গাজীপুরের শ্রীপুরে নবজাতকের বিনিময়ে হাসপাতালের সিজারিয়ান অপারেশনের বিল পরিশোধ করা মা শিরিন আক্তারের (২০) কোলে তার সন্তানকে ফিরিয়ে দিয়েছেন এক ব্যবসায়ী। শনিবার (৪ নভেম্বর) দুপুর ১২টার দিকে উপজেলার গাজীপুর ইউনিয়নের ফরিদপুর গ্রামে গিয়ে ওই সন্তানকে তার মায়ের কোলে ফিরিয়ে দেন ব্যবসায়ী এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তরিকুল ইসলাম।
এদিকে, সন্তানকে পেয়ে যেন খুঁশির বাঁধ ভেঙেছে মা শিরিন আক্তারের। জন্মের তিন দিন পর শিশুকে হারিয়ে তার বুকে যে শূন্যতা ছিল তা দূর হয়েছে এখন। এছাড়া শিশুটির নানাকে একটি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা কিনে দেওয়ারও ঘোষণা দিয়েছেন ব্যবসায়ী আকরাম হোসেন বাদশা। তিনি গাজীপুর-৩ আসনের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন সবুজের বড় ভাই।
আরও পড়ুন: হাসপাতালের বিলের বিনিময়ে নবজাতক দিয়ে দিলেন নানা
গত ২৮ অক্টোবর পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল রাইজিংবিডিতে ‘হাসপাতালের বিলের বিনিময়ে নবজাতক দিয়ে দিলেন নানা' শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। সংবাদটি ব্যবসায়ী আকরাম হোসেন ও শ্রীপুর উপজেলা প্রশাসনের নজরে আসে। বিষয়টি জানার পর ওই নবজাতককে মায়ের কোলে ফিরিয়ে দিতে উদ্যোগ নেন তারা।
নবজাতকের মা শিরিন আক্তারের বাড়ি মূলত ময়মনসিংহ জেলার হালুয়াঘাট থানার মনিকুরা গ্রামে। তিনি মা-বাবার সঙ্গে শ্রীপুরের ফরিদপুর গ্রামের একটি বাসায় ভাড়া থাকেন। শিরিন আক্তারের দেড় বছর বয়সী আরও একটি ছেলে সন্তান রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওই নবজাতককে ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জের মধুপুর এলাকার এক দম্পতি দত্তক নিয়েছিলেন। পরে শ্রীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তরিকুল ইসলাম ও ব্যবসায়ী আকরাম হোসেনের উদ্যোগে উপজেলার গাজীপুর ইউনিয়ন পরিষদের ৫ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য ইসমাইল হোসেন গত বৃহস্পতিবার রাতে ময়মনসিংহে গিয়ে ওই পরিবারকে বুঝিয়ে মা শিরিন আক্তারের কোলে ফিরিয়ে দেন তার শিশুকে। দত্তক নেওয়া পরিবারটির অসহায়ত্বের কথা বিবেচনা করে এ সময় হাসপাতালের বিল হিসেবে পরিশোধ করা টাকাও ওই পরিবারের কাছে তুলে দেওয়া হয়।
শিরিন আক্তার বলেন, ১০ মাস সন্তানকে পেটে ধারণ করেছি। অভাবের কারণে তাকে হারাতে হয়েছিল। তাকে ছাড়া এক মুহূর্তও বেঁচে থাকার আশা ছিল না। সারাক্ষণ কান্নাকাটি করতাম, রাতে ঘুমের মধ্যেও সন্তানকে দেখতাম। গত কয়েকটি দিন আমার কাছে খুব যন্ত্রণার ছিল। ছেলেকে কাছে পেয়ে মনে হচ্ছে আজ যেন নতুন জীবন পেয়েছি। নিজের জীবন থাকতে আমি আর কখনো সন্তানকে দূরে যেতে দেব না। সন্তানকে ফিরে পেয়ে তিনি ব্যবসায়ী ও উপজেলা প্রশাসনের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
শিরিনের বাবা সিরাজুল ইসলাম জানান, শিরিন আক্তারের স্বামী আরিফুল ইসলাম বিভিন্ন পরিবহনে সহকারী (হেলপার) হিসেবে কাজ করেন। তিনি মাদকাসক্ত। বিভিন্ন সময় মাদক ছাড়তে অনুরোধ করার পরও আরিফুল মাদক ছাড়ছিল না। ৪/৫ মাস আগে তার সঙ্গে পরিবারের দূরত্ব তৈরি হয়। এরপর থেকে আরিফুলের সঙ্গে আমাদের কোনো যোগাযোগ নেই।
তিনি আরও জানান, গত ১৬ অক্টোবর সন্তান সম্ভবা শিরিন আক্তারকে ময়মনসিংহের চরপাড়া এলাকার স্বাধীন নার্সিং হোমে ভর্তি করান তিনি। সেখানে সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে ছেলে সন্তানের জন্ম দেন শিরিন আক্তার। পরে হাসাপাতালের বিল পরিশোধ করতে না পেরে শিশুটিকে স্থানীয় আল-আমিনের মাধ্যমে ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জের এক নিঃসন্তান দম্পতির কাছে দত্তক দিয়ে দেন। দত্তক নেওয়া পরিবারটি তখন আল-আমিনের মাধ্যমে হাসপাতালের বিল পরিশোধ করে শিশুটিকে হাসপাতাল থেকে নিয়ে যায়।
ইউপি সদস্য ইসমাইল হোসেন বলেন, এমন অমানবিক কাজটি প্রথমে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ী আকরাম হোসেন আমাকে জানান। আমি সঙ্গে সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের ডেকে বিষয়টি মীমাংসা করে নবজাতককে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করি। কিন্তু তারা বিষয়টি কর্ণপাত না করায় আমি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ী আকরাম হোসেনকে জানাই। তাদের চেষ্টায় দুটি পরিবারের সঙ্গে সমন্বয় করে ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ থেকে শিশুটিকে উদ্ধার করে মায়ের কোলে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। সে সময় হাসপাতালের বিলের টাকা ওই দত্তক পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে।
ব্যবসায়ী আকরাম হোসেন বাদশা বলেন, আধুনিকতার চূড়ান্ত শিখরে এসেও এরকম বর্বরতার যে বাস্তব সাক্ষী হব সেটা কখনো ভাবিনি। বর্তমান সমাজে এখনো নবজাতককে দত্তক দিয়ে হাসপাতালের বিল পরিশোধ করতে হয়! আমি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধিসহ সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করি। পরবর্তীতে কিছু দিনের চেষ্টার পর আলোচনা করে হাসপাতালের বিলসহ যাবতীয় খরচ বহন করে নবজাতককে তার মায়ের কোলে ফেরত দিতে সক্ষম হয়েছি। আমি আমার দায়িত্ববোধ থেকেই কাজটি করেছি। পাশাপাশি ওই নবজাতকে নিয়ে যেন পরিবাররটি চলতে পারে সেজন্য শিশুটির নানাকে একটি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা কিনে দেওয়া হবে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তরিকুল ইসলাম বলেন, একটি শিশু জন্মের পর নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তার মায়ের কোলে থাকা তার অধিকার। তবে পরিবারটির অসহায়ত্বের জন্য এ শিশুকে অন্যের কোলে তুলে দিয়েছিল। আমাদের নজরে আসার পর আমরা উদ্যোগী হয়ে শিশুকে তার মায়ের কোলে ফিরিয়ে দিয়েছি। আমাদের চাওয়া ছিল শিশুর অধিকার নিশ্চিত করা। আমরা সমন্বিতভাবে সেই চেষ্টা করেছি।