‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ এখন টক অব দ্যা সাবকন্টিনেন্ট। এমনকি বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা বাঙালির আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। ঘর-সমাজ-রাষ্ট্রে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া বাঙালি চেতনার প্রশ্নে আজ যেন একাট্টা, এক কাতারে শামিল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং প্রত্যন্ত গাঁয়ের চায়ের দোকানে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু এখন কাজী সাহেবের ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’। বিশেষ কিছু গান-কবিতা বিশেষ কারণে জাতির অন্তর্জাত আপন শ্লোগানে পরিণত হয়েছে যুগে যুগে। কালোত্তীর্ণ চেতনা উৎসারি তেমনি একটি গান ‘কারার ঐ লৌহ কপাট/ ভেঙে ফেল কররে লোপাট।‘
একটির সঙ্গে অন্যটি তুলনীয় না হলেও তেমনি আরেকটি গান ‘একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি।‘ স্বভাবে অনিকেত বাউল পিতাম্বর রায়ের লেখা গানটি ‘আশুতোষ’ ছবিতে অপরেশ লাহিড়ী শুধুই একটি একতারার স্ট্রোকে লতা মঙ্গেশকারের কণ্ঠে তুলে ধরেন। যা চিরসবুজ গানের অভিধায় ভূষিত হয়ে আছে। এবার আসা যাক মূল প্রসঙ্গে। ডিসেম্বর- ১৯২১। টালমাটাল ভারতবর্ষ। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে ভারতবাসী যুদ্ধংদেহী। তাতানো মাটি। ফুঁসে উঠছে জনতা। যেন সামান্য ঘষা লাগলেই বারুদে আগুন জ্বলে উঠবে। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস কলকাতার জেলে বন্দি। এমন অবস্থায় কুমিল্লা থেকে কলকাতায় ফেরেন কাজী নজরুল ইসলাম। চিত্তরঞ্জন দাস ও অন্যান্য বন্দি এবং আবালবৃদ্ধ-বনিতাকে উজ্জীবিত করতে কবি গীতিকবিতা হিসেবে লিখলেন ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ শীর্ষক ভাঙার গানটি।
১৯২২-এর জানুয়ারিতে চিত্তরঞ্জন দাসের পত্রিকা ‘বাংলার কথায়’ এটি প্রকাশিত হয়। পত্রিকায় প্রকাশের পরবর্তী সময়ে কাজী সাহেব গানটিতে সুরারোপ করে বিভিন্ন সভায় নিজেই গাইতে থাকেন। তখন অবধি গানটি কারো কণ্ঠে রেকর্ড করার সুযোগ হয়ে ওঠেনি। ১৯৪৯ সালে নির্মল চৌধুরী নির্মাণ করেন ‘চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন’ ছবিটি। নিতাই ঘটকের সংগীত পরিচালনায় গানটি গিরিন চক্রবর্তীর কণ্ঠে ধারণ করা হয় (কলম্বিয়া রেকর্ড জি ই ৭৫০৬)।
১৯৭০ সালে জহির রায়হান তাঁর ‘জীবন থেকে নেয়া’ চলচ্চিত্রেও গানটি ব্যবহার করেন। খান আতাউর রহমানের সংগীতায়োজনে গানটিতে কণ্ঠ দেন আব্দুল জব্বার, মাহমুদুন্নবী, সৈয়দ আবদুল হাদী প্রমুখ। গানটি ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়। ৭১’ পরবর্তীকালে গানটি এপার-ওপার দুই বাংলাতেই অসংখ্য শিল্পীর কণ্ঠে গীত হতে থাকে। এছাড়াও বিবিসি জরিপে শ্রেষ্ঠ গানের তালিকায় ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ স্বমহিমায় স্থান করে নেয়।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে নজরুলের অপরিসীম ভূমিকা সর্বজনবিদিত। নিপীড়িত-নিগৃহীত মানুষের দুঃসহ যন্ত্রণার প্রকাশ ঘটে ১৯২২ সালে কলকাতার রাইটার্স বিল্ডিঙে রচিত নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতার মধ্য দিয়ে। ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’-এর মতো এমন একটি ঐতিহাসিক সৃষ্টি নিয়ে সম্প্রতি নিন্দনীয় বিতর্কে জড়ালেন কম্পোজার এ আর রহমান। হিন্দি ভাষায় নির্মিত ‘PIPPA’ ছবিতে গানটি বিকৃতভাবে ব্যবহার করেন তিনি। যা ইতোমধ্যে ব্যাপকভাবে ধিকৃত এবং নিন্দার ঝড় তুলেছে।
‘রোজা’ ছবির গানের মাধ্যমে আলোচনায় আসেন এ আর রহমান। একাগ্র সাধনা ও নিষ্ঠার জোরে একেবারে প্রান্তিক অবস্থান থেকে উঠে এসেছেন তিনি। সংগীতে তিনি অস্কার জয় করেন। তাঁর সাধনা এবং অর্জনকে যুগপৎ সম্মান জানাই। কিন্তু আমাদের জাতীয় কবির অনবদ্য সৃষ্টি নিয়ে এ হেন বালখিল্য ফাজলামো-অনৈতিক ছেলেমানুষি এবং অধিকারের মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়া স্পর্ধা আমাদের যারপরনাই স্তম্ভিত করেছে!
চলচ্চিত্রের এরকম কাজের ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই যোগ্যতাসম্পন্ন এবং শক্তিশালী রিসার্চ টিম থাকে বলেই আমাদের বিশ্বাস। এমন যুক্তিহীন-অগ্রহণযোগ্য স্বেচ্ছাচারিতা সংশ্লিষ্ট সকলকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। কাজী নজরুল ইসলাম এবং তাঁর সৃষ্টিকে উপলব্ধি করার যোগ্যতা এ আর রহমানের নেই বলেই প্রতিভাত হয়েছে। তিনি গানের বাণী এবং সুরের স্পিরিট ধরতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছেন বলেই আজকের এই বিতর্ক। দ্রোহের কবি, প্রেমের কবি, আমাদের চেতনার কবি কাজী নজরুল ইসলামের সৃষ্টি নিয়ে এমন ঔদ্ধত্য মামুলি ব্যাপার নয়। বরং বেয়াদবির পরাকাষ্ঠা নিদর্শন। প্রশ্ন জাগে, কাজী নজরুল কিংবা তাঁর সৃষ্টি সম্পর্কে এ আর রহমানের কোনো ধারণা আছে কিনা? গানের বাণীতে কি বলা হয়েছে তিনি কি তা বুঝবার চেষ্টা করেছেন?
মোটেই নয়। ছিটেফোঁটা বুঝলেও এমন কথার সঙ্গে অন্তত এ রকম বেঢপ-অপাংক্তেয় সুর বসাতে পারতেন না। সুর বিকৃতির কথা না হয় ছেড়েই দিলাম। তিনি যা করেছেন তা অমার্জনীয়। এ ধৃষ্টতা ক্ষমার অযোগ্য। নজরুলকে তিনি কি ভেবেছেন, সামান্য একজন বাঙালি কবি? ইউরোপ-আমেরিকায় নজরুলের জন্ম হলে একাধিকবার অস্কার পেতেন সাহিত্যে। এ আর রহমানের অস্কার লুটোপুটি খেত নজরুলের পায়ে। রহমান ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ গানটি নিয়ে যা করেছেন তা চরম স্বেচ্ছাচারিতা। আত্মম্ভরিতা ও আত্মশ্লাঘায় নিমজ্জিত ব্যক্তি আর যাই হোক জাত শিল্পী হতে পারেন না।