ডেঙ্গু জ্বরের ইতিহাস অনেক পুরাতন। সুদূর চীনে এ অসুখের সবচেয়ে পুরোনো অস্তিত্ব পাওয়া গেলেও আঠারো শতাব্দীর দিকে অসুখটি পরিচিত হতে শুরু করে।
বর্তমানে সারা বিশ্বে প্রতি বছর ৫০-১০০ মিলিয়ন নতুন ডেঙ্গু রোগী আক্রান্ত হন, যার মধ্যে ২০ থেকে ২৫ হাজার মৃত্যু হয়ে থাকে। বাংলাদেশে চলতি বছরের প্রথম ৮ মাসেই হাসপাতালে ভর্তি ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ১ লাখ ছাড়িয়ে গেছে, মৃত্যু হয়েছে ৫১৪ জনের। এ সংখ্যা সামনে আরো বাড়বে, এটাই সবাই আশঙ্কা করছেন।
ডেঙ্গু জ্বরের সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই, বেশিরভাগ রোগী বাসায় চিকিৎসা নিয়েই সেরে উঠেন। কিন্তু এ অসুখ কখন বিপজ্জনক মোড় নেয়, সেটা অনুমান করা কঠিন। সেজন্যই ডেঙ্গু জ্বরের বিষয়ে চিকিৎসক ছাড়াও অন্য সবার জ্ঞান থাকা জরুরি যেন সঠিক সময়ে ব্যবস্থা নেওয়া যায়।
সরকারি-বেসরকারিভাবে ডেঙ্গু বিষয়ে অনেক প্রচারণা সত্ত্বেও জনমনে ডেঙ্গু বিষয়ে অনেক ভুল ধারণা ও বিশ্বাস রয়েছে। ডেঙ্গু জ্বরকে প্রভাবিত করছে আতঙ্ক, ভয়, ভুল চিকিৎসা।
ডেঙ্গু জ্বরের জীবাণু একটি ভাইরাস, যার ৪টি ধরন রয়েছে। একবার একটি ধরন দিয়ে অসুখ হলে আনুমানিক দুই বছর এ ধরনের বিপরীতে শরীরে প্রতিরোধ কাজ করে। তবে এর মধ্যে ডেঙ্গুর অন্য কোনো ধরন দিয়ে আবারো জ্বর হলে দেখা দেয় বিপত্তি, তখন ডেঙ্গু শক সিন্ড্রোম হতে পারে মারাত্মক।
ডেঙ্গু জ্বর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নিজেই সেরে যায়। সাধারণত মৃত্যু হার অনেক কম, ১ শতাংশেরও নিচে। তবে মারাত্মকভাবে হলে জটিলতা তৈরি হয় এবং মৃত্যুহার ২-৫ শতাংশ হয়ে থাকে। বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুহার ৫০ শতাংশও হতে পারে।
ডেঙ্গু জ্বরের ধাপ ও উপসর্গ
সাধারণ ৩টি ধাপে রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়।
প্রথম ধাপ (২-৭ দিন)
* উচ্চ জ্বর (৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস/১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট)। * তীব্র মাথার যন্ত্রণা। * চোখের পিছনে ব্যথার অনুভূতি। * সমস্ত শরীর ব্যথা। * বমিভাব। * মাথাঘোরা। * গ্রন্থি ফুলে যাওয়া। * ত্বকে বিভিন্ন স্থানে লালচে দাগ ওঠা ইত্যাদি।
দ্বিতীয় ধাপ (২-৩ দিন- ক্রিটিক্যাল)
এ সময়টাতে রোগীর প্রেসার কমে যেতে পারে। প্লাটিলেট অতিরিক্ত কমে যাওয়া, শক সিন্ড্রোম হওয়া এ পর্যায়ে হয়ে থাকে।
শেষ ধাপ (সেরে ওঠা)
* শরীর চুলকানো। * দুর্বলতা। * অরুচি ইত্যাদি।
রক্তের রিপোর্ট নিয়ে ভাবনা
ডেঙ্গু শনাক্তকরণের জন্য যে টেস্টগুলো প্রয়োজন হয়- ডেঙ্গু NS1 এন্টিজেন, ডেঙ্গু IgM, IgG, RT PCR। রোগের ক্ষতিকর দিক বুঝতে হলে CBC, SGPT, Creatinine, Electrolytes, Chest Xray, Albumin, CRP– এসব টেস্ট প্রয়োজন হতে পারে। অনেক ক্ষেত্রেই জীবাণু নিশ্চিত করা যায় না, টেস্ট নেগেটিভ আসে। কিন্তু অভিজ্ঞ চিকিৎসক রোগীর লক্ষণ দেখে ডেঙ্গু জ্বর নিশ্চিত করে থাকেন। অনেকেই যেখানে রোগীর প্লাটিলেট নিয়ে ভয়ে থাকেন, সেখানে একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসক বেশি লক্ষ্য করেন রোগীর ব্লাড প্রেসার, রক্তের হেমাটোক্রিট (HCT)।
ডেঙ্গু জ্বরের রোগীর চিকিৎসা কোথায় করবেন?
