২০০৭ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত ৪টি বিশ্বকাপেই বাংলাদেশ ৩টি করে খেলায় জয়লাভ করেছিল। ক্রিকেটপ্রেমীদের অনেকেই প্রত্যাশা করেছিলেন ২০২৩ বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলের সাফল্য অতীতের সকল অর্জনকে ছাড়িয়ে যাবে। বিশেষ করে এবারের আসর ভারত আয়োজন করায় বাংলাদেশি অনেক ভক্ত পরিচিত উপমহাদেশীয় কন্ডিশনকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ সেমিফাইনাল খেলবে এমন স্বপ্নও দেখেছিলেন। তবে স্বপ্ন রীতিমত দুঃস্বপ্নে পরিণত হয় যখন বাংলাদেশ ৯টি খেলায় মাত্র ২টি জিতে দেশে ফিরে আসে। অর্জিত জয় ২টিও এসেছে তুলনামূলক নবাগত আফগানিস্তান এবং দুর্বল শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে।
স্বাভাবিক ভাবেই বাংলাদেশ দলের পারফরম্যান্স নিয়ে চলছে কাটাছেঁড়া। বিশ্বকাপ স্কোয়াড থেকে শুরু করে, ঘন ঘন ব্যাটিং অর্ডার পরিবর্তন, অধিনায়কত্ব, ফাস্ট বোলার দের নতুন বলে আঘাত হানার অক্ষমতা সবকিছু নিয়েই চলছে আলোচনা-সমালোচনা। তবে আলোচনা হওয়ার মতো এমন একটি বিষয় নিয়ে তেমন আলোড়ন পরিলক্ষিত হয়নি। আর সেটি হচ্ছে ৫০ ওভারের ক্রিকেটে বাউন্ডারি এবং ওভার বাউন্ডারি মারার পাশাপাশি সিঙ্গেল/ডাবল নিয়ে ‘রোটেশন অব স্ট্রাইক’ করতে বাংলাদেশি ব্যাটারদের ব্যর্থতা।
একটি চিত্তাকর্ষক পরিসংখ্যান তুলে ধরা যাক। গ্রুপ স্টেজে প্রতিটি দল ৯টি করে খেলা খেলেছে। সেমিফাইনালের ঠিক পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত মোট সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত রানের কৃতিত্ব অর্জন করেছেন ভারতের বিরাট কোহলি। তবে মজার বিষয় হচ্ছে কোহলি কিন্তু তার মোট রানের ৫৬% সংগ্রহ করেছেন শুধুমাত্র সিঙ্গেল/ডাবল দিয়ে। অথচ টুর্নামেন্টে কোহলির স্ট্রাইক রেট ৮৮। অর্থাৎ প্রতি বলেই বিগ শট খেলার ঝুঁকি না নিয়েও কোহলি রানের চাকা সচল রেখেছেন। একই প্যাটার্ন লক্ষণীয় এবারের বিশ্বকাপের চমক এবং আরেকজন সফল ব্যাটার নিউজিল্যান্ডের রাচিন রাভীন্দ্রার ব্যাটিংয়ে। রাভীন্দ্রা তার মোট রানের ৪৫% সংগ্রহ করেছেন সিঙ্গেল/ডাবল নিয়ে। টুর্নামেন্টে তার স্ট্রাইক রেট ১০৮। অর্থাৎ কোহলি এবং রাভীন্দ্রা দুজনেই ক্যালকুলেটেড বিগ শটের পাশাপাশি সিঙ্গেল/ডাবলের ওপর জোর দিয়ে সফলভাবে রানের গতি চালু রেখেছেন। আর এখানেই বাংলাদেশি টপ অর্ডার একেবারেই ব্যর্থ। সুপার ফ্লপ নবাগত তানজিদ তামিম তার মোট রানের মাত্র ২৬% করেছেন সিঙ্গেল/ডাবল নিয়ে। অথচ বিগ শট খেলতে গিয়ে প্রায় প্রতিটি ম্যাচেই উইকেট বিলিয়ে এসেছেন।
