খেলাধুলা

ফ্লাইট বিলম্বে রাজকীয় আপ্যায়ন

বাংলাদেশ থেকে চীন দুই ঘণ্টা এগিয়ে থাকায় তখন ভালোভাবেই সন্ধ্যা নেমে গেছে আকাশপথে। উপরে অন্ধকার, নিচে সারি সারি আলোর জোনাকি। যেন বিমানের গতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মিট মিট করে জ্বলছে। আলোর জোনাকি দেখতে দেখতে হঠাৎ বিমানের সাউন্ড সিস্টেমে ঘোষণা আসলো ‘আমরা আর অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই কুনমিং বিমানবন্দরে অবতরণ করতে যাচ্ছি।’ ঘড়িতে তখন সময় প্রায় সাড়ে সাতটা।

বিমান থেকে নেমে টানেল বেয়ে একটু সামনে আগাতেই ‘চায়না ইস্টার্ন এয়ারলাইন্সে’র একজন নারী প্রতিনিধি ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে বলছেন, ‘কারা কারা হ্যাংজু যাবেন?’ সাড়া দিতেই তাদেরকে নিয়ে একপাশে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছেন। বাংলাদেশ থেকে আমরা মোট ১২ জন যাত্রী ছিলাম হ্যাংজু যাওয়ার। সবাই আসার পর তিনি জানালেন, দুঃখিত; হ্যাংজুর ফ্লাইটটি ক্যান্সেল হয়েছে। আজ রাতে হচ্ছে না। ১০ ঘণ্টা বিলম্ব হবে। আপনারা আমাকে ফলো করুন।

আমরা যারা এশিয়ান গেমসের অ্যাক্রিডিটেশনধারী তাদের কোনো প্রকার ফরম পূরণ করা ছাড়াই ইমিগ্রেশন সম্পন্ন হয় অল্প সময়ের মধ্যেই। আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হলেও কুনমিংকে এক প্রকার ভুতুরে লাগছিল। সুনশান নীরবতা। গোটা আটেক ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা যেন অলস সময় পার করছেন। গোটা বিমানবন্দর যেন তাদের মতো ঝিমুচ্ছে।

ইমিগ্রেশন শেষ করে এবার লাগেজের জন্য অপেক্ষা। ১৫ মিনিটের মাথায় আমাদের লাগেজ আসতে শুরু করলো। কিন্তু একি! অধিকাংশের ব্যাগ ও লাগেজ ভেজা! ঢাকার মুষলধারের বৃষ্টিতে কি তাহলে? ব্যাগের ভেতরে রাখা কাপড়-চোপড়ও ভিজে একাকার।

আমার লাগেজ এলো সবার শেষের দিকে। একি! লাগেজ তো দেখি একপাশ দিয়ে মুড়ির টিন হয়ে আছে। টোপলা পড়ে গেলো। সঙ্গে কিছুটা ফেঁটেও গেছে। শুধু আমার একা নয়, আমাদের আরও একজনের এমন হয়েছে। তারটা অবশ্য আমারটার চেয়ে বিশ্রিভাবে ভেঙেছে। বিমানবন্দরে বসে কিছু বলিনি। ভেবে নিয়েছে বলে লাভ হবে না।

এমন সময় জানানো হলো- আমাদের জন্য কুনমিং শহরে হোটেলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। স্থানীয় সময় রাত সাড়ে ৯টার আমাদের ফ্লাইটটি পরদিন সকাল ৬টা ৫৫ মিনিটে ছাড়বে হ্যাংজুর উদ্দেশ্যে। রাত্রিযাপনের জন্য আমাদের জন্য হোটেলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তারাই আমাদের সবাইকে ডেকে যথাসময়ে বিমানবন্দরে নিয়ে আসবে।

এরপর বিমান কর্তৃপক্ষের আরেকজন প্রতিনিধি আমাদের ‘ফলো মি’ বলে গেটের দিকে আগাতে শুরু করলেন। বিমানবন্দর থেকে বাইরে বের হতেই ধাক্কা খেলাম। বাইরে এতো ঠাণ্ডা কেন? মনে হচ্ছে দুপুর বেলা বাইরে থেকে এসে এসি রুমের মধ্যে প্রবেশ করেছি।

অদূরেই আমাদের জন্য সুন্দর একটি মিনিবাস অপেক্ষা করছিল। সবার লাগেজগুলো তারাই যত্ন করে বাসে তুললো। সবাই আসার পর চলতে শুরু করলো বাস। আমাদের ১২ জনের সঙ্গে বিমান কর্তৃপক্ষের আরও দুইজন প্রতিনিধি আছেন। প্রায় ২২ কিলোমিটার চলার পর মিনিবাসটি থামলো। আমাদের ওঠানো হলো একটি হোটেলে। সবার পাসপোর্ট জমা রেখে রুমের কার্ড দেওয়া হলো।

কার্ড নিয়ে রুমে ঢুকতেই চোখ চড়কগাছ! রাজসিক রুম। আমি সিঙ্গেল হলেও ডাবল বেডের রুম। আছে সব ধরনের আধুনিক সুযোগ-সুবিধা। ফোর স্টার মানের হোটেলে যা যা সুযোগ-সুবিধা থাকে।

একটু পরেই ডাকা হলো খাওয়ার জন্য। বিমানবন্দরেই জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল আমরা কি কি খেতে চাই? কি কি খেতে সমস্যা আছে? আমরা তাদের বলেছিলাম সব ধরনের হালাল খাবারেই আমরা খেতে পারবো। ডাইনিংয়ে গিয়ে দেখি এলাহিকাণ্ড। কুনমিংয়ে মুসলিমদের জন্য একটি হোটেলে যতো ধরনের আইটেম থাকতে পারে তার কোনোটা মনে হয় বাদ দেয়নি তারা। তার মধ্যে গরু, খাসি এবং মুরগির আইটেমই ছিল পাঁচ-ছয়টা। ভাজা মাছও আছে। সঙ্গে আঠাঁলো সাদা ভাত। কয়েক প্রকার সবজি ও সালাদ।

আমাদের সহযোগিতার জন্য বাংলাদেশি কনস্যুলেটের কয়েকজন তরুণ এসেছিলেন। তারা একে একে সেই খাবারগুলোর নাম বলছিলেন। স্বাদ কেমন বলছিলেন। আমরা একে একে সবগুলোই পরখ করছিলাম। গন্ধের কারণে ১৮দিন ঠিকমতো খেতে পারবো না বলে দেশ ছাড়ার আগেই যে ভয়টা পাচ্ছিলাম সেটা অবশ্য কেটে গেল নিমিষেই।

ভরপেট খেয়ে বাইরে সবাই একটু-আধটু গল্প-গুজব করে ঘুমাতে গেলাম রুমে। হোটেলে ওয়াইফাই থাকলেও কিছুই করা যাচ্ছিল না। ফেসবুকে ঢোকা যাচ্ছিল না, গুগলের কোনো অ্যাপসই চালানো যাচ্ছিল না। এ যেন এক আজব পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে গেলাম। অনেকে বাসায় জানাতেই পারেননি যে তিনি কোথায় আছেন, কেমন আছেন।

চলবে…

পর্ব-১: আকাশপথে সন্ধ্যা নামে