ভারত বিশ্বকাপের প্রথম সেমিফাইনাল মাঠে গড়ানোর অপেক্ষা। ওয়াংখেড়েতে ২০১১ সালে যে মাঠে ভারত দ্বিতীয় শিরোপা উঁচিয়ে ধরেছিল সেখানেই তারা আতিথ্য দেবে নিউ জিল্যান্ডকে প্রথম সেমিফাইনালে। বিশ্বকাপ যখন শেষ চারের লড়াইয়ের অপেক্ষার প্রহর গুনছে, তখন বাংলাদেশ দল বিশ্বকাপে নিজেদের ভরাডুবির ময়নাতদন্তের ঝাপিয়ে পড়ছে। টিম ডিরেক্টর খালেদ মাহমুদ সুজন ও কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহের কাছে বিশ্বকাপের ব্যর্থতার প্রতিবেদন চেয়েছে বিসিবি।
সেমিফাইনাল খেলার স্বপ্ন নিয়ে বিশ্বকাপে যাওয়া একটি দল নয় ম্যাচে মাত্র দুটি জয় পাবে এমন ভাবনাই ছিল না দেশের ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থার। আপাতদৃষ্টিতে ভরাডুবির জন্য বেশ কয়েকটি কারণ ধরা পড়েছে। যা নিশ্চিতভাবেই আলোচনার টেবিলে উঠবে…
সাকিব-তামিম ইস্যু: বিশ্বকাপটা যেন মাঠের আগেই শেষ! বিসিবির এক পরিচালক এমন শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন তামিম ইকবালকে বিশ্বকাপ দলে দেখতে না পেয়ে। বলার অপেক্ষা রাখে না, তামিম ইকবাল ও সাকিব আল হাসানের ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের কারণে বিশ্বকাপ খেলার অবস্থায় থাকার পরও বাঁহাতি ওপেনারকে দলে নেওয়া হয়নি। পুরোপুরি ফিট নন তামিম এমন কথা বলেই তাকে সরিয়ে নেওয়া হয় স্কোয়াড থেকে। কিন্তু একদিন যেতে না যেতেই থলের বিড়াল বেরিয়ে আসে। তামিম অভিযোগ করেন, বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে আফগানিস্তানের বিপক্ষে তাকে দলের বাইরে থাকতে হবে। আর যদি দলে থাকে তাহলে ওপেনিংয়ের পরিবর্তে মিডল অর্ডারে ব্যাটিং করতে হবে। তামিমকে এমন কথা বলেছিলেন, বিসিবির শীর্ষ পর্যায়ের কেউ। অথচ দলের পরিকল্পনার কথা তাকে জানানোর কথা হয় অধিনায়ক না হয় কোচের। নিরাপদ অবস্থানে থাকতে সেই কথা তারা কেউই বলেননি যা স্বীকার করে নিয়েছেন সাকিব নিজেও।
সাকিবের সাক্ষাৎকার: বিশ্বকাপে ভরাডুবির দায় সাকিব নিজেও কাঁধে নিতে পারেন। বিশ্বকাপ থেকে আসার আগে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনার পেছনে ছিলেন সাকিব নিজেও। অধিনায়ক নেতা হতে পারেননি। নেতা হলে দল সামলে নিতেন খুব ভালোমতোই। তামিম ইকবালকে ব্যাটিং অর্ডারে পরিবর্তনের কথা কোচ বা অধিনায়ক বাদে অন্য কেউ বলা বেমানান। কারণ, পরিকল্পনাটা দলের। সেখানে তামিমকে জানিয়েছিলেন, বোর্ডের শীর্ষ মহলের কেউ। যা নিশ্চিতভাবেই যেকোনো ক্রিকেটারের জন্য বিব্রতকর। দলের প্রয়োজনে অধিনায়কের যা করার দরকার ছিল সেদিকে না হেঁটে উল্টো আগুনে ঘি ঢেলেছেন। সাক্ষাৎকারে, এক সময়ের প্রিয় বন্ধুকে বানিয়েছেন খলনায়ক। স্বার্থপর, টিমম্যান নন বলতেও দ্বিধা করেননি। দলে যে বিভাজন রেখা তৈরি হয়েছে সেটা সাকিব নিজেও নিশ্চিত নন। ‘হতেও পারে’ বলে মত দিয়েছেন।
