আজ বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি ও মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৮তম শাহাদৎবার্ষিকী। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে সেনাবাহিনীর কয়েকজন বিপথগামী অফিসার ও সদস্য ধানমন্ডির বাসভবনে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করেন। এর মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতিতে সামরিক ক্ষমতার প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ ঘটে।
সেদিনের সেই নারকীয় হত্যাকাণ্ডের শিকার হন বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা, বঙ্গবন্ধুর ছেলে শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শিশুপুত্র শেখ রাসেল। মৃত্যুবরণ করেন বঙ্গবন্ধুর পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজি জামাল।
১৫ আগস্টের নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়ে প্রাণ হারাতে হয়েছে বঙ্গবন্ধুর ছোট ভাই শেখ নাসের, ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত এবং তার ছেলে আরিফ ও সুকান্ত, মেয়ে বেবি, বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক শেখ ফজলুল হক মণি, তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মনি এবং আবদুল নাঈম খান রিন্টু ও কর্নেল জামিলকে।
বাংলার অপামার জনসাধরণের নেতা বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের এই মৃত্যু বাঙালিকে বিশ্বের মানুষের কাছে নিন্দনীয় করে তোলে। অল্প কয়েকজন বিপথগামী সেনা অফিসার ও সদস্য দ্বারা পরিচালিত সেই হত্যাকাণ্ডের দায়ভার বাঙালি জাতিকে বহন করতে হয়।
এই কলঙ্ক বাঙালি কি দিয়ে মুছবে? অথচ এই বাঙালি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সংগ্রামের অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠেছিল। ১৯৭০ এর সাধারণ নির্বাচনে ফলফলের দিকে তাকালে দেখা যায়, সাধারণ নির্বাচনে জাতীয় পরিষদে পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯টি আসনের ১৬৭টি আসনেই আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে। সেই নির্বাচনের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের একক এবং আইনগত প্রতিনিধি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেষ মুজিবুর রহমান। কারণ তিনিই তখন পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা।
বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ ও অর্থপূর্ণ রাজনৈতিক জীবনে শক্তির উৎস ছিল এই বাঙালি জাতি। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর ডাকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল বাংলার অপামার জনগণ। দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালি অর্জন করে স্বাধীনতা।
স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতিতে ১৫ আগস্টের ঘটনা এক অপূরণীয় ক্ষতি হিসেবে চিহ্নিত। দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হওয়ার পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে এবং ১৯৯৬ সালের ২ অক্টোবর বঙ্গবন্ধুর একান্ত সহকারী এ এফ এম মোহিতুল ইসলাম পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট সংঘটিত নারকীয় হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় থানায় একটি এফআইআর করেন। এর মাধ্যমে আইনগতভাবে বাঙালির দায় মোচনের সূচনা ঘটে।
বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকায় ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর ঢাকার সে সময়কার জেলা ও দায়রা জজ ১৫জন সাবেক সেনা কর্মকর্তারকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন। এই রায়ের পর আপিলের রায়ে তিন জন খালাস পান এবং বাকি ১২ জনের মধ্যে একজন পলাতক থাকা অবস্থায় দেশের বাইরে মারা যান।
সবমিলিয়ে আট বার বিচার কার্য স্থগিত হওয়ার পরে অবশেষে ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি ৫ আসামির ফাঁসির রায় কার্যকর হয়। এরা হলেন-সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশীদ, মহিউদ্দিন আহমদ, এ কে বজলুল হুদা ও এ কে এম মহিউদ্দিনের ফাঁসি কার্যকর হয় ঢাকার কারাগারে৷ এর মাধ্যমে স্বাধীন দেশের বাঙালি জাতির দায় মুক্তি ঘটে।
বঙ্গবন্ধুর আরও একজন খুনি আবদুল মাজেদের ফাঁসি কার্যকর করা হয় ২০২০ সালের ১২ এপ্রিল। যদিও এখন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত পাঁচ খুনি বিভিন্ন দেশে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। কূটনৈতিক জটিলতার কারণে তাদেরকে দেশে ফেরানো আজও সম্ভব হয়নি। গ্রেফতার বা প্রত্যার্পণ ঠেকাতে এই খুনিরা বার বার নিজেদের অবস্থান বদলে কখনো যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান, লিবিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপে অবস্থান নিয়েছেন।
১৫ আগস্টের এই শোক দিবসে এটাই প্রত্যাশা যে, বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচারকাজ সম্পন্ন হোক। বাঙালি জাতি দায়মুক্তি পাক। একই সঙ্গে দেশের প্রশ্নে, দেশের অখণ্ডতা রক্ষার প্রশ্নে, সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রশ্নে বাঙালি যেন বিপদগামী না হয়, ১৫ আগস্টে এই হোক অঙ্গীকার।