সূর্যের আলো তখনো ঠিকঠাক কিরণ দেওয়া শুরু করেনি। কলম্বোর সেন্ট জোসেফ কলেজের কাছে যেতে দেখা যায় রাজ্যের ব্যস্ততা। ৮টা নাগাদ ক্লাস শুরু হতে নেমে আসে পিনপতন নীরবতা। কিন্তু ভিন্নতা দেখা গেল কলেজ মাঠ প্রাঙ্গণে। ক্রিকেট দল প্রস্তুতি নিচ্ছে, কারণ তাদের ম্যাচ আছে অন্য এক কলেজের সঙ্গে।
কলেজ মাঠ না বলে ছোটখাটো স্টেডিয়াম বলা চলে। শুধু গ্যালারি নেই, আছে ড্রেসিংরুমসহ প্রয়োজনীয় সবকিছুর ব্যবস্থা। শ্রীলঙ্কার রাজধানীর বুকে বিখ্যাত এই কলেজ সম্পর্কে বলতে গিয়ে কলেজের সিকিউরিটি ম্যানেজার ইন্দ্রজীত বলে ওঠেন, ‘এখানে শুধু অধিনায়ক তৈরি হয়।’ এরপরই এক গাল হাসি।
এশিয়া কাপে শ্রীলঙ্কার হয়ে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স করা দুনিথ ভেলালাগে, সাদিরা সামারাবিক্রমা ও দিমুথ করুনারত্নরা এই কলেজেরই ছাত্র। বছর দুয়েক হলো গ্রেড টুয়েলভ শেষ করে বের হয়েছেন ভেলালাগে-সাদিরা। এ ছাড়া থিসারা পেরেরা, অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুস ও চামিন্দা ভাস এই কলেজেরই ছাত্র ছিলেন।
এই কলেজেরই চারজন ছাত্র বর্তমান শ্রীলঙ্কান অনূর্ধ্ব-১৯ দলের ক্রিকেটার। ১৯৮৬ সালে প্রতিষ্ঠিত বিখ্যাত এই কলেজে আসা অন্য এক কারণে। এখানে পড়ছেন এবং স্কুল দলের হয়ে সম্প্রতি দারুণ খেলছেন কিংবদন্তি স্পিনার মুত্তিয়া মুরালিধরনের ছেলে নারেন মুরালিধরন। তবে মজার বিষয় হলো, বাবার স্পিন জাদু দেখে বড় হয়ে ওঠা নারেন ভালোবাসেন ব্যাটিং করতে। লেগ স্পিন করলেও সেটি পার্ট টাইম।
সেন্ট জোসেফ কলেজের ক্রিকেট মাঠ। এখানে খেলেই বড় হয়েছেন দুনিথ বেলালাগেরা।
কলেজের সিকিউরিটি ম্যানেজার ইন্দ্রজিত ও ক্রিকেট কোচ ডিলান রামানায়েকের সৌজন্যে একান্তে কথা হয় নারেন মুরালির সঙ্গে। ও-লেভেল পরীক্ষা দেবেন বলে আপাতত ক্রিকেট থেকে কিছুটা দূরে আছেন, তবে সৌভাগ্যক্রমে তাকে পাওয়া গেল কলেজে। পরিচয় দিতেই আগ্রহ নিয়ে কথা বলতে থাকেন।
প্রথম প্রশ্নই ছিল বাবা কিংবদন্তি স্পিনার আর আপনি হচ্ছেন ব্যাটার। চাইলে তো বাবার কাছ থেকে শিখে স্পিনারই হতে পারতেন। তার উত্তর, ‘আমি বোলিং থেকে ব্যাটিংটা বেশি উপভোগ করি। বোলার পরিচয় নয় আমি বলতে পারি আমি একজন ব্যাটার। বলতে পারেন বোলিং থেকে আমি ব্যাটিংটা বেশি ভালোবাসি। আমি লেগ স্পিন করি, কিন্তু পার্ট টাইম।’
