ঝালকাঠি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষক ফয়সাল রহমান জসীম। সুন্দর পাঠদানের জন্য শিক্ষর্থীদের কাছে তুমুল জনপ্রিয় তিনি। প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্যও জসীম কাজ করে চলেছেন। প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য তিনি গড়ে তুলেছেন একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও। জসীম নিজেও শারীরিক প্রতিবন্ধী। কিন্তু প্রতিবন্ধকতা দমাতে পারেনি তাকে। এখন তিনি আলোকিত মানুষ গড়ার একজন কারিগর হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন সবার কাছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় ১৯৮৭ সালের ২৩ এপ্রিল ট্রেন দুর্ঘটনায় দুই পা প্যারালাইসড হয়ে যায় জসীমের। শরীরিক সমস্য নিয়ে অদম্য জসীম পড়ালেখা চালিয়ে যান। স্কুল কলেজের গন্ডি পেড়িয়ে পড়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের জনসভায় গিয়ে গ্রেনেড হামলায় আহত হয়েছিলেন তিনি। সুস্থ হওয়ার পরে ২০০৭ সালে ঝালকাঠি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের সিনিয়র সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। পড়ালেখায় মনোযোগী করে তোলায় শিক্ষার্থীদের কাছে তিনি জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। কর্মদক্ষতা দিয়ে জয় করেন নিজের প্রতিবন্ধকতাকে।
২০১৪-১৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবন্ধীতার ওপর পিএইচডি করেন ফয়সাল রহমান জসীম।
জসীম প্রতিবন্ধীদের জন্য একটি বিদ্যালয়ে গড়ে তুলেছেন। বিদ্যালয়টির নাম দিয়েছেন ‘প্রতিবন্ধী ও অটিজম বিদ্যালয়’। প্রতিবন্ধীদের উন্নয়নের জন্য একটি সংস্থাও তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন। দেশ বিদেশে নিয়েছেন প্রশিক্ষণ। বর্তমানে তিনি প্রতিবন্ধীদের মাস্টার ট্রেইনার হিসেবে কাজ করেন। শিক্ষা জীবন থেকে এখন পর্যন্ত নানা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েও কখনো থেমে যাননি এই শিক্ষক।
বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি অন্য শিক্ষকরাও জসীমকে সব কাজে উৎসাহ দেন। হুইল চেয়ারে বাসা থেকে বিদ্যালয়ে আসা যাওয়ার ক্ষেত্রে জসীমকে সহকর্মীরা সহযোগিতা করছেন। শিক্ষার্থীরা তাঁর প্রসংশায় পঞ্চমুখ।
ঝালকাঠি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র আরিফ খান জানান, জসীম স্যার আমাদের সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ে ক্লাস নেন। তিনি অত্যন্ত ভালো মনের একজন মানুষ। তাঁর পাঠাদানে আমরা খুবই খুশি। তিনি পাঠ্য বইয়ের পাশাপাশি আমাদের দেশ বিদেশের নানা বিষয়ে জ্ঞান দেন।
শিক্ষার্থী সাকিবুল ইসলাম জানান, স্যার একজন প্রতিবন্ধী, তবুও তাঁর সব বিষয়ে জ্ঞান রয়েছে। তিনি শুধু আমাদের শিক্ষকই নন, একজন অভিভাবকও।
জসীম বলেন, আমি প্রথমে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকরি পাই। কিন্তু নানা প্রতিকূলতার কারণে সেই চাকরি ছেড়ে দেই। পরে ঝালকাঠি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে চাকরি পাই। এখন সেখানেই শিক্ষকতা করছি।
তিনি আরও বলেন, প্রতিবন্ধী হলেই যে, তিনি সমাজের বোঝা, আমি এটা মানি না। সমাজ উন্নয়নে সব মানুষের ভূমিকা থাকা প্রয়োজন। আমি প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করছি। তাদের উন্নয়নে আমৃত্যু কাজ করে যাবো। সমাজের বিশেষ শিশুদের জন্য ঝালকাঠিতে কারিগরি একটি বিদ্যালয় স্থাপনের জন্য সরকারের সহযোগিতা কামনা করছি।
ঝালকাঠি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক মারুফা বেগম বলেন, প্রতিবন্ধী হয়েও ফয়সাল রহমান জসীম শিক্ষকতায় সুনাম অর্জন করেছেন। শিক্ষার্থীদের আস্থা ও ভরসাস্থল তিনি। সবসময় তাঁর সফলতা কামনা কামনা করি।
ঝালকাঠি প্রতিবন্ধী ও অটিজম বিদ্যালয়ের শিক্ষক আমির হোসেন উজ্জল বলেন, আমাদের বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেছেন জসীম স্যার। তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রমে বিদ্যালয়টি আজ আলোর মুখ দেখেছে। তাঁর মেধা, শ্রম ও আর্থিক সহযোগিতায় বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের এখানে সব ধরণের শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। অনেক শিক্ষার্থী বিছানায় শুয়ে থাকতো, তাঁরাও এখন হাটতে পারছে। সবকিছুই জসীম স্যারের জন্য সম্ভব হয়েছে।
ঝালকাঠির জেলা প্রশাসক ফারাহ গুল নিঝুম বলেন, শিক্ষক সবসময় শিক্ষার্থীদের আদর্শ। তাই শিক্ষকতা পেশায় নীতিবান মানুষের প্রয়োজন। জসীম তেমনই একজন মানুষ গড়ার কারিগর। শিক্ষকতা পেশার মর্যাদা রক্ষায় তিনি নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। প্রতিবন্ধীরা যে মানুষের অভিশাপ নয়, তিনিই এর উদাহরণ।