তৃতীয় ওপেনার নেই, নেই বাড়তি ব্যাটসম্যানও: তামিমের জায়গায় বিশ্বকাপ দলে নেওয়া হয় তানজিদ হাসান তামিমকে। ওপেনিংয়ে লিটনের সঙ্গী তানজিদ। কোনো তৃতীয় ওপেনার নেই। সঙ্গে নেই কোনো বাড়তি ব্যাটসম্যান। তাইতো সাকিব আঙুলের চোটে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে গেলে দেশ থেকে উড়িয়ে নেওয়ার প্রয়োজন হয় এনামুল হক বিজয়কে। ওপেনিং জুটি বিশ্বকাপে ছিল একেবারেই নিষ্প্রভ। কোনো শতরানের জুটি নেই। ফিফটির আছে কেবল দুটি। তাতেই যেন সব ওলটপালট। শুরুর দিকে ব্যাটসম্যানরা দায়িত্ব নিতে না পারায় পরের দিকে পুষিয়ে নিতে পারেনি টিম ম্যানেজমেন্ট। এবারের বিশ্বকাপে যারা ওপেনিংয়ে নেমেছেন তাদের প্রায় প্রত্যেকেরই সেঞ্চুরির ব্যক্তিগত ইনিংস আছে। অস্ট্রেলিয়ার ওয়ার্নার, পাকিস্তানের ফখরের, ভারতের রোহিতের, আফগানিস্তানের ইব্রাহিম জাদরান, নিউ জিল্যান্ডের ডেভন কনওয়ে ও দক্ষিণ আফ্রিকার কুইন্টন ডি কক। ওপেনিং থেকে সেঞ্চুরির কোনো ইনিংস আসেনি শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ ও নেদারল্যান্ডসের। তারা কেন পয়েন্ট টেবিলের তলানিতে তার আরেকবার প্রমাণ মিলে গেল।
ব্যাটিং অর্ডার নিয়ে ছেলেখেলা! বাংলাদেশের ব্যাটিং অর্ডার নয়, যেন ভাগ্য খোলার মঞ্চ! রবি শাস্ত্রী পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচে ধারাভাষ্যের সময় বেশ কটাক্ষ করেই বলেছেন, ‘আমার মনে হচ্ছে বাংলাদেশ দলের ড্রেসিংরুম একটা ঝুঁড়ি আছে। যেখানে সব ব্যাটসম্যানের নাম আলাদা করা কাগজ রয়েছে। প্রত্যেকে ওখান থেকে কাগজ উঠায়। যার নাম আসে সে-ই চলে আসে ব্যাটিংয়ে।’ ব্যাটিং অর্ডারে ক্রমাগত রদবদলে বাংলাদেশে ভরাডুবির বড় প্রভাব রেখেছে। এক-দুইটি পজিশনে অদলবদল হয়ে ব্যাটিংয়ের চিত্রটাই পাল্টে গেছে। লিটন ও তানজিদ কেবল ওপেনিং করেছেন একসঙ্গে। বাকিদের প্রত্যেককে বিভিন্ন পজিশনে, বিভিন্ন পরিস্থিতিতে খেলিয়ে বাজিয়ে দেখা হয়। অথচ বিশ্বকাপ ছিল না পরীক্ষার কোনো মঞ্চ। এখানে জেতাই ছিল আসল। আর জিততে হলে, সফলতা পেতে হলে যার পজিশন যেখানে সেখানে ব্যাটিং করা যে গুরুত্বপূর্ণ ছিল তা উঠে আসে শান্তর কণ্ঠে, ‘আমরা যেভাবে এসেছিলাম ওই জায়গায় যদি একই রকম থাকতো (ব্যাটিং অর্ডার) ভিন্ন কিছু হলেও হতে পারতো। আমার মনে হয় না যে, ওইটা হলেই যে আমরা সফলতা পেয়ে যেতাম। এটাও ঠিক না। আবার একই রকম থাকলেও সফলতার পরিমাণটা অনেক সময় বেশি থাকে। তাই পরিবর্তন না করলেই ভালো।’
