আজ আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে হারানোর দিন। ৪৭তম মৃত্যুবার্ষিকী। তার সৃষ্টিশীল কর্মের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যায়, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ যেসব লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেসবের সরব উপস্থিতি রয়েছে কাজী নজরুলের লেখনি এবং জীবনীতে।
সাম্যবাদের কবি, অসাম্প্রদায়িক চেতনার কবি নজরুল। যিনি সত্য ও সুন্দরের জয়গান গেয়ে গেছেন সারাজীবন। তিনি বলেছেন দেশের সব স্তরের মানুষের কথা। নজরুল মনে প্রাণে ছিলেন বিশ্ব নাগরিক। পৃথিবীর সকল মানুষের কল্যাণে অন্যায় অবিচারের বিপক্ষে-তিনি ছিলেন প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। এজন্যই নজরুলের লেখায় ফুটে উঠেছে সব ধরনের বঞ্চনার বিরুদ্ধে জোর প্রতিবাদ।
বাঙালির চিন্তা চেতনায় তিনি প্রগতিশীলতার জোয়ার এনে দিয়েছেন। আমরা তা কতটুকু এগিয়ে নিতে পেরেছি? কোথাও কোথাও পিছিয়ে পড়েছি কিন্তু এর জন্য কবিকে দায়ী করা যায় না। বরং তার চিন্তা-চেতনার প্রতিফলন ঘটানো গেলে জাতীয় জীবনে প্রকৃত মুক্তি প্রতিষ্ঠা পেতে পারে।
আমরা যেন ভুলে না যাই, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে কবি নজরুল ইসলাম ছিলেন সীমাহীন প্রেরণার উৎস। তার কবিতা ও গান মুক্তিবাহিনীকে উজ্জীবিত করেছিল।
কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম অবিভক্ত বাংলায়। ১৩০৬ সালের ১১ জ্যৈষ্ঠ পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। কবির পিতার নাম কাজী ফকির আহমেদ ও মাতা জাহেদা খাতুন। বৈচিত্র্যময় ছিল তার শৈশব-কৈশোর।
কবি যখন সৃষ্টি সাধনায় ব্যস্ত বিশ্বে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটে যায়। তুরস্কে কামাল পাশার নেতৃত্বে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পায়, রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিল্পব ঘটে। অন্যদিকে ভারতে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন ক্রমে শক্তিশালী হয়ে উঠতে থাকে। এইসব বৈপ্লবিক পরিবর্তন একজন বিশ্ব নাগরিক এবং মানবিক মানস সম্পন্ন কবি কাজী নজরুলের লেখায় গতি যোগ করেছিল, গন্তব্য ঠিক করে দিয়েছিল।
কবির যাপিত জীবনও কম ঘটনাবহুল নয়। কাজী নজরুলের পিতা ছিলেন স্থানীয় মসজিদের ইমাম। পরিবারে ধর্মীয় অনুশাসন আর পিতার জীবন দর্শনের দেখা যেমন পেয়েছিলেন তেমনি অভাব–অনটন ছিল শৈশব থেকেই তার নিত্যসঙ্গী। শৈশব-কৈশোরে তিনি কখনো ছিলেন লেটো দলের বাদক আবার কখনো রুটির দোকানের শ্রমিক। এরপরে কাজ করেছেন সৈনিক হিসেবে। একপর্যায়ে শুরু করেন সাংবাদিকতা। কবি যুক্ত হয়ে ছিলেন এইচএমভি ও কলকাতা বেতারে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় কবি ব্রিটিশ শাসকের কোপানলে পড়েছেন, কারারুদ্ধ হয়েছেন। কিন্তু তিনি নত হননি। পরাজয় বরণ করেননি।
কাজী নজরুল ছিলেন একাধারে কবি, সংগীতজ্ঞ, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক, চলচ্চিত্রকার, গায়ক ও অভিনেতা। দুর্ভাগ্যজনকভাবে তার সচেতন কর্মপ্রচেষ্টা মাত্র ২৩ বছর চালিয়ে নিতে পেরেছিলেন। এরপর কবি অসুস্থ হয়ে পড়েন। অুসুস্থ কবি ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বসবাস করতেন। কিন্তু তার সৃষ্টি অমর। কাজী নজরুলের কবিতায় উচ্চারিত ‘চির উন্নত মম শির’-এই দৃঢ়তা যেন একটি সদ্য স্বাধীন দেশের দৃঢ় অঙ্গীকার। অথবা ‘চল্ চল্ চল্’ গানটি যেন সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণায় পূর্ণ।
বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উপলব্ধি করতেন তার সৃষ্টির শক্তি। এজন্যই ১৯৭২ সালের ২৪ মে কবি কাজী নজরুল ইসলামকে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনেন বঙ্গবন্ধু। বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বসবাসের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। ধানমন্ডি আবাসিক এলাকার ২৮ নম্বর সড়কের ৩৩০ নম্বর বাড়িতে বসবাস করতেন কবি। বঙ্গবন্ধু ঐ বাসভবনের নামকরণ করেছিলেন ‘কবিভবন’।
১৯৭৫ সালের ২২ জুলাই কবির স্বাস্থ্যের অবনতি দেখা দেয়। এরপর বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে তৎকালীন পিজি হাসাপাতালের ভর্তি করা হয় কাজী নজরুল ইসলামকে। অসু্স্থ কবি পিজি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন এক বছর এক মাস আট দিন। ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট ১৩৮৩ বঙ্গাব্দ ১২ ভাদ্র তারিখে কবির মৃত্যু হয় (উল্লেখ্য যে, বাংলা পঞ্জিকা সংস্কারের পর বাংলা তারিখ অনুযায়ী কবির জন্ম ও মৃত্যুদিন দেশে পালিত হয়ে আসছে)। কিন্তু তার লেখার জীবনীশক্তি আজও শোষিত–বঞ্চিত মানুষের মুক্তির পক্ষে মানবতার মুক্তির জন্য এবং সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার, কূপমণ্ডূপকতার বিরুদ্ধে কথা বলে। আমরা যেন তার রেখে যাওয়া সৃষ্টিকর্ম চর্চা করি। আমরা যেন আমাদের জাতীয় জীবনে তার আদর্শকে প্রতিষ্ঠা করতে পারি। প্রয়াণ দিবসে তার প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা।