চারদিকে বিশ্বকাপ ক্রিকেট উন্মাদনা। ভারতের মটিতে অনুষ্ঠিত হচ্ছে ওয়ানডে বিশ্বকাপের ত্রয়োদশ আসর। বিশ্বকাপের পূর্বের আসরগুলোর দিকে তাকালে ব্যাট-বলের লড়াইয়ের ফাঁকে ফাঁকে এসে ভীড় করে অসংখ্য ঘটনা। তার মধ্যে ঐতিহাসিক, রোমহর্ষক, কিংবা হৃদয়বিদারক কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা তুলে ধরা হলো।
সমালোচিত বৃষ্টি আইন দীর্ঘ দুই যুগেরও বেশি সময় নির্বাসিত থাকার পর ১৯৯২ বিশ্বকাপ দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফিরেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। সেই আসরে দাপুটে ক্রিকেট খেলে শেষ চারেও পৌঁছে যায় প্রোটিয়ারা। সেমিফাইনালে তাদের প্রতিপক্ষ ছিল ইংল্যান্ড। ম্যাচের শুরুতেই এক দফা বৃষ্টি। কেটে নেওয়া হয় ৫ ওভার। ফলে প্রথমে ব্যাট করা ইংল্যান্ডের রান দাঁড়ায় ৪৫ ওভারে ২৫২। জবাব দিতে নেমে ভালোই এগোচ্ছিল প্রোটিয়ারা। কিন্তু ৬ উইকেটে ২০৬ রান তুলতেই শুরু হয় তুমুল বর্ষণ।
বৃষ্টি থামার পর জয়ের জন্য দক্ষিণ আফ্রিকার সামনে লক্ষ্য দেয়া হয় ৫ ওভারে ৪৭। হাতে তখনো ৪ উইকেট। বৃষ্টির পর নেমেই ব্যাট হাতে ঝড় তোলেন ব্রায়ান ম্যাকমিলান ও ডেভ রিচার্ডসন। তাতে একপর্যায়ে সমীকরণ দাঁড়ায় ১৩ বলে ২২। ঠিক তখনি ৪৩তম ওভারে তৃতীয় দফায় বৃষ্টির হানা।
তৃতীয় দফায় বৃষ্টি হয় ১২ মিনিট। এই ১২ মিনিটের জন্য অদ্ভূত এক আইনে কেটে নেওয়া হয় ১২ বল। ‘মোস্ট প্রোডাক্টিভ ওভার মেথড’ নামক সেই বিতর্কিত আইনে প্রোটিয়াদের সামনে লক্ষ্য দাঁড়ায় ১ বলে ২২ রান। অকল্পনীয়, অবাস্তব ও অসম্ভব লক্ষ্য নিয়েই শেষ হয় প্রোটিয়াদের বিশ্বকাপ।
ভারত-শ্রীলঙ্কা সেমিফাইনালে দাঙ্গা ১৯৯৬ বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল। ইডেন গার্ডেনসে মুখোমুখি ভারত-শ্রীলঙ্কা। প্রথমে ব্যাট করে ২৫১ রান সংগ্রহ করে শ্রীলঙ্কা। ভারতের সামনে লক্ষ্য দাঁড়ায় ২৫২। ব্যাটিং করতে নেমে লঙ্কান বোলিংয়ের সামনে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে ভারতের ব্যাটিং লাইনআপ। ৩৪ ওভারে রান সবে ১২০, এর মধ্যেই ৮ ব্যাটসম্যান প্যাভিলিয়নে!