অন্যান্য ভাইরাস জ্বরের মতো ডেঙ্গুতে বেশিরভাগ রোগীর চিকিৎসা সম্ভব বাড়িতে থেকেই। কিন্তু বাড়িতে পর্যবেক্ষণ সম্ভব না হলে এবং কিছু বিপজ্জনক লক্ষণ দেখা গেলে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হবে। যেমন-
* প্রচণ্ড পেট ব্যথা। * ক্রমাগত বমি হওয়া। * মাড়ি বা নাক থেকে রক্তপাত। * প্রস্রাবে এবং মলের সঙ্গে রক্তপাত। * দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস। * ক্লান্তি। * বিরক্তি এবং অস্থিরতা। * অস্বাভাবিক আচরণ ইত্যাদি।
কোনো ওয়ার্নিং সাইন না থাকলেও যেসব রোগীর হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া উচিত -
* প্রেগন্যান্ট মহিলা। * যাদের ডায়াবেটিস, হার্টের অসুখ, রক্তের অসুখ, কিডনির অসুখ আছে। * হাসপাতাল সেবা থেকে অনেক দূরে অবস্থান। * যাদের বাড়িতে পর্যবেক্ষণ কঠিন। * অল্প বয়স্ক এবং বৃদ্ধ মানুষ ইত্যাদি।
ক্রিটিক্যাল সময়ে চিকিৎসা কী?
ক্রিটিক্যাল সময়ে যে বিষয়গুলো মাথায় রেখে চিকিৎসা করতে হয় তা হল- হেমাটোক্রিট, প্লাটিলেট, বিভিন্ন অঙ্গের সুরক্ষা (কিডনি, লিভার, হার্ট ইত্যাদি)। রোগীর ব্লাড প্রেসার নির্দিষ্ট লক্ষ্যে ধরে রাখা চিকিৎসার একটা মূল স্তম্ভ। প্রেসার ধরে রাখতে স্যালাইন এর পাশাপাশি, কলয়েড এবং অনেক সময় তাজা রক্ত প্রয়োজন হয়।
প্লাটিলেট দেওয়া নিয়ে অহেতুক ভাবনা
ডেঙ্গু রোগীর সামান্য রক্তক্ষরণ হতে পারে স্বাভাবিক প্লাটিলেট থাকা সত্ত্বেও। সাধারণত রক্তের প্লাটিলেট ১০০০০/মাইক্রোলিটার এর নিচে না কমলে প্রতিস্থাপন প্রয়োজন হয় না। তবে আগে থেকে প্লাটিলেট কিংবা রক্ত প্রতিস্থাপন করলে উপকার হয় না, বরং ক্ষতি হতে পারে।
বাসায় বসে স্যালাইন ইনজেকশন দেয়া যায় কি না?
অনেক সময়ে রোগীর পক্ষ থেকে এ ধরনের প্রশ্ন আসে। এর উত্তর একটাই ‘না’। ডেঙ্গুতে স্যালাইন এর নিয়মটা এত সেনসিটিভ যে, প্রয়োজনের বেশি স্যালাইন গেলে সমস্ত শরীরে, পেটে, ফুসফুসে পানি চলে আসতে পারে, আবার প্রয়োজন মতো স্যালাইন না দিলে রোগী শক এ যেতে পারেন, কিডনির ক্ষতি হতে পারে।
জ্বর আছে, অ্যান্টিবায়োটিক দিব কি না?
জ্বর মানেই অ্যান্টিবায়োটিক নয়। ডেঙ্গু জ্বরে অন্য কোনো ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণের লক্ষণ থাকলেই কেবল অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োজন হতে পারে।
কখন বুঝবেন ঝুঁকিমুক্ত?
* যখন রোগীর ২ দিন যাবত জ্বর থাকে না। * রোগীর প্রেসার ভালো থাকে স্যালাইন ছাড়া। * মুখের রুচি ভালো। * রক্তক্ষরণ নেই। * প্লাটিলেট ৫০০০০ এর উপর এবং বেড়ে যাচ্ছে।
এ সমস্ত লক্ষণে বোঝা যায় রোগী ঝুঁকিমুক্ত।
শেষ কথা
* ডেঙ্গুর সুনির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই তাই চিকিৎসায় প্রায়ই মতভেদ দেখা দেয়।
* ডেঙ্গুর লক্ষণ দেখা দিলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী দ্রূত পরীক্ষা করতে হবে এবং চিকিৎসা নিতে হবে।
* টেস্ট নেগেটিভ মানেই ডেঙ্গু নেই, এমনটা নয়। আবার ডেঙ্গুর সঙ্গেই অন্য জ্বরের কারণ থাকতে পারে (যেমন ম্যালেরিয়া, টাইফয়েড)।
* ব্যথানাশক ওষুধ, অ্যান্টিবায়োটিক, রক্ত বাড়ানোর ওষুধের যথেচ্ছ ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে হবে।
* প্লাটিলেট নিয়ে আতঙ্ক রোগীর ক্ষতি করতে পারে। চিকিৎসকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রস্তুত থাকুন।
* ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসায় ধৈর্য্য ধারণ করুন।
* এডিস মশা থেকে নিরাপত্তার জন্য নিয়ম মেনে চলুন।
লেখক: অ্যাসোসিয়েট কনসালটেন্ট, মেডিসিন বিভাগ শিপ ইন্টারন্যাশনাল হাসপাতাল।