৭ ইনিংসে ৫৪.৬৬ গড় ও ৯১.৬২ স্ট্রাইকরেটে ৩২৮ রান। ক্যারিয়ারের শেষ বিশ্বকাপ খেলতে এসে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের ব্যক্তিগত অর্জনের মার্কশিট। আহামরি কোনও অর্জন নয়। কিন্তু যখন বলা হবে বিশ্বকাপে দলের সফলতম ব্যাটার তিনি। এ ছাড়া, আর কোনও ব্যাটসম্যান তিনশ রানও করতে পারেননি, তখন এই অর্জনকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই।
বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলের একমাত্র সেঞ্চুরিয়ান মাহমুদউল্লাহ। এখন নিশ্চয়ই বোঝা যাচ্ছে বড় মঞ্চে তার উপস্থিতি কতটা গুরুত্ব বহন করেছে। অথচ এই বিশ্বকাপে মাহমুদউল্লাহ থাকতেন কি না, সেটাই বিরাট প্রশ্ন। বিশ্বকাপের আগে তাকে যেভাবে জাতীয় দলের বাইরে রাখা হয়েছিল, তা ছিল স্রেফ বিতর্কিত।
কেউ কেউ তার ক্যারিয়ারের শেষও দেখে ফেলেছিলেন তখন। কিন্তু মাঠে ফেরার তীব্র আকাঙ্ক্ষা ও নিয়তি তাকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারেনি। ভাগ্য তাকে আবার ফিরিয়েছে লাল-সবুজের ড্রেসিংরুমে। যেখানে বাঁধার দেয়াল টপকে নিজেকে মেলে ধরেছেন। হয়েছেন সেরা। ক্যারিয়ারের সায়াহ্নে তার ব্যাটেই দেখা মিললো আলোর ছটা।
দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব গ্রহণের পর চন্ডিকা হাথুরুসিংহে নিজের প্রথম সিরিজে মাহমুদউল্লাহকে বাজিয়ে দেখেন। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তিন ওয়ানডেতে তার রান ৩১, ৩২ ও ৮। আহামরি খারাপ না করলেও দ্বিতীয় সিরিজেই মাহমুদউল্লাহ ‘ড্রপ’! আনুষ্ঠানিকভাবে ‘ড্রপ’ বলার সুযোগও নেই। বিতর্ক এড়াতে ‘বিশ্রাম’ নামক নিরাপদ শব্দের আশ্রয় নিয়ে তাকে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে হোম অ্যান্ড অ্যাওয়ে সিরিজে দলের বাইরে রাখেন নির্বাচকরা। সেই বিশ্রাম এতটাই লম্বা ছিল যে তাকে চারটি সিরিজে বাইরে থাকতে হয়। যার মধ্যে ছিল এশিয়া কাপও।
সবকিছুর আড়ালে থাকলেও তার প্রস্তুতিতে ঘাটতি চোখে পড়েনি। ফিটনেস যাচাইয়ে ‘ইয়ো ইয়ো’ টেস্টে পেয়েছিলেন ১৭-এর মতো। বয়স বিবেচনায় যে মানদণ্ড ঠিক করা হয়েছিল, তাতে পাশ করে যান। ব্যাট-বলে স্কিল অনুশীলনেও দেখাচ্ছিলেন মাঠে ফেরার জেদ, লড়াইয়ের তাড়না। বড় কিছুর ক্ষুধা যে এখনও তার রয়েছে, তা ঘাম ঝরানো একেকটি সেশন দেখে বোঝা যাচ্ছিল। কিন্তু সেসবের কিছুই কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহের পরিকল্পনায় আসার মতো যথেষ্ট ছিল না।
কিন্তু দলের ভরাডুবিতে তার দুয়ারেই আবার ফিরতে হয় টিম ম্যানেজমেন্টকে। নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে তিন ম্যাচের সিরিজে ফিরে ৪৯ ও ২১ রানের দুটি ইনিংস খেলেন। তাতে খুলে যায় বিশ্বকাপের দরজা। যেখানে তার হাত ধরেই আসে বিশ্বকাপের একমাত্র সেঞ্চুরি, সর্বোচ্চ রান, ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি স্ট্রাইক রেট ও পঞ্চাশের ওপর গড়।
দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ১৪৯ রানের বিশাল হারে তার ১১১ রানের ব্যক্তিগত অর্জন আড়াল হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু বিশ্বকাপে বাংলাদেশের প্রথম সেঞ্চুরিয়ানের আরেকটি সেঞ্চুরিতে কিছুটা হলেও আনন্দ ছড়ায়। স্বস্তির পরশ বুলিয়ে দিয়েছিল ড্রেসিংরুমে। কেননা মাহমুদউল্লাহর এই সেঞ্চুরি অজস্র ঘামবিন্দু ঝরিয়ে পাওয়া। যার পেছনে রয়েছে পরিশ্রমের দারুণ এক গল্প। নিবেদনের প্রতিচ্ছবি। অভিজ্ঞতার এক মেলবন্ধন।
দল থেকে বাদ পড়ার পর স্রেফ নিজের কাজে মনোযোগ দিয়ে দলের সেরা ব্যাটসম্যান হয়েছেন মাহমুদউল্লাহ। বিশ্বকাপের আগে শেষ ছয় মাসে যা হয়েছে, তা ছিল রীতিমতো বিব্রতকর। তবে দমে না গিয়ে মাহমুদউল্লাহ দিনরাত পরিশ্রম করেছেন। মিরপুরে নিয়মিত এসে নিজের ব্যাটিং নিয়ে কাজ করেছেন। ফিল্ডিংয়ে শ্রম দিয়েছেন। ফিটনেসে হয়েছেন আরও ঝরঝরে। দেশের জার্সিতে খেলার অনুপ্রেরণায় নিজেকে হারিয়ে যেতে দেননি এই ক্রিকেটার।
সেই ফলই ভোগ করছেন ভারতের মাটিতে। বিশ্বকাপে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ কেবল ধারাবাহিক পারফর্মারই ছিলেন না, ব্যাটিংয়ে যে ছন্দে আছেন তা বোঝা গেছে। অন্যান্য ব্যাটসম্যানরা যেখানে সময় নিয়ে রান করেছেন। সেখানে মাহমুদউল্লাহ শুরু থেকেই ছন্দে। কলকাতায় পাকিস্তানের বিপক্ষে তার কাউন্টার অ্যাটাক ছিল দুর্দান্ত। শাহীন শাহ আফ্রিদি ও মোহাম্মদ ওয়াসিমকে মারা কাভার ড্রাইভ বিশ্বকাপের সেরা দুটি শট হয়ে থাকবে।
অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ২৮ বলে ৩২ রানের ইনিংসে তার হাঁকানো তিন ছক্কা উপচে পড়ে গ্যালারিতে। বিশ্বকাপের শেষ ইনিংসটিতেও দৃঢ়তা দেখিয়েছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত রান আউটে শেষ হয় তার বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার যাত্রা। ছোট ইনিংস কিংবা বড়, একবারও মনে হয়নি যে তার ব্যাটে জড়তা আছে। বরং আত্মবিশ্বাসের রেণু ছড়িয়েছিল। যে আত্মবিশ্বাসের দেখা মেলেনি অন্য কারও ব্যাটে। যে কোচ তাকে বিশ্রামে পাঠিয়ে ক্যারিয়ার ফুলস্টপ করার চেষ্টা করেছিলেন, সেই কোচই তাকে কাছে ডেকে ব্যাটিং অর্ডারে প্রমোশন দিয়েছেন। তাতে প্রমাণ হয়, জীবন ঘুরে ফিরে সেই পরিশ্রমী, নিবেদিতপ্রাণ ও অভিজ্ঞতাকেই তাড়িয়ে বেড়ায়।
তাওহীদ হৃদয়ের সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝিতে তার বিশ্বকাপের শেষ ইনিংসটি থেমে যায় রান আউটে। ঝাঁপিয়ে উইকেট বাঁচাতে গিয়ে চোট পেয়েছেন কাঁধে। যে কাঁধে সতের কোটির স্বপ্ন বহন করেছিলেন। দলের সামগ্রিক ব্যর্থতায় আড়াল হচ্ছে তার অর্জনও। তবে বিশ্বকাপে যেভাবে মাহমুদউল্লাহ এসেছিলেন, চাপের মুহূর্তে পারফর্ম করেছেন তা নিশ্চিতভাবেই অনুপ্রেরণার গল্প হয়ে থাকবে অনন্তকাল।