ইএসপিএন ক্রিকইনফোতে ম্যাচ ডে আলোচনায় ক্রিকেট বিশ্লেষক মিচেল ম্যাকক্লেনাগান তামিম জুনিয়রকে আখ্যায়িত করলেন প্রতিপক্ষের জন্য রীতিমত ‘ফ্রি ডিনার’ বলে। অপরদিকে লিটন এবং শান্ত এ দুজনও করেছেন হতাশ। প্রায় ম্যাচেই তারা বিগ শটের ওপর জোর দিতে গিয়ে অল্প রানেই উইকেট খুইয়ে এসেছেন। উইকেটে যেদিন কিছুটা থিতু হতে পেরেছেন সেদিন ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ফিল্ডার দের কাছে বল ঠেলে মাঝে মধ্যে সিঙ্গেল/ডাবল নিলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রতিপক্ষকে দিয়েছেন মাত্রাতিরিক্ত ডট বল। ফলশ্রুতিতে এবারের বিশ্বকাপের সফল দলগুলোর টপ অর্ডারের সাথে তুলনা করলে লিটন ও শান্ত দুজনেরই স্ট্রাইক রেট ছিল বেশ সাদামাটা। বাংলাদেশ দলকে ৫০ ওভারের ক্রিকেটে দীর্ঘ মেয়াদে সফল হতে হলে ব্যাটার দের সিঙ্গেল/ডাবল নেওয়ার দক্ষতা গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি নিয়মিত বিরতিতে বাউন্ডারি স্কোর করতে হবে। তাহলেই রান রেট চালু থাকবে। দল বড় সংগ্রহ করতে সক্ষম হবে।
বিশ্বকাপ স্কোয়াডের ব্যালান্স নিয়েও প্রশ্ন তোলা যেতেই পারে। বিশেষত সেমিফাইনালের জন্য কোয়ালিফাই করা চার দলের কোন স্কোয়াডেই কিন্তু ৫ জন ফ্রন্ট লাইন ফাস্ট বোলার নাই। সেখানে আমরা ঠিক কোন যুক্তিতে ৫ জন ফ্রন্ট লাইন ফাস্ট বোলার স্কোয়াডে রাখলাম তাও আবার ভারতীয় কন্ডিশনে তার ব্যাখ্যা বিজ্ঞ সিলেকশন কমিটির সদস্য, অধিনায়ক, কোচ প্রমুখ ওনারাই ভালো দিতে পারবেন। তবে এতে সমস্যা যেটি হয়েছে সেটি হচ্ছে স্কোয়াডে কোনো ব্যাকআপ ব্যাটার ছিল না। ফলশ্রুতিতে যখন কেউ রান করতে পারেননি তখন ব্যাটিং অর্ডার রদবদল করা ছাড়া এর বেশি আর কিছু করা সম্ভব হয়নি।
ব্যাটিং অর্ডারে প্রায় প্রতি ম্যাচেই রদবদল আনাটাকেও বিশেষজ্ঞরা অনেকেই ভালো চোখে দেখেননি। বিশেষত ব্যাটিং অর্ডারে মেহেদি হাসান মিরাজ এবং মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের কোনো নির্দিষ্ট পজিশন ছিল না। তা স্বত্তেও যে পজিশনেই ব্যাট করেন না কেন মাহমুদউল্লাহ সার্বিকভাবে সাফল্যের মুখ দেখেছেন। অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে তিনি ৫৪ গড়ে ৯১ স্ট্রাইক রেটে বাংলাদেশ দলের হয়ে সর্বোচ্চ ৩২৮ রান সংগ্রহ করেছেন। তবে মেহেদি মিরাজের ওপর সম্ভবত এই ঘন ঘন ব্যাটিং অর্ডার পরিবর্তন ক্ষতিকর প্রভাব রেখেছে। ৯ ম্যাচ খেলে মিরাজের সংগ্রহ মাত্র ২২ গড়ে ২০১ রান। মিরাজ অত্যন্ত প্রতিভাবান একজন অলরাউন্ডার। অনেকে তাকে ভবিষ্যতের সাকিব মনে করেন। তার প্রতিভা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নাই। কিন্তু প্রত্যাশার চাপ বহন করতে মিরাজকে যেন কিছুটা সংগ্রাম করতে হচ্ছে।
উল্লেখ্য মিরাজের ক্যারিয়ারে মোট ৩টি হাফ সেঞ্চুরি এবং ২টি সেঞ্চুরি রয়েছে। কিন্তু এর ৪টিই তুলনামূলকভাবে আফগানিস্তান এবং শ্রীলঙ্কার সাথে। ভারতের সাথে ১টি সেঞ্চুরি রয়েছে কিন্তু সেটি ৮ নম্বরে ব্যাট করে। টপ অর্ডারে বড় কোন দলের বিপক্ষেই মিরাজ এখন পর্যন্ত কখনো সফল হতে পারেননি। তাই এবারের বিশ্বকাপে প্রাথমিক ভাবে মিরাজকে টপ অর্ডারে এবং আপার মিডল অর্ডারে খেলানোর পরিকল্পনা ব্যাকফায়ার করেছে। আপাতত মিরাজকে লোয়ার মিডল অর্ডারে খেলিয়ে যখন তিনি আরো ম্যাচুর্ড হয়ে উঠবেন তখন তাকে ধীরে ধীরে আরও ওপরে ব্যাট করানো যেতে পারে। এছাড়া দলের অপর তিন ব্যাটার সাকিব (অলরাউন্ডার), মুশফিক (উইকেটরক্ষক) এবং হৃদয় (ব্যাটার) আশানুরূপ ধারাবাহিকতা দেখাতে পারেননি। স্বাভাবিক ভাবেই পুরো বিশ্বকাপে আমরা মাত্র একবার ৩০০+ স্কোর করতে পেরেছি।
এবার আলোচনা করা যাক ফাস্ট বোলার দের পারফরম্যান্স নিয়ে। পরপর প্রয়াত হিথ স্ট্রিক, ওটিস গিবসন এবং অ্যালান ডোনাল্ডের মত তিনজন বিশ্বমানের কোচের অধীনে ফাস্ট বোলাররা উল্লেখযোগ্য উন্নতি করেছিলেন। তবে এবারের বিশ্বকাপে তার ছিটেফোটাও দেখা গেল না। পুরো বিশ্বকাপ খেলে ফাস্ট বোলাররা ব্যয়বহুল ৫০ গড়ে ওভার প্রতি ৬.৩২ রান দিয়ে মাত্র ২৬টি উইকেট নিয়েছে। সার্বিক বিবেচনায় অংশগ্রহণকারী নয়টি দলের ফাস্ট বোলিং পারফরম্যান্সের ভিতর এটিই ছিল সবচেয়ে বাজে। শরিফুল যিনি ১০টি উইকেট লাভ করেছেন তাকে বাদ দিলে দলের অন্য কোনো ফাস্ট বোলারই ৫টির বেশি উইকেট নিতে পারেননি। অনেকে এবারের বিশ্বকাপে নতুন বলে সুইং না পাওয়াকে এর পিছনে দায়ী করতে পারেন।
কিন্তু মনে রাখা প্রয়োজন তাসকিন অথবা মুস্তাফিজ তারা কেউই সুইং বোলার না। তাদেরকে ইংরেজিতে ‘হিট দ্য ডেক’ বোলার বলা হয়ে থাকে। অর্থাৎ তাসকিন এবং মুস্তাফিজের জন্য ন্যাচারাল লেংন্থ হচ্ছে গুড লেংন্থ এবং শর্ট অব গুড লেংন্থ। কাজেই সুইং না পাওয়ার অজুহাত অন্তত তাসকিন এবং মুস্তাফিজের জন্য চলে না। অ্যালান ডোনাল্ডের সাথে চুক্তি নবায়ন না হওয়ায় তিনি দেশে ফিরে গেছেন। নতুন যিনি বোলিং কোচ হয়ে আসবেন তার অ্যাসাইনমেন্ট হতে পারে কোন জায়গায় ফাস্ট বোলাররা গুলিয়ে ফেলেছিলেন সেটিকে বিশ্লেষণ করে ভুলগুলো শুধরাতে সহায়তা করা।
