আগেভাগেই চলে এসেছেন চন্ডিকা হাথুরুসিংহে। স্থান ধর্মশালার প্রেস কনফারেন্স রুম। তখন ইংল্যান্ডের সেঞ্চুরিয়ান ডেভিড মালান কথা বলছিলেন। ইংলিশ মিডিয়ার পর বাংলাদেশি এক সাংবাদিক মাইক নিয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি কি মনে করেন বাংলাদেশ উইকেট পড়তে ভুল করেছে এবং এই উইকেটে টস নেওয়া উচিত হয়নি।’
প্রশ্নটা শুনে হাথুরুসিংহে খুঁজতে লাগলেন কে সে? প্রতিক্রিয়া দেখাননি। কেবল চেয়ে ছিলেন প্রশ্ন কর্তার দিকে। তবে ভালোভাবে যে প্রশ্নটা নেননি অবয়ব দেখে বোঝা যাচ্ছিল। মালান বেরিয়ে যাওয়ার পর মঞ্চে গিয়ে বসলেও তাকে খুব ভালো অবস্থায় দেখা যায়নি। কেননা একটু আগেই শিষ্যরা ম্যাচ হেরেছে ১৩৭ রানের বিশাল ব্যবধানে। স্বভাবতই ম্যাচ হারলে কারোই ভালো লাগে না। কিন্তু দলের অসহায় আত্মসমর্পন মানতে পারে না কেউ!
হাথুরুসিংহে অপেক্ষায় ছিলেন দলের ম্যানেজার রাবীদ ইমামের। মিডিয়া ম্যানেজার থেকে বিশ্বকাপে ম্যানেজার হিসেবে প্রমোশন পেয়েছেন তিনি। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচের দিন ছিল তার জন্মদিন। হাথুরুসিংহে এমন তথ্য গণমাধ্যমের থেকে শুনে ‘হ্যাপি বার্থডে’ বলে শুভেচ্ছা জানান। পরক্ষণে গোটা সংবাদ সম্মেলন কক্ষে তালি পরে আর হ্যাপি বার্থডের জোয়ার ওঠে। পরিস্থিতি বাংলাদেশের অনুকূলে ছিল না। কিন্তু ওই খানিকক্ষণের জন্য মনে হচ্ছিল পরিবেশ বেশ শান্ত।
হাথুরুসিংহের কোর্টে একের পর এক প্রশ্ন যাচ্ছিল। সব উত্তরও দিচ্ছিলেন। ওই বাংলাদেশি সাংবাদিক এবার হাথুরুসিংহকেও একই প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি কি মনে করেন বাংলাদেশ উইকেট পড়তে ভুল করেছে এবং এই উইকেটে টস নেওয়া উচিত হয়নি।’ সঙ্গে একটি লেজ লাগিয়ে দিলেন, ‘কাল তো দেখেছি শ্রীধরণ শ্রীরাম উইকেট নিয়ে চুলচেঁড়া বিশ্লেষণ করছেন। তার কাজটা কি কেবল উইকেটই মূল্যায়ন।’
এই প্রশ্নের পেছনের একটা ঘটনাও আছে। বিশ্বকাপ খেলতে যাওয়ার আগে সাকিব এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘শ্রীরাম ভারতীয় বলে উইকেটের মূল্যায়নে সহজ হবে। এছাড়া সব কিউরেটরের সঙ্গে যোগাযোগটাও ভালো হবে।’
কিন্তু ইংল্যান্ডের বিপক্ষে বাংলাদেশ টস জিতে বোলিং নিয়ে একদমই ভালো করেনি। বাংলাদেশ যেখানে বাড়তি একজন স্পিনার নিয়ে খেলেছে। সেখানে ইংল্যান্ড মঈন আলীকে বিশ্রাম দিয়ে নিয়েছিল টপলিকে। যিনি ৪ উইকেট নিয়ে বাংলাদেশকে করেছেন ‘টপলেস।’ হাথুরুসিংহে নিজের সিদ্ধান্তকে যথার্থ প্রমাণ করার জন্য ব্যাখা দিলেন, ‘আমি মনে করি না আমরা বোলিং নিয়ে ভুল করেছি। কারণ উইকেটে কিছু না কিছু ছিল। সকাল সাড়ে দশটায় খেলা শুরু। আগের রাতে বৃষ্টি ছিল। তাতে মনে হয়েছে উইকেটে কিছু না কিছু ছিল।’
আর লেজের প্রশ্নের উত্তরে একটু রগচটা হয়েই বললেন, ‘শ্রীরাম আমাদের পরামর্শক হিসেবে কাজ করছেন। শেষ বিশ্বকাপে সে আমাদের সঙ্গে ছিলেন (টি-টোয়েন্টি)। তার ভূমিকা অনেক বড়। শুধুমাত্র উইকেট মূল্যায়নই নয়।’
ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচের আগে বাংলাদেশের কোচ তিন তিনবার উইকেট পর্যবেক্ষণ করেন। প্রথমে সাকিব আল হাসানকে নিয়ে। পরে শ্রীধরণ শ্রীরাম। ও সবশেষে মাহেদী হাসানকে নিয়ে। অফস্পিনার ৪ উইকেট নিয়ে বাংলাদেশের মান কিছুটা রেখেছেন। কিন্তু বাংলাদেশের বোলিং ছিল একেবারেই হতশ্রী। তাসকিন সরাসরিই বলেছেন, তাদের বোলিং ভালো হয়নি।’
প্রশ্ন উঠছে, ড্রেসিংরুমে এতো ‘মাথার’ বুদ্ধিতেও কাজ কেন হলো না? দলের প্রধান কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে। পরামর্শক শ্রীধরণ শ্রীরাম। আর দলের টিম ডিরেক্টর খালেদ মাহমুদ সুজন, যিনি বাংলাদেশ দলের ভারপ্রাপ্ত কোচের ভূমিকাতেও কাজ করেছেন। ত্রয়ীর পৃথক ভূমিকা কি? কিভাবে চলে কাজ? কার কাজের বিবরণী কী?
