লক্ষ্য ছিল সেমিফাইনালে খেলার। সেই আশাতেই বুক বাঁধা। কিন্তু সময় যত গড়ায় সেই লক্ষ্য থেকে দূরত্ব বাড়তে শুরু করে। এক পর্যায়ে লড়াইটা হয়ে উঠে নিজেদের অস্বস্তি টেকানোর। বিশ্বকাপে সবচেয়ে বাজে পারফরম্যান্সের অপবাদ থেকে মুক্তির। সঙ্গে যোগ হয় চ্যাম্পিয়নস ট্রফির টিকিট নিশ্চিতের। শেষটায় নিজেদের কাজ করে রাখলেও প্রথমটা থেকে নিজেদের এড়াতে পারেনি বাংলাদেশ।
২০০৩ ওয়ানডে বিশ্বকাপের পর পঞ্চাশ ওভারের এই বৈশ্বিক আসরে সবচেয়ে বাজে সময় কাটালো বাংলাদেশ। সেবার ছয় ম্যাচের পাঁচটিতেই হার। পরের চার বিশ্বকাপে জয় তিনটি করে। তাতে সন্তুষ্ট হওয়ার ছিল যে ছোট-বড় অঘটন ঘটিয়ে বিশ্বকে বার্তা দেওয়া, আমরা সঠিক পথেই আছি। কিন্তু ২০২৩-এ এসে পাল্টে গেল সব হিসেব-নিকেশ।
নিজেদের ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা ফল আসবে বলেই আশা দেখিয়েছিল বাংলাদেশ। কিন্তু মাঠের ক্রিকেটে ছন্নছাড়া পারফরম্যান্সে নয় ম্যাচে কেবল দুই জয় নিয়ে ভরাডুবির বিশ্বকাপের সফর শেষ করলো। শনিবার পুনের মহারাষ্ট্র ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন স্টেডিয়ামে অস্ট্রেলিয়া বাংলাদেশকে ৮ উইকেটে হারিয়ে কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দিয়েছে।
১৯৯৯ বিশ্বকাপ থেকে এ পর্যন্ত সাতটি বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সাফল্য কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠা। সেটি ২০১৫ বিশ্বকাপে। এছাড়া এক বিশ্বকাপে তিনটি ম্যাচ জেতাই বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সাফল্য। সেই তিনের গেরো ছুটাতে চেয়েছিলেন সাকিব আল হাসান। বাংলাদেশের অধিনায়ক আবার বিশ্বকাপের আসরে তিন জয়কে খুব বড় করে দেখেন না। কিন্তু এবার তারই দল বিশ্বকাপে হেরেছে সাত ম্যাচ।
২০০৩ সালের পর সবচেয়ে বড় ধাক্কা খেল এবারের আসরেই। বিশ্বকাপে নিজেদের সর্বোচ্চ ৩০৬ রান করেছিল বাংলাদেশ। কিন্তু পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের হারাতে এই রানের পুঁজি যথেষ্ট ছিল না। ধারহীন বোলিংয়ে অস্ট্রেলিয়া ম্যাচ জিতেছে ৩২ বল আগে, ৮ উইকেট হাতে রেখে।
যে ব্যাটিং নিয়ে দুর্ভাবনা ছিল টুর্নামেন্ট জুড়ে শেষ ম্যাচে এসেও একই চিত্র। নেই কোনো সেঞ্চুরি। নেই বিস্ফোরক কোনো ইনিংস। বরং ছন্দ পাওয়ার পরও বড় রান আসে না ব্যাটসম্যানদের ব্যাটে। দুটি রান আউট বুঝিয়ে দেয় বোঝাপড়ার কতোটা ঘাটতি। দলীয় সংগ্রহে সর্বোচ্চ রান জমা হলেও স্পষ্ট হয়ে যায় বড় দলকে হারানোর জন্য নিজেদের সাধ্যের সর্বোচ্চটাও যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন আরও বেশি কিছু। সামর্থ্যের বাইরে গিয়ে ভিন্ন কিছুর। আউট অব বক্স কোনো পারফরম্যান্স।