মিরাজের ব্যাটিং অর্ডার: বিশ্বকাপ মঞ্চে সবচেয়ে বেশি টানাটানি হয়েছে মেহেদী হাসান মিরাজকে নিয়ে। আফগানিস্তানের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে ৩ নম্বরে ব্যাটিংয়ে নেমে ৫৭ রান করেন। পরের ম্যাচে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে পাঁচে। এরপর নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে তিনে, ভারতের বিপক্ষে চারে। সেখান থেকে এক লাফে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সাতে। পরের ম্যাচে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে তিনে আসার পর থেকে লেট অর্ডারে শেষ তিন ম্যাচে ব্যাটিং করেছেন মিরাজ। লাহোরে আফগানিস্তানের বিপক্ষে টপ অর্ডারে নেমে সেঞ্চুরি পাওয়ায় তার ওপর আস্থা অর্জন করেছিল টিম ম্যানেজমেন্ট। ওই দলের বিপক্ষেই পরিকল্পনা স্থির ছিল। কিন্তু বাকিদের বিপক্ষে সব ওলটপালট। তাতে কোনো সুফলও মেলেনি। ৯ ম্যাচে ২০১ রান করেছেন ২২.৩৩ গড়ে।
সাকিবের নেতৃত্বের ঘাটতি: বিশ্বকাপে সাকিবের নেতৃত্বের ঘাটতি প্রবলভাবে ফুটে উঠে। মাঠে দল চালাতে অধিনায়ক যে হিমশিম খাচ্ছিলেন তা বোঝা গেছে। নানা সময়ে, নানা পরিস্থিতিতে যেখানে যে পরিকল্পনা বাস্তবয়ান করার কথা তা পারেননি। সঙ্গে অধিনায়কের যে নেতা হওয়া প্রয়োজন ছিল সেটাও হতে পারেননি। অফফর্মে যারা ছিল তাদের পিঠ চাপড়ে প্রেরণা দিতে পারেননি। কেননা অধিনায়ক নিজেই সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, ‘জাতীয় দলের হয়ে বিশ্বকাপ খেলছে প্রেরণার জন্য এতোটুকুই যথেষ্ট।’ বিশ্বকাপ থেকে ছুটি নিয়ে সাকিব তিনদিনের জন্য দেশে ফিরেছিলেন। নাজমুল আবেদীনের সঙ্গে কাজ করবেন এ জন্য। প্রবল সমালোচনায় বিদ্ধ হওয়ায় একদিনের অনুশীলন বাতিল করে দলের সঙ্গে যোগ দেন। যুদ্ধে নেমে অধিনায়কের সাফল্যহীনতা ভালো দেখায় না। সামনে ভালো সুন্দর দিন অপেক্ষা করছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
সাকিবের চোট দুইবার: একে তো রান নেই। প্রত্যাশামাফিক উইকেটও নেই। সঙ্গে যোগ হয় চোট ইস্যু। দল ভালো না করার পাশাপাশি বিশ্বকাপে অধিনায়ক সাকিবের সময়টাও বেশ খারাপভাবে কেটেছে। ভারতের বিপক্ষে ম্যাচের আগে তার ঊরুতে চোট দেখা যায়। তাতে ছিটকে যান পুনেতে ভারতের বিপক্ষের ম্যাচে। শান্ত দেন নেতৃত্ব। শেষ ম্যাচেও সাকিবের অনুপস্থিতিতে তার কাঁধেই পড়ে দায়িত্ব। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচজয়ী ইনিংস খেলার পথে সাকিবের আঙুলে বল আঘাত করে। পরে নিজে সেই আঙুল সোজা করে ব্যাটিং করে দলকে জিতিয়েছিলেন।