ব্যাপারটা হজম করতে পারলেন না ভারতীয় সমর্থকরা। শুরু করেন বোতল ছোঁড়া! বৃষ্টির মতো অবিরাম বোতল নিক্ষেপ করে যাচ্ছিলেন তারা। বোতল বৃষ্টির মাঝেই পুরো স্টেডিয়ামের নানা জায়গায় আগুন ধরিয়ে দেয় ক্ষুব্ধ ভারতীয়রা। অবস্থা বেগতিক দেখে ১৫ মিনিট খেলা বন্ধ রাখা হয়।
কিন্তু ততক্ষণে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে। সামাল দিতে না পেরে সেদিন খেলা বাতিল করতে বাধ্য হয় ক্রিকেট কমিটি এবং শ্রীলঙ্কাকে বিজয়ী হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়। পরবর্তীতে অর্জুন রানাতুঙ্গার নেতৃত্বে সেবার চ্যাম্পিয়ন হয় শ্রীলঙ্কা।
অ্যালান ডোনাল্ডের রানআউটে দক্ষিণ আফ্রিকার স্বপ্নভঙ্গ ১৯৯৯ বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল। দক্ষিণ আফ্রিকার সামনে ২১৪ রানের লক্ষ্য ছুঁড়ে দিয়েছে অস্ট্রেলিয়া। বেশ ভালোভাবেই লক্ষ্য পার হবার দিকে ছিল প্রোটিয়ারা। জয়ের জন্য শেষ ৬ বলে দরকার ছিল ৯ রান, হাতে ১ উইকেট।
ডেমিয়েন ফ্লেমিংইয়ের পরপর দুই বলে দৃষ্টিনন্দন দুটি বাউন্ডারি হাঁকান ল্যান্স ক্লুজনার। এখন শুধু আনুষ্ঠানিকতা বাকি। ৪ বলে দরকার ১, একটা সিঙ্গেল। তৃতীয় বলটা মিড অনে ঠেলে দিলেন ক্লুজনার, বল সরাসরি ড্যারেন লেহম্যানের হাতে।
চতুর্থ ডেলিভারিটা মিড অনে ঠেলে দিয়েই দৌড় দিলেন ক্লুজনার কিন্তু বল ধরে ফেললেন স্টিভ ওয়াহ। সেদিকে খেয়াল না করেই ছুটলেন ক্লুজনার। মাঝমাঠে আসার পর ডাক দিলেন ডোনাল্ডকে। হতভম্ব ডোনাল্ড কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলেন। যেহেতু দৌড়াতে হবে তাই দৌড়ও দিলেন। ততক্ষণে অবশ্য সব শেষ। রানআউটে স্বপ্নের ফাইনাল এখানেই শেষ।
পাকিস্তানকে হারিয়ে বিশ্বকাপে বাংলাদেশের প্রথম জয় ১৯৯৯ সালে ক্রিকেট বিশ্বকাপের প্রথম আসর বসেছিল ইংল্যান্ডে। সেই আসরে প্রথমবারের মতো অংশগ্রহণের সুযোগ পায় বাংলাদেশ। প্রথমবার অংশ নিয়েই পাকিস্তানের বিপক্ষে ৬২ রানের দুর্দান্ত জয় তুলে নেয় বাংলাদেশ। সেই জয় আজও এদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে স্মরণীয়।
ম্যাচে নির্ধারিত ৫০ ওভারে ৯ উইকেট হারিয়ে ২২৩ রানের লড়াকু পুঁজি পায় বাংলাদেশ। ২২৩ রানের জবাব দিতে নেমে ৩ উইকেট নিয়ে পাকিস্তানের ব্যাটিং লাইনকে ধসিয়ে দেন খালেদ মাহমুদ সুজন। তার সঙ্গে হাত মিলিয়ে ১টি করে উইকেট নেন শফিউদ্দিন বাবু, মোহাম্মাদ রফিক, মিনহাজুল আবেদিন নান্নু এবং নাঈমুর রহমান দুর্জয়।
শেন ওয়ার্নের নিষেধাজ্ঞা ওয়ানডে বিশ্বকাপের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে হাস্যকর ঘটনা হলো অস্ট্রেলিয়ার কিংবদন্তি লেগ স্পিনার শেন ওয়ার্নেও নিষেধাজ্ঞা। ২০০৩ বিশ্বকাপে টুর্নামেন্ট শুরুর একদিন আগে ডোপ টেস্টে ধরা পড়েন ওয়ার্ন। যে কারণে তাকে টুর্নামেন্ট থেকে বহিষ্কার করে আইসিসি।
তবে প্রতিক্রিয়ায় ওয়ার্ন যা বলেছিলেন, তা আজও সর্বমহলে হাস্যরসের খোরাক হয়ে আছে। ওয়ার্নেও ভাষ্য ছিল, কোনো ড্রাগ তিনি নেননি। নিজেকে সুশ্রী করে তুলতে মায়ের দেওয়া একটি ডাই-ইউরেটিক ওষুধ কেবল খেয়েছিলেন। কিন্তু তাতে যে ডোপ পজিটিভ উপাদান ছিল, সেটা তিনি নিজেও নাকি জানতেন না।
অন্ধকারে নিমজ্জিত ফাইনাল ২০০৭ বিশ্বকাপে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ছিল পাকিস্তান কোচ বব উলমারের মৃত্যু। তবে সেই ঘটনা ছাপিয়ে গিয়েছিল অন্ধকারে নিমজ্জিত ফাইনাল। সেবার ওয়েস্ট ইন্ডিজে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ ফাইনাল মুখোমুখি হয় অস্ট্রেলিয়া ও শ্রীলঙ্কা। মজার ব্যাপার হলো, ফাইনালের ভেন্যু বার্বাডোসের কেনিংস্টন ওভালে ছিল না কোনো ফ্লাডলাইট!