ব্যাটিংয়ের মতো বোলিংয়েও ছিল না বিষ। পেসার ও স্পিনারদের নির্বিষ আক্রমণে অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটসম্যানরা যেভাবে অনায়েসে টিকে ছিল তাতে বোঝা গেছে বোলারদের মনোবল একেবারে তলানিতে। লড়াইয়ের মানসিকতা নেই বললেই চলে। এই বিশ্বকাপটায় বাংলাদেশের জন্য প্রাপ্তির থেকে হারানোর সংখ্যাটাই ছিল বেশি। যে আত্মবিশ্বাস নিয়ে এসেছিল তা উধাও হয়ে গেছে মাঝপথেই। শেষটায় নিজেদের সামর্থ্যের পাশে এঁকে দিয়ে বড় প্রশ্নবোধক ছিল। সংশয়, উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা যেন ঘুরপাক খাচ্ছে লাল-সবুজের ড্রেসিংরুমে। নিজেদের সবচেয়ে পছন্দের ও স্বাচ্ছন্দ্যের ফরম্যাটে এমন ভরাডুবি গ্রহণ করতে পারছে না কেউ-ই। যে দুই ম্যাচ জিতেছে সেগুলোতে নিজেদের সামর্থ্যের সঙ্গে ভাগ্যকে পাশে পেয়েছিল। বড় মঞ্চে এসে সেরা ক্রিকেট খেলার পথটা মসৃণ নয় বাংলাদেশ এবার খুব ভালোভাবেই তা টের পেয়েছে।
অস্ট্রেলিয়ার আমন্ত্রণে ব্যাটিংয়ে নেমে স্বপ্নীল সূচনা পায় বাংলাদেশ। লিটন ও তানজিদের উদ্বোধনী জুটিতে রান ৭৬। বিশ্বকাপে নিজেদের তৃতীয় দিনের ম্যাচ খেলতে নামা বাংলাদেশ প্রথম পরীক্ষায় বেশ ভালোভাবে পাশ করে। কিন্তু পরেই পথ হারায়। ৩২ ওভারে তুলে নেয় ২০০। কিন্তু পরের ১৮ ওভারে রান কেবল ১০৫। ৩৬, ৩৬, ৪৫; টপ অর্ডারে প্রথম তিন ব্যাটসম্যান নিজেদের রান পঞ্চাশে রূপ দিতে পারেননি। থিতু হওয়ার পর খেলতে পারেননি বড় ইনিংস।
সর্বোচ্চ ৭৪ রান করা তাওহীদ লম্বা ইনিংস খেলার পর আউট হয়েছে ফুলটস বলে। নিজেদের শেষ বিশ্বকাপের ম্যাচ খেলতে নামা মাহমুদউল্লাহ ও মুশফিকের ইনিংস থেমে যায় যথাক্রমে ৩২ ও ২১ রানে। তাওহীদের সঙ্গে রানিং বিটুউন দ্য উইকেটে ভুল বোঝাবুঝিতে মাহমুদউল্লাহ ঝাঁপিয়ে পড়েও উইকেট বাঁচাতে পারেননি। সাকিবের পরিবর্তে নেতৃত্ব দেওয়া শান্তর প্রতিশ্রুতিশীল ইনিংস থেমে যায় ৪৫ রানে।
অথচ থিতু হওয়ার পর ব্যাটসম্যানরা দায়িত্ব নিয়ে ইনিংস বড় করেন। দলের স্কোরকে নিয়ে যান চূঁড়ায়। সেখানে বাংলাদেশের প্রায় একাধিক ব্যাটসম্যান আজ সুযোগ পেয়েও লম্বা করতে পারেননি নিজেদের ইনিংস।
ব্যাটসম্যানরা যেখানে উইকেটের দাবি অনুযায়ী রান তুলতে পারেননি সেখানে বোলাররা পাত্তা পাবে ভাবনাটাই অমূলক। সেমিফাইনাল নিশ্চিত করা অস্ট্রেলিয়ার পরিকল্পনা ছিল অলআউট ক্রিকেট চালিয়ে যাওয়া। ওয়ার্নার, হেডের ব্যাটিং সেই বার্তাই দিচ্ছিল। আগ্রাসী হতে গিয়ে হেড তাসকিনের বলে আউট হলেও অসিরা থেমে থাকেননি। বরং মিচেল মার্শ ২২ গজে গিয়ে তাণ্ডব চালিয়েছেন। ৩৭ বলে তিনটি করে চার ও ছক্কায় পঞ্চাশ ছোঁয়ার পর ৮৭ বলে ১০০। এরপর ১১৭ বলে দেড়’শ। আর কি চাই অজিদের?
আরেক ওপেনার ওয়ার্নার ৫৩ রানে থেমে যান মোস্তাফিজের বলে শান্তর হাতে ক্যাচ দিয়ে। কিন্তু দলে ফেরা স্মিথ আর মার্শকে ফেরানোর কোনো উত্তর জানা ছিল না বাংলাদেশের বোলারদের। দুজনের অবিচ্ছিন্ন ১৩৫ বলে ১৭৫ রানের জুটিতে জয় চলে আসে অতি সহজে। সঙ্গে অসিরা বিশ্বকাপে তিন’শ-এর বেশি রান তাড়া করার রেকর্ডও ছুঁয়ে ফেলে।
বাংলাদেশের ক্রিকেটাকাশে ব্যর্থতার কালো মেঘ জেঁকে বসা। চলছে পালাবদলের সময়ও। ব্যর্থতার বৃত্ত কাটিয়ে কবে সাফল্যর সূর্য উঁকি দেবে কে জানে। এর আগ পর্যন্ত নানা সমালোচনায় বিদ্ধ হতে হবে। সেই প্রস্তুতিও নিতে হবে ভরাডুবিতে হাবুডুবু খাওয়া পনেরজনকে।