আড়ালে থেকে অগোছালো: বৈশ্বিক ক্রিকেট মানে কেবল ব্যাট-বলের যুদ্ধ নয় বরং মাঠ ও মাঠের বাইরে ক্রিকেটটাকে ছড়িয়ে দেওয়া। যেখানে বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের আড়াল রাখার এক প্রয়াস চলছে! টুর্নামেন্ট শুরুর আগে ক্রিকেটারদের জন্য অলিখিত নিয়ম যেন বানিয়ে দেন টিম ম্যানেজমেন্ট। গণমাধ্যমের সামনে কথা নয়! এর ব্যাখ্যায় টিম ডিরেক্টর খালেদ মাহমুদ বলেছিলেন, ‘মনোযোগটা ক্রিকেটেই থাকুক। তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি ম্যাচের আগে একজনই কথা বলুক।’ এছাড়া টানা ম্যাচ হারের পর ক্রিকেটাররাও যেন বিমর্ষ হয়ে পড়েন। বাংলাদেশের মতো ম্যাচ হেরেছে ইংল্যান্ডও। অথচ তাদের ক্রিকেটাররা ছুটি পেলেই এই শহরে ঘুরে বেড়িয়েছেন। ওই পাহাড়ে ট্র্যাক করেছেন। সেখানে বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা কেবল নিজেদেরকে আড়ালে রেখে আরও অগোছালো করেছে পরিবেশ, পরিস্থিতি।
অধিনায়ক-কোচেই আলোচনা শেষ! চণ্ডিকা হাথুরুসিংহে নিজের প্রথম মেয়াদে নিজের সিদ্ধান্ত বাদে শোনেননি কারো কথা। অনেক সময় অধিনায়ককেও নিজের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে বাধ্য করেছেন। দ্বিতীয় মেয়াদেও হাথুরুসিংহে পরির্বতন হননি। এখনও দলে তার প্রভাব অটল। পরির্বতন, সিদ্ধান্তের প্রশ্নে তার নামের পাশেই বসে যায় ফুলস্টপ। সেখানে খালেদ মাহমুদ সুজন কিংবা শ্রীধরণ শ্রীরামের অবদান বলতে গেলে শূন্য। খালেদ মাহমুদ সরাসরি বলতে চাননি। তবে যেভাবে বলেছেন তাতে স্পষ্ট দলে তার অবদান সামান্যই, ‘অধিনায়ক পেশাদার। কোচ পেশাদার। তারা অভিজ্ঞ। সব সিদ্ধান্ত তারাই নিচ্ছেন। বাড়তি ইনভলবমেন্টের দরকার হচ্ছে না।’ হাথুরুসিংহে নিজের একচ্ছত্র আধিপত্যে এবার পাশে পেয়েছেন কেবল সাকিব আল হাসানকে। তাদের দুজনের আলোচনাতেই হচ্ছে সব সিদ্ধান্ত। এরপর পরিকল্পনা। বাকিরা স্রেফ এখানে দর্শক! দলের সহ-অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্তর কথায় তা উঠে আসে, ‘কোচ ও অধিনায়ক সব বলতে পারবেন। উনারাই সব সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন।’
‘এখন না হলে আর কখন’ স্লোগানে বিশ্বকাপে যে দলটি সেমিফাইনাল খেলার স্বপ্ন নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল তারা পথ থেকে ছিটকে যায় নিজেদের বিবর্ণ পারফরম্যান্সে। নিজেদের লক্ষ্যে তো পৌঁছাতে পারেননি বরং নিজেদের সবচেয়ে বাজে বিশ্বকাপের অপবাদ গায়ে মাখিয়েছেন।