ম্যাচে প্রথমে ব্যাট করে ৩৮ ওভারে ২৮১ রানের বিশাল সংগ্রহ পায় অস্ট্রেলিয়া। তবে বিপত্তি ঘটে খেলার দ্বিতীয় ইনিংসে। শ্রীলঙ্কা ব্যাটিং করার সময়ে পুরো আকাশ অন্ধকারচ্ছন্ন হয়ে যায়। তাতে শ্রীলঙ্কান খেলোয়াড়রা ঠিকঠাক বল চোখে দেখতে পারছিলেন না। একের পর এক উইকেট হারাচ্ছিল লঙ্কানরা।
এমন অবস্থায় ৩৬তম ওভারে খেলা থামিয়ে ডিএল পদ্ধতিতে অস্ট্রেলিয়াকে ৫৩ রানে জয়ী ঘোষণা করা হয়। এই ঘটনার জন্য তীব্র সমালোচনার মুখে পড়তে হয় আইসিসিকে। ঘটনার দায়ে শাস্তিস্বরূপ পরবর্তী বছরের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে সেদিনকার ফাইনালের তিন আম্পায়ার স্টিভ বাকনার, আলিম দার ও বিলি বাউডেনকে টুর্নামেন্ট থেকে বহিষ্কার করা হয়।
পাকিস্তান কোচ বব উলমারের মৃত্যু ২০০৭ বিশ্বকাপের আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো, পাকিস্তান কোচ বব উলমারের মৃত্যু। ১৮ মার্চ ২০০৭ সাল। জ্যামাইকার প্লেগাসাস হোটেলে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায় তাকে। সেই আসরে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে হেরে গ্রুপ পর্ব থেকেই বাদ পড়ে পাকিস্তান। লজ্জাজনক পরাজয়ের রাতেই হোটেলের রুমে পাওয়া যায় উলমারের লাশ। কে বা কারা এ ঘটনার জন্যে দায়ী বা কিভাবে এই মৃত্যু; আজও তার কোনো কূল-কিনারা হয়নি। এই ঘটনা বিশ্বকাপের ইতিহাসে ‘কালো অধ্যায়’ হিসেবেই গেঁথে আছে।
বিশ্বকাপ ট্রফি বিতর্ক আগের আসরগুলোর ধারাবাহিকতায় বিশ্বকাপের ২০১০ সালের আসরেও পিছু ছাড়েনি বিতর্ক। দীর্ঘ ২৮ বছর অপেক্ষার পর ২০১১ বিশ্বকাপে শিরোপা উচিয়ে ধরে ভারত। কিন্তু ট্রফি নিয়ে শুরু হয় বিতর্ক। কয়েকটি গণমাধ্যমের রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতকে সেবার ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল ট্রফির একটি রেপ্লিকা।
জানা যায়, আসল শিরোপাটি সরকারের গোডাউনে রাখা ছিল। শ্রীলঙ্কা বনাম নিউ জিল্যান্ড সেমিফাইনালের পর ট্রফিটি কলম্বো থেকে মুম্বাই আসার পর সেটি মুম্বাই কাস্টমস অফিস রেখে দেয়। সেখান থেকে চলে যায় সরকারী গোডাউনে।
এই ব্যাপারটা অন্যভাবেও ধরা পড়ে। আইসিসির আসল ট্রফির নিচের বেসমেন্টে প্রতি আসরের জয়ীদের নাম খোদাই করা থাকে। কিন্তু ভারতকে দেওয়া ট্রফিতে সেই বেসমেন্ট ছিল সম্পূর্ণ ফাঁকা। যার ফলে ট্রফি বিতর্ক নিয়ে শেষ হয় আসর।