বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ। বাবার চেয়ে মাকেই বেশি ভালোবাসতেন। সবকিছু শেয়ার করতেন মায়ের সাথে। সুযোগ পেলেই ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে যেতে মায়ের সান্নিধ্যে। মা ছিলেন ছেলের জন্য পাগল। দূরে থাকলে ক্ষণে ক্ষণে ফোন দিয়ে খোঁজ খবর নিতেন। দুই ছেলে আর স্বামীকে নিয়ে সুখের সংসার ছিল রোকেয়া খাতুনের।
কিন্তু সেই সুখ দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। চার বছর আগে বুয়েটের শেরেবাংলা হলে আবরার ফাহাদকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় উত্তপ্ত হয় বুয়েট ক্যাম্পাস। সর্বত্র নিন্দার ঝড় ওঠে। সেই সময় আরবারকে নির্যাতনের কিছু ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। সেই ছবিগুলো এখনো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘুরে বেড়ায়। আবরারের সেই ছবিগুলো দেখলে মা আর শান্ত থাকতে পারেন না। কান্নায় ভেঙে পড়েন। হয়ে পড়েন অসুস্থ।
এই অসুস্থতার মাঝেও রেখে যাওয়া জিনিসপত্রগুলো সাজিয়ে রেখেছেন। আবরার যেভাবে রেখে গিয়েছিল। সেই সাজানো গোছানো ঘরে এখন শুধু আবরার নেই।
২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর রাতে বুয়েটের শেরেবাংলা হলে আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় চকবাজার থানায় হত্যা মামলা করেন আবরার ফাহাদের বাবা। ওই মামলার রায়ে ২০২১ সালের ৮ ডিসেম্বর বুয়েটের ২০ শিক্ষার্থীকে মৃত্যুদণ্ড এবং ৫ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল। মামলাটি এখন উচ্চ আদালতে নিষ্পত্তির অপেক্ষায়।
আবরারের বাবা বরকতুল্লাহ জানান, কিছুদিন ধরে আবরারের মা খুব বেশি অসুস্থ। ছেলের কথা মনে করে প্রায় সে কান্না করে। বুধবার ফেসবুকে কে যেন আবরারকে নির্যাতনের একটি ছবি দেখিয়েছে। সেটা দেখে আবারও কান্নাকাটি করছে। মায়ের মন তো সব আবরারের স্মৃতির কথা মনে করে।
তিনি বলেন, নিম্ন আদালত থেকে আমরা যে রায় পেয়েছি তাতে সন্তুষ্ট আছি। উচ্চ আদালত যেন সেই রায় বহাল রাখেন সেই প্রত্যাশা করছি।
আবরারের মা রোকেয়া খাতুন বলেন, আমার একটাই চাওয়া যারা ঘটনার সাথে জড়িত তাদের যেন শাস্তিটা কার্যকর হয়। ওরা কিন্তু জেলে আছে, ইচ্ছে করলে ওদের বাবা-মা সন্তানকে দেখতে যেতে পারছে। কথা বলতে পারছে। কিন্তু আজকে আমি চারটি বছর সবকিছু থেকে বঞ্চিত হয়ে আছি। আবরার আমাকে আম্মু বলে ডাকে না। আমার বুকটা হাহাকার করে।
তিনি বলেন, আমার ছেলের সাথে যারা পড়ালেখা করতো আজকে তারা চাকরি করছে, বিয়ে করেছে। অনেকের বাচ্চাও হয়েছে। আর আমার ছেলেটাকে ওরা বিনা দোষে কি নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করলো। শুধুমাত্র ওদের জন্য আজকে আমি সব কিছু থেকে বঞ্চিত। আবরারের সমবয়সী কাউকে দেখলে আমার বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে, হু হু করে কেঁদে ওঠে।
রোকেয়া খাতুন বলেন, আবরার ছাড়া কেমন আমার জীবন চলছে এটা আমি টের পাচ্ছি। এটা বলে বোঝানো সম্ভব না। একজন মা তার সন্তান ছাড়া পৃথিবীটাকে অন্ধকার দেখে। সন্তানের সাথে পৃথিবীর কোনো বস্তুর তুলনা করা যায় না। বেঁচে আছি কোনোরকম। মনে হয়, দুনিয়ার সবকিছু দিয়ে যেন শান্তি ফিরে আসবে না। আমার দুই পাশে সব সময় ওরা দুই ভাই থাকতো। ওরাই আমার ছিলো পৃথিবী।
তিনি বলেন, আবরারের মৃত্যু হয়েছে ঠিক, কিন্তু ওর আসবাবপত্র রয়েছে আগের মতো। সে যে ঘরে পড়তো, ঘুমাতো, টিভি দেখতো সবকিছু আগের মতো আজও আছে, শুধু আবরার নেই। তার পোশাক- আশাক সব যত্ন করে তুলে রেখেছি আমি। আমি যতদিন বেঁচে থাকবো আবরার স্মৃতি ওইভাবে থাকবে। আমি মরে যাওয়ার পরে যে যা করে করুক, আমি তো তখন আর দেখতে আসবো না।
উল্লেখ্য, ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর রাতে বুয়েটের শেরেবাংলা হলে আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় ১৯ জনকে আসামি করে পরের দিন ৭ অক্টোবর চকবাজার থানায় একটি হত্যা মামলা করেন আবরার ফাহাদের বাবা বরকতুল্লাহ। ওই বছরের ১৩ নভেম্বর ২৫ জনকে অভিযুক্ত করে অভিযোগপত্র দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ঢাকা মহানগর (দক্ষিণ) গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) পরিদর্শক ওয়াহেদুজ্জামান।
২০২০ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ২৫ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে বিচার শুরু হয়। ২০২১ সালের বছর ৮ ডিসেম্বর আবরার হত্যা মামলায় ২০ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড এবং পাঁচ আসামির যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দেন ঢাকার তৎকালীন এক নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক আবু জাফর মো. কামরুজ্জামান।