বাকি থাকলো দলের কমান্ডার সাকিব আল হাসানের অধিনায়কত্ব। বিভিন্ন কারণে বিষয়টি স্পর্শকাতর তবে কিছু জেনারেল অবজারভেশন দেওয়া যেতেই পারে। ২০১৯ সালের বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন দল ইংল্যান্ডকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ইয়ন মর্গান। দলনেতা হিসাবে এই আইরিশ ম্যান অথচ ইংল্যান্ডকে নেতৃত্ব দেওয়া মর্গানের বেশ সুখ্যাতি রয়েছে। শেষ ১০-১৫ ওভারে মর্গান বোলারদের সাথে বোলিং পরিকল্পনা নিয়ে নিয়মিত আলোচনা করতেন এবং সেটি অনেক ক্ষেত্রে বোলারদের মানসিক ভাবে চাঙা করে তুলতে সহায়তা করতো। কেন উইলিয়ামসন অথবা রোহিত শর্মাকেও এ বিশ্বকাপে এমনটাই করতে দেখা গেছে। কিন্তু সাকিবকে এবারের বিশ্বকাপে স্লগ ওভারে বলতে গেলে কখনোই কোন বোলারের সাথে আলোচনা করতে দেখা যায়নি। কেন দেখা যায়নি তার উত্তর সাকিবের মত একজন ন্যাচারাল লিডার নিজেই সম্ভবত ভালো দিতে পারবেন। কিন্তু ক্রিকেট বিশেষজ্ঞরা এমন প্রশ্ন তুলতেই পারেন।
আরেকটি বিষয় নিয়ে কথা না বললেই না। আমরা জানি সাকিব বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম সেরা একজন দলনায়ক। নিজের অবস্থান স্পষ্ট করতে অথবা মত প্রকাশ করতে কখনোই দ্বিধা করেন না। তাই যদি হয়ে থাকে তাহলে ৫ জন ফাস্ট বোলার নিয়ে স্কোয়াড ঘোষণা করার মত সুইসাইডাল সিদ্ধান্ত অথবা ব্যাটিং অর্ডারে অযাচিত রদবদল আনা নিয়ে তিনি কেন কোন প্রতিবাদ করেননি। নাকি এ সকল বিতর্কিত সিদ্ধান্ত সাকিবের সম্মতিতেই হয়েছিল। বাংলাদেশি ক্রিকেটপ্রেমীদের এসব প্রশ্নের উত্তর জানার অধিকার রয়েছে। তবে উত্তর কখনো আদৌ পাওয়া যাবে কিনা সেটিই একটি বিরাট বড় প্রশ্ন।
বাংলা বাগধারার মাধ্যমে প্রকাশ করতে হলে বাংলাদেশের বিশ্বকাপ পারফরম্যান্সকে বলা যেতে পারে ‘আশায় গুড়েবালি’। আমরা বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীরা এখন তাকিয়ে থাকবো ২০২৭ বিশ্বকাপের দিকে যেটি অনুষ্ঠিত হবে আফ্রিকা মহাদেশে। বলাবাহুল্য ২০০৩ সালে সর্বশেষ আফ্রিকা মহাদেশে বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয়েছিল এবং তাতে আমরা সব কটি ম্যাচ হারার লজ্জাজনক রেকর্ড করেছিলাম। এবার নিশ্চয়ই এমনটি হবে না। বিসিবি কর্তা ব্যক্তিরা তো সবসময়ই বলে থাকেন আমাদের টার্গেট এবারের বিশ্বকাপ না, নেক্সট বিশ্বকাপ। তাই যদি হয় তাহলে ২০২৭ বিশ্বকাপ নিয়ে আমরা না হয় আশায় বুক বাঁধতেই পারি। বেটার লাক নেক্সট টাইম বাংলাদেশ ক্রিকেট টিম।
লেখক: আইনজীবী, গবেষক ও ক্রীড়া বিশ্লেষক, বেলফাস্ট, যুক্তরাজ্য