ক্যাম্পাস

ঢাবির মল চত্বরের সৌন্দর্য নিয়ে শিক্ষার্থীদের ভাবনা

প্রাচ্যের অক্সফোর্ড ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যেন একাধিক চত্বরের মিলন মেলা। কোনো স্থান থেকে একটু সামনে গেলেই একেক চত্বর। ভিসি চত্বর, হাফিজ চত্বর, সমাজবিজ্ঞান চত্বর, ভাবনা চত্বর, ইত্যাদি চত্বরে ভর্তি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

প্রতিটি চত্বরের রয়েছে একটি ইতিহাস। তবে সৌন্দর্য ও আয়তনের বিচারে সবচেয়ে বড় বোধ হয় মল চত্বর। গাছপালা ও এক ফালি সবুজ মাঠের সমন্বয়ে এক অসামান্য সৌন্দর্যের ধারক।

এ জায়গাটির এরূপ নামকরনের প্রকৃত সত্য হলো, ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ সাবেক ফরাসী সংস্কৃতি মন্ত্রী আন্দ্রে মারলোর সম্মানার্থে ঢাবিতে একটি চত্বরের নামকরণ করা হয়। নাম ছিল মারলো চত্বর। এটিই বিকৃত হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘মল’ নামে। হয়তো শিক্ষার্থীদের অনেকে জানেই না, এটি একজন সম্মানিত ব্যক্তির নাম ছিল। মহান ব্যক্তির স্মরণে ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদ চত্বরে মালরো বাগান নামে একটি বাগানের নামকরণ করা হয়েছে। এটিই বর্তমান মল চত্বর।

তবে শতবর্ষের ম্যুরাল, বঙ্গবন্ধুর পূর্ণ ভাস্কর্য স্থাপন ও সৌন্দর্য বর্ধনের নির্মাণযজ্ঞও চলমান থাকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইকনিক এই মল চত্বরের সৌন্দর্যে পড়েছে ভাটা। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য হয়েছে বিদূরিত। বিষয়টি নিয়ে ঢাবি শিক্ষার্থীরা নানা মন্তব্য করেছেন।

রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী হাসান আল নোমান বলেন, অবশ্যই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মল চত্বর অধিক সুন্দর। ইট পাথরে বেষ্টিত এই যান্ত্রিক ঢাকা শহরে আমরা গাছের ছায়ায় বসে আড্ডা দেওয়ার মত একটা জায়গা বা পাখিদের কলরব শোনার মত পরিবেশের অস্তিত্ব খুজিফিরি। যা একমাত্র ‘প্রাকৃতিক ঢাকা’তেই সম্ভব।

বর্তমানে মল চত্বরে শতবর্ষের ম্যুরাল, বঙ্গবন্ধুর পূর্ণ ভাস্কর্য স্থাপন ও সৌন্দর্য বর্ধনের নির্মাণযজ্ঞ চলছে

তিনি বলেন, শতবর্ষের মুরাল স্থাপনকে সমর্থন করি। কিন্তু আমাদের চিরচারিত মল চত্বর ধ্বংস করে নয়। বরং আমাদের শতবর্ষ হোক প্রকৃতিকে ঘিরে। আমরা প্রকৃতির মানুষ, প্রকৃতিতেই হারাতে চাই। গাছপালা কেটে যান্ত্রিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমরা চাই না। বরং শতবর্ষের মল চত্বরের মুরাল হোক আরও ১০০ টা নতুন গাছ লাগিয়ে।

আইন বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী পাভেল আহমেদ বলেন, মুলত শতবর্ষী ম্যুরাল ও ভাষ্কর্যের নির্মাণযজ্ঞ প্রকৃতি ধ্বংস করছে। প্রাকৃতিক সৌন্দির্য যা ছিল সেটা আমার কাছে স্বর্গীয় মনে হয়েছে।

ইতিহাস বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী আরিফুজ্জামান বাবু জানান, অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তুলনা করলে ঢাবির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এমনিতেই কম। এখানে চবি, জাবি, রাবি'র মত প্রকৃতির খেলা নেই। বলার মত একটাই জায়গা ছিল, সেটি এই মল চত্বর। এখন শতবর্ষের ম্যুরাল স্থাপন ও ভাস্কর্য স্থাপনের কর্মযজ্ঞে সেটিও নষ্ট হয়ে গেছে। এত বিরাট জায়গা নিয়ে শতবর্ষের ম্যুরাল স্থাপন ও ভাস্কর্য স্থাপন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের প্রয়োজন ছিল না।

দ্বিতীয় বর্ষের কম্পিউটার সাইন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী তালহা জুবায়ের সিয়াম বলেন, ক্যাম্পাসের এই একটাই জায়গা ছিল নিখাদ প্রাকৃতিক। অন্য জায়গাগুলোতে আছে শুধু কংক্রিটের অস্তিত্ব। আমরা এখানে বাসের জন্য দাঁড়িয়ে থাকতাম, আড্ডা দিতাম। শীতের বিকেলগুলোতে অন্যরকম একটা ভালো লাগতো। গাছের পাতা ঝরে পড়তো। দেখতে অসাধারণ ছিল। আর্টিফিশিয়াল সৌন্দর্য এগুলোর উপরে যেতে পারবে না। যতই হোক, কংক্রিট কতই বা সৌন্দর্য দেবে। তাছাড়া গাছের শিকড় কেটে ফেলা হচ্ছে। টিএসসির মতো গাছ পড়ে হতাহতের ঘটনাও ঘটতে পারে।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ শাহিনুর রহমান জানান, সৌন্দর্য বাড়াবে কৃত্রিম সৌন্দর্যের মল চত্বর। সমস্যা টা সৌন্দর্যে না, অন্য জায়গায়। ওইসব সমস্যা নিয়ে কেউ কথা বলে না । যেমন- আবাসন সংকট, ক্লাসরুম সংকট, লাইব্রেরিতে সিট সংকট বাস আরও বৃদ্ধি। এসব মুখ্য সমস্যার সমাধান না করে ম্যুরাল স্থাপনের মত একটি গৌণ বিষয় নিয়ে পড়ে আছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ; যা আসলেই বিব্রতকর।

উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ ডিপার্টমেন্টের শিক্ষার্থী তাওহীদা দোলা বলেন, ‘আমার মনে হয় না এটা সৌন্দর্য বৃদ্ধি করবে। প্রকৃতির থেকে সুন্দর আর শান্তির অন্যকিছু হতে পারে না। কৃত্রিম যাই  তৈরি করুক না কেন, সারাদিন ক্লাস শেষে প্রকৃতির মাঝে আড্ডা দেয়ার যে অনুভূতি, সেটা কেউ কৃত্রিমতার মাঝে পাবে না

সবশেষ সকলের আশা কৃত্রিম হোক কিংবা প্রাকৃতিক, মল চত্তর হয়ে উঠবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সৌন্দর্যের অন্যতম অনুষঙ্গ।