কাজের স্পৃহা বেড়ে গেছে।’