জয়ের সুবাস তখন ছড়িয়ে পড়েছে মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়েতে। গোটা গ্যালারি নীল সমুদ্র। অফিসিয়াল ঘোষণা, ৩২,৮০১ জন প্রবেশ করেছে স্টেডিয়ামে। তার মধ্যে ছিঁটেফোটা ব্ল্যাকক্যাপসদের সমর্থন। বাকিরা তো টিম ইন্ডিয়া, বিরাট আর রোহিতদের জন্যই হাজির।
ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে থাকা মেরিন ড্রাইভে জটলা। যারা টিকিট পায়নি তারা কেবল স্কোরে চোখ বুলিয়েই আনন্দে মেতেছেন। আরও একবার ভারত বিশ্বকাপের ফাইনালে। এই রোমাঞ্চের, এই উত্তেজনার, এই উন্মাদনার সাক্ষী না হলে কী চলে? একটু পরপর কানে ভাসছে, ‘বান্দে মাতারাম।’ নয়তো ‘চাক দে ইন্ডিয়া।’ সঙ্গে ডিজের কণ্ঠে, ‘জিতেগা ভাই জিতেগা, ইন্ডিয়া জিতেগা।’
এই উৎসব, এই আনন্দযজ্ঞকে মাঠের ১১ জন রাঙিয়ে দেন ফাইনালের টিকিট নিশ্চিত করে। দুই আসর পর সেমিফাইনালের গেরো ছুটিয়ে ভারত আরেকটি শিরোপার দ্বারপ্রান্তে। টানা পাঁচ সেমিফাইনাল খেলা নিউ জিল্যান্ড শেষ দুই আসরে খেলেছিল ফাইনাল। এবার পথ আটকে গেলে সেরা চারে।
ওয়াংখেড়েতে ভারত আগে ব্যাটিং করে ৪ উইকেটে ৩৯৭ রানের বিশাল পুঁজি পায়। নিউ জিল্যান্ড চোখে চোখ রেখে লড়াই করলেও রানের পাহাড় টপকাতে পারেনি। ৩২৭ রানে শেষ তাদের ইনিংস। ৭০ রানের জয়ে অপরাজিত থেকে ফাইনালের টিকিট পেল ভারত। তাদের প্রতিপক্ষ কে হবে নিশ্চিত হয়ে যাবে বৃহস্পতিবার। ইডেনে দ্বিতীয় সেমিফাইনাল খেলবে অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকা।
ভারতের জয় তো যেমন তেমন ঘটনা। প্রথম পর্বে টানা নয় জয় পাওয়ায় তাদের থেকে প্রত্যাশা ছিল আকাশচুম্বি। যা তারা পূরণ করেছে বড় জয় দিয়েই। এই ম্যাচটা ইতিহাসের পাতায় সাক্ষী হয়ে থাকবে বিরাট কোহলির কীর্তিতে। ওয়ানডে ক্রিকেটের প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে পঞ্চাশতম সেঞ্চুরির অনন্য নজির গড়েছেন বিরাট। শচীন টেন্ডুলকারের ৪৯তম সেঞ্চুরির রেকর্ড ভেঙে সেঞ্চুরির শৃঙ্গে উঠেছেন বিরাট। সঙ্গে বিশ্বকাপের এক আসরে শচীনের করা ৬৭৩ রানের রেকর্ড ভেঙে ৭১১ রান তুলে আরেকটি মাইলফলক পেরিয়েছেন। ১১৭ রানের ইনিংসটিতে ম্যাচসেরার পুরস্কারের পাশাপাশি ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় অর্জনকে সঙ্গী করেছেন বিরাট।
ব্যাটিংয়ে বিরাট যেমন রাঙিয়েছেন, বোলিং মোহাম্মাদ শামি ছিলেন আগুনে। বিশ্বকাপের নকআউট পর্বে প্রথম বোলার হিসেবে নিয়েছেন ৭ উইকেট। ৭২৪ রানের ম্যাচে ৭ উইকেটের অর্জন নিশ্চিতভাবেই বিশেষ কিছু। অসামান্য অর্জনে ম্যাচসেরার পুরস্কার উঠেছে তার হাতে। বিরাটকে ছাপিয়ে তার বোলিংয়ের কীর্তিকে উচিঁয়ে ধরায় আইসিসিরও ধন্যবাদ পাওয়া উচিত।
বিশাল লক্ষ্য তাড়া করার জন্য যেরকম শুরুর প্রয়োজন নিউ জিল্যান্ড তেমনটা পায়নি। দুই ওপেনার ডেভন কনওয়ে ও রাচীন রবীন্দ্র ড্রেসিংরুমে ফেরেন মোহাম্মদ সামির বলে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিয়ে। সেখানে থেকে প্রতি আক্রমণে গিয়ে ড্যারিল মিচেল দলকে লড়াইয়ে রাখেন। তাকে দারুণ সঙ্গ দেন কেন উইলিয়ামসন। ৩০ ওভারে দুজন ১৯৯ রান তুলে নেওয়ায় মনে হচ্ছিল কিউইরা ম্যাচটা তাড়া করে জিততেও পারবে।
