২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে আমি যখন ‘এশিয়ান গেমস’ কাভার করতে বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতির (বিএসপিএ) প্রতিনিধি মনোনীত হই, তখন থেকেই চীনের হ্যাংজু শহরের বিখ্যাত জিনিসগুলো সার্চ দিতে থাকি। ইউটিউবে, অন্যান্য মাধ্যমে সে সম্পর্কে ধারনা নিতে থাকি। সে সময় একদিন হঠাৎ করে একটি মসজিদের তথ্য পাই। মসজিদটির নাম ফোনিক্স মসজিদ।
নামের মহত্ত্বের চেয়ে এই মসজিদের ইতিহাসের মহত্ত্ব অনেক বেশি। মসজিদটি ৭৪৩ বছরের পুরনো এবং চীনে প্রথম নির্মিত মসজিদগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। যেটি নির্মিত হয়েছিল ‘থাং ডাইনেস্টির’ (সাম্রাজ্য) সময়। সং সাম্রাজ্যের সময় এটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় এবং ১২৮০ সালে পুনরায় নির্মিত হয়। সেই হিসেবে এটির বয়স এখন ৭৪৩ বছর।
এটার ইতিহাস জেনে ২০২২ সালেই মনস্থির করেছিলাম এশিয়ান গেমস কাভার করতে আসলে এই মসজিদ দেখতে যাবো। কিন্তু এখান এসে বাস্তবতা বুঝলাম। বাস্তবতা হলো ভাষাগত সীমাবদ্ধতা। যাকেই জিজ্ঞেস করেছি সেই বলেছে এ বিষয়ে তেমন কিছুই জানেন না। কেউ কেউ কখনো নাম-ই শোনেননি। আমি হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম। ভেবেছি হয়তো অনেক দূর হবে। যেমন কুনমিং থেকে হ্যাংজুর দূরত্ব ১২০০ কিলোমিটারের বেশি। এতো না হলেও এক-দেড়’শ তো হবেই।
হঠাৎ একদিন আমাকে পাঞ্জাবি পরা অবস্থায় দেখে এমএমসি’র (স্থানীয় মিডিয়ার) এক সাংবাদিক এসে বললেন- তুমি কি এখানকার সবচেয়ে পুরনো মসজিদটি ঘুরে দেখেছো? আমার মনে হয় সেটা বেশি দূরে নয়।
একথা বলে তিনি তাদের ম্যাপ দেখতে লাগলেন। দেখে জানালেন ভালোই দূর। তবে তুমি মেট্রো দিয়ে যেতে পারবে। বসে বসে মেট্রো লাইনের ম্যাপ দেখালেন। সব লেখাই চাইনিজ ভাষায়। এরপর কষ্ট করে সেটার গায়ে ভাঙা ভাঙা হাতে ইংরেজিতে লিখে দিলেন কিভাবে কোথা থেকে ফোনিক্স মসজিদে যাবো।
কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, এসব তথ্য সবই তিনি দিয়েছেন উইচ্যাটে। এটা পাওয়ার পরদিনই উইচ্যাটে আমি ব্লক খাই। সেই থেকে টানা পাঁচদিন তাকে মনে মনে খুঁজেছি। কিন্তু পাইনি। মেইন প্রেস সেন্টারে (এমপিসি) বসে মনোযোগ দিয়ে কাজ করছিলাম। হঠাৎ দেখি কাঁধে কেউ হাত রেখেছে। ভেবেছি হয়তো আমাদের বাংলাদেশি কোনো ভাই হবেন। কিন্তু না। দেখি সেই সাংবাদিক। মুখভরা হাসি নিয়ে জানতে চাইলেন গিয়েছিলাম কিনা মসজিদ দেখতে। আমি তাকে ব্লক খাওয়ার বিষয়টা জানাই। তিনি ব্যথিত হন এবং ব্লক খোলার বহু চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। শেষমেষ আমাকে আবার সেই ছবিটি দেখান এবং মোবাইলে ছবি তুলে নিতে বলেন।
কিন্তু তিনটা লাইন চেঞ্জ করে ২০-২২টা স্টেশন পেরিয়ে সেখানে একা যাওয়ার সাহস করে উঠতে পারছিলাম না। একদিন লাইন-১ দিয়ে যাওয়ার সময় খেয়াল করলাম সেই টিংয়ান রোড। যেখানে নেমে তিনি ফোনিক্স মসজিদের খোঁজ করতে বলেছিলেন। কিন্তু একা যাবো? যেখানে কেউ কোনো ভাষা বুঝে না। বোঝাতেও পারি না।
১৬ দিন পেরিয়ে গেল। আজ ১৭তম দিনে, গেমসের শেষ দিনে এবং দেশের বিমান ধরার ১৮ ঘণ্টা আগে সিদ্ধান্ত নিলাম একাই যাবো। পেলে পেলাম, না পেলে বিপরীত লাইন ধরে আবার চলে আসবো।
১২টার দিকে দুপুরের খাবার খেয়ে রওয়ানা দিলাম। লাইন-১ থেকে মেট্রোতে চেপে বসলাম। টিংয়ান রোড ২২টি স্টপেজের পর। মনে শঙ্কা, খালি হাতে ফিরে আসতে হবে কিনা। টিংয়ান রোডে যখন নামি তখন সময় দুপুর ১টা। ‘এক্সিট-ডি’ দিয়ে বের হয়ে একটু সামনে আগাতেই দেখি একটি রেস্টুরেন্টের সামনে একজন লোক টুপি পরে বসে আছেন।
তার কাছে গিয়ে ফোনিক্স মসজিদের কথা বলতে কিছুই বুঝলেন না। তখন হঠাৎ মনে পড়লো ওই সাংবাদিক আমাকে ফোনিক্স মসজিদের নাম চাইনিজ ভাষায় রেকর্ড করে দিয়েছিলেন। রেকর্ডিং ঘেটে সেটা বের করে তাকে শোনালাম। এবার তিনি লাফ দিয়ে উঠলেন বসা থেকে। আমাকে সঙ্গে নিয়ে মসজিদের গেটের ভেতরে দিয়ে আসলেন।
অবশ্য ‘ডি’ দিয়ে রাস্তায় উঠতেই মসজিদের মিনারটি আমি দেখেছিলাম। সামনে দেখি একজন মুসল্লি যাচ্ছেন। আমাকে দেখে তাড়া দিলেন। জামা’আত আসন্ন। তাকে অনুসরণ করে এগিয়ে গেলাম ভেতরের দিকে। জানতে চাইলেন অজু আছে কিনা। জানালাম ওজু, গোসল করে এসেছি। আমি গিয়ে দেখি বেশ কিছু মুসল্লি বসে আছেন। মুয়াজ্জিনকে সালাম দিয়ে বললাম ‘মুনজালাগো’। তিনি জানালেন, বাংলাদেশ। খুব খুশি হয়েছেন আমি আসায়।
আজান হলো। শেষ হতেই সবাই সুন্নত পড়তে লাগলেন। ১৫ দিন পেরিয়ে গেছে। তাই কসর বাদ দিয়ে আমিও সুন্নত পড়তে শুরু করলাম। সুন্নত শেষে ইকামত দিয়ে জামা’আত হলো। এরপর দুই রাকা’আত সুন্নত শেষে মোনাজাত। এবং মোনাজাত শেষে সবাই সবার সঙ্গে ‘মুসাফাহা’ (হাত মেলানো) করতে লাগলো। আমি সবার সঙ্গে হাত মেলালাম এবং সালাম দিয়ে বাংলাদেশের নাম বললাম। কেউ অবাক হচ্ছিলেন। কেউ খুশি হচ্ছিলেন। কেউ আলিঙ্গন করছিলেন।
তবে মুয়াজ্জিন বললেন, এখানকার কোনো ভিডিও করা যাবে না। ভিডিও করলেও সেটা ইন্টারনেটে ছাড়া যাবে না।
মসজিদে ঢোকার পর এক যুবকের পাশে বসেছিলাম। তিনি টুকটাক ভালোই ইংরেজি জানেন। ফরজ নামাজ শেষে তাকে বসতে বলেছিলাম কিছু সময়। তিনি দেখি বাইরে আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। তার কাছে জানতে চাইলাম নামাজের ভিডিও করিনি, মসজিদ ও মসজিদ প্রাঙ্গনের ভিডিও করলে কোনো সমস্যা আছে কি? তিনি প্রথমে ইতস্তত করলেও পরে বললেন, ভিডিও করতে পারেন।
তিনি আরও জানালেন, এখানে অনেকেই আসেন ট্যুরিস্ট স্পট হিসেবে। যেহেতু থাং ডাইনাস্টির (সাম্রাজ্যের) ৭৪৩ বছরের পুরনো মসজিদ। এটা অনেকের কাছেই এখনও আকর্ষণীয়। আপনি একজন বিদেশি হিসেবে এখানে আসতে পারেন এবং ভিডিও করতে পারেন।
এরপর তিনি ফ্রেমের পেছনে থেকে পুরো মসজিদ প্রাঙ্গণ আমাকে ঘুরিয়ে দেখালেন এবং সবকিছু বর্ণনা করলেন। আমি পুরো এলাকার ভিডিও ধারণ করলাম। এরপর তাকে নিয়ে মসজিদ প্রাঙ্গণ থেকে বের হলাম।
ভিডিও আসছে…