বাবা ক্রিকেটার, ছেলেও সেই পথে হাঁটবেন তা অনুমেয় ছিল। কিন্তু নারেন বলছেন বাবার থেকে অনুপ্রাণিত হলেও ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্নটা তার একান্ত নিজেরই, ‘ছোট বেলা থেকে আমি ক্রিকেট খেলতে চেয়েছি। এরপর আমি ক্লাব ক্রিকেট এবং স্কুল ক্রিকেট শুরু করি। এটা আমার নিজের স্বপ্ন কিন্তু হ্যাঁ আমি আমার বাবার থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছি। ছোট বেলা থেকে আমি ক্রিকেটীয় পরিবেশে বড় হয়েছি, ড্রেসিংরুমে থেকেছি।’
টেস্ট ও ওয়ানডেতে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি মুরালির শেষটা রঙিন হলেও তার ক্রিকেট ক্যারিয়ারজুড়ে আছে লড়াই, সংগ্রাম। তিন-তিনবার তার বিরুদ্ধে চাকিংয়ের অভিযোগ ওঠে। নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা উতরে আবার ২২ গজে ফিরে হয়ে উঠেছেন প্রতিপক্ষের যম। বাবার এমন সব সংগ্রাম স্বচক্ষে না দেখলেও সোনার চামচ মুখে বেড়ে ওঠা নারেন মুরালি সেটিকেই অনুপ্রেরণা হিসেবে নিয়েছেন, ‘যখন বাবার বিরুদ্ধে চাকিংয়ের অভিযোগ ওঠে সেটি ছিল খুব কঠিন সময়, তিনি দমে যাননি। খেলা চালিয়ে যান এবং নানা কৃতিত্ব অর্জন করেন। আমাকে সেগুলো অনুপ্রাণিত করে।’
ক্রিকেটের সঙ্গে জড়িত না থাকলেও মুরালিধরন নানা কাজে ব্যস্ত থাকেন। কদিন আগে বের হয়েছে তার বায়োপিক। তবে সুযোগ হলেই ছেলে নারেনকে সময় দেন বাবা মুরালিধরন। ছেলেও প্রয়োজন হলে বাবাকে বলেন। কিন্তু বাবা এত বড় তারকা সেই চাপ কি কখনো কাজ করে নারেন মুরালির মনে? যে বাবার মতো ক্রিকেটারই হতে হবে? এমন প্রশ্নের জবাবে বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে নারেন বলেন, ‘মাঝে মাঝে এটা যে কারও অনুভব হতে পারে। কিন্তু সাধারণভাবে চিন্তার করলে এই চাপ আমার আসে না।’
যে কোনো ক্রিকেটারেরই স্বপ্ন থাকে দেশকে প্রতিনিধিত্ব করার। নারেন মুরালিও ব্যতিক্রম নন। তবে তিনি স্বপ্নের পথে এগোতে চান ধাপে ধাপে, ‘আশা করি আমি জাতীয় দলের হয়ে খেলবো। কিন্তু এখন আমি আমার বর্তমান খেলাকে উপভোগ করছি। বাকিটা আমি ধাপে ধাপে করবো।’
কথাবার্তা প্রায় শেষের দিকে। বাংলাদেশ প্রসঙ্গ না আনলে কি হয়? ডানহাতি ব্যাটার নারেন মুরালি জানান, বাংলাদেশে তার পছন্দের ক্রিকেটার মুশফিকুর রহিম। মুশফিক তার পছন্দের ক্রিকেটার হলেও তার আদর্শ বিখ্যাত বাবাও নন, নারেন মুরালির আদর্শ আরেক দেশ পাকিস্তানের অধিনায়ক বাবর আজম!
কিংবদন্তি ক্রিকেটারের যে পুত্র স্বপ্ন দেখছেন নিজের মতো করে, তার আদর্শ তো এমন ব্যতিক্রমই হওয়ার কথা।