সেসব নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চাইলে হাথুরুসিংহে খুব একটা আগ্রহ দেখালেন না। বরং বুঝিয়ে দিতে চাইলেন প্রত্যেকের জন্য মঞ্চ উন্মুক্ত। চাইলে যে কেউই দলের জন্য ভালো এমন পরামর্শ দিতে পারবেন, ‘এখানে নির্দিষ্ট কারো কোনো ভূমিকা নেই। প্রত্যেকে দলের জন্য অবদান রাখার চেষ্টা করে এবং তাদেরকে ফ্রি করে দেওয়া হয়েছে। আমি সেটায় কোনো সমস্যা দেখি না।’
অথচ হাথুরুসিংহে নিজের প্রথম মেয়াদে কোচ থাকাকালীন কারও কথাই শুনতেন না। নিজের যা সিদ্ধান্ত সেটাই নিতেন। নিজের যা ভাবনা সেটাই অন্যদের চাপিয়ে দিতেন। অধিনায়কদের সিদ্ধান্তকেও খুব একটা গ্রাহ্য করতেন না। কিন্তু সেই সময় পেরিয়েছে। দিন বদলেছে। হাথুরুসিংহে এখন টিম ম্যান! তাইতো তিন মাথার সম্মিলিত অবদানে কাজ করতে কোনো আপত্তি দেখেন না, ‘টিম ম্যানেজমেন্ট খুব ভালোভাবেই চলছে। দলে একজন ম্যানেজার আছে বা তাকে হেড অব ডেলিগেশন বলতে পারেন। শ্রীরাম পরামর্শক এবং আমি হেড কোচ। যেভাবে আমরা কাজ করছি তাতে আমি খুশি। কোনো ইস্যু নেই।’
বৈশ্বিক ক্রিকেট মানে কেবল ব্যাট-বলের যুদ্ধ নয় বরং মাঠ ও মাঠের বাইরে ক্রিকেটটাকে ছড়িয়ে দেওয়া। যেখানে বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের আড়াল রাখার এক প্রয়াস চলছে! টুর্নামেন্ট শুরুর আগে ক্রিকেটারদের জন্য অলিখিত নিয়ম যেন বানিয়ে দেন টিম ম্যানেজমেন্ট। গণমাধ্যমের সামনে কথা নয়! এর ব্যাখ্যায় টিম ডিরেক্টর খালেদ মাহমুদ বলেছিলেন, ‘মনোযোগটা ক্রিকেটেই থাকুক। তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি ম্যাচের আগে একজনই কথা বলুক।’
সেই একজন আবার ক্রিকেটার হবে কিনা সেই নিশ্চয়তা নয়, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচের আগে হাজির স্পিন কোচ রঙ্গনা হেরাথ। অথচ ইংল্যান্ডের হয়ে এসেছিলেন অধিনায়ক জস বাটলার। ম্যাচের পর বাংলাদেশের প্রতিনিধি হাথুরুহিংহে। ইংল্যান্ডের ম্যাচ সেরা মালান। বিশ্বকাপে দেখা মিলে মিক্স জোনের। যেখানে খোলামেলা আলোচনা হয়। বাধ্যতামূলক সেই জায়গাতে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছেন কেবল তাসকিন। ইংল্যান্ডের হয়ে স্যাম কুরান ও টপলি। ক্রিকেটারদের এই বিশ্বকাপ উৎসবে শামিল হতে না দেওয়া রীতিমত বিস্ময়কর। মনোযোগ ধরে রাখার নামে তাদের যে উৎসব থেকে আড়াল করার প্রয়াস চলছে, তা তো বাড়তি চাপে ফেলছে তাদেরও। সেটা বুঝবে কবে টিম ম্যানেজমেন্ট?
হাথুরুসিংহকে এই প্রশ্নটাও করা হয়েছিল? উত্তরটা দিতে পারেননি কোচ। কেবল চেয়েছিলেন ম্যানেজারের দিকে! বিব্রত না হয়ে হাসিমুখে পাশ কাটিয়ে যান তিনিও!