কিন্তু পরের ৫ ওভারে যেভাবে ভারত ঘুরে দাঁড়াল তাতে ম্যাচটা আবার তাদের নাগালে চলে আসে। মোহাম্মদ শামি ফিরে উইলিয়ামসনকে ফেরান ৬৯ রানে। সেখানে ভাঙে উইলিয়ামসন ও মিচেলের গড়া ১৪৯ বলে ১৮১ রানের জুটি। এক বল পর তার শিকার টম লাথাম। ওই ৫ ওভারে মাত্র ২৪ রান দিলে নিউ জিল্যান্ডের আসকিং বেড়ে ১৭ পেরিয়ে যায়। তার ওপর নতুন ব্যাটসম্যান গ্লেন পিলিপস থিতু হতে সময় নিয়েছিলেন। ১২ বলে করেন ১ রান। পরে ঝড় তুললেও তা যথেষ্ট ছিল না। নিউ জিল্যান্ডের আশা ছিল কেবল মিচেলকে ঘিরে। সেঞ্চুরি পাওয়া এ ব্যাটসম্যানই পারেন জেতাতে এমন বিশ্বাস ছিল। কিন্তু জয়ের থেকে ৯২ রান দূরে থাকতে তিনি আউট হলে ব্ল্যাক ক্যাপসদের সব আশা শেষ হয়ে যায়। শেষ দিকে ভারতের বোলিংও ছিল দুর্দান্ত। সামির সঙ্গে হাত ঘুরিয়ে কুলদীপ ৪২ ও ৪৪তম ওভারে দেন যথাক্রমে ২ ও ৪ রান। তুলে নেন ১ উইকেট। সঙ্গে বুমরাহ, সিরাজও ছিলেন নিয়ন্ত্রিত। তাদের ফিল্ডিংও ছিল দারুণ। সীমানায় কঠিন সময়ে জাদেজা ফিলিপস, মিচেল ও চ্যাম্পমানের ক্যাচ নিয়ে কাজটা সহজ করে দেন।
টস নিয়ে রোহিত শর্মার তেমন চিন্তা ছিল না। আগের দিনই জানিয়ে দিয়েছিলেন, ওয়াংখেড়ের উইকেট কেমন ব্যবহার করবে তা খুব ভালোভাবে জানেন তিনি। তবুও টস যখন জিতে যান তখন মুখে হাসি ফুটেছিল তার।
বিরাটের ৫০তম ওয়ানডে সেঞ্চুরি ও শ্রেয়াস আইয়ারের টানা দ্বিতীয় সেঞ্চুরিতে ভর করে ভারত বিরাট পুঁজি পায়। তাদের সেঞ্চুরির ইনিংসটি সাজানো ছিল রোহিত শর্মার শুরুর ঝড়ের ওপর। এরপর শুভমান গিল দলের রান এগিয়ে নেন। শেষ দিকে ঝড় তোলেন লোকেশ রাহুল। ভারতের টপ অর্ডারের ব্যাটসম্যানের নান্দনিক ব্যাটিংয়ে রানের পাহাড়ে চড়ে বসে টিম ইন্ডিয়া।
রান তোলায় রোহিতকে সেলফিস হতে বলেছিলেন প্রাক্তন ক্রিকেটাররা। নিজের উইকেটের মায়া করে খেলতে বলেছিলেন। কিন্তু কিসের কি? আক্রমণাত্মক রোহিত বড় রানের সুর তুলে দেন শুরুতেই। ২৯ বলে ৪টি করে চার ও ছক্কায় করেন ৪৭ রান। তার ক্যামিও ইনিংস যখন উইলিয়ামসনের দুর্দান্ত ক্যাচে থামে তখন ভারতের রান ৮.২ ওভারে ৭১। সেখান থেকে শুভমান গিল টেনে নেন দলের রান। বিশ্বকাপের প্রথম সেঞ্চুরির পথে ছিলেন এ ব্যাটসম্যান। ৬৬ বলে তুলে নেন ৮০ রান। কিন্তু তার ইনিংসটি থেমে যায় পায়ের টানে।
ক্রিজে তখন বিরাট। তার সঙ্গে যোগ দেন শ্রেয়াস। শুরু হয় দুজনের তাণ্ডব। প্রায় প্রতি ওভারেই বাউন্ডারি। রান রেট ৭ এর নিচে নামে না। কখনো চলে যায় আটের কাছাকাছি। পেসার কিংবা স্পিনার যারাই এসেছেন চার-ছক্কার জোয়ারে পরেছেন। বিরাটের সঙ্গে ব্যাটিং মানেই ফিটনেসের পরীক্ষা দেওয়া। রানিং বিটিউন দ্য উইকেটে কুইক হওয়া। শ্রেয়াসের তেমন কিছু অবশ্য পছন্দ নয়। তাইতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছক্কা উড়িয়েছেন সাউদি, স্যান্টনার আর রাচীনকে।
বিরাট এগিয়ে যাচ্ছিলেন নিজের ছন্দে। নিজের পঞ্চাশতম সেঞ্চুরি তোলার পথে তার সামনে বাধা হয়ে আসতে পারেনি কেউ। ৫৯ বলে ফিফটি তোলার পর সেঞ্চুরি তুলে নেন ১০৬ বলে। শচীনের মাঠ ওয়াংখেড়েতে তার উপস্থিতিতে তাকে ছাড়িয়ে যাওয়ার আনন্দ ছুঁয়ে যায় বিরাটের। ৫০তম সেঞ্চুরি করে তাই ক্রিকেট আদর্শকে কুর্ণিশ করে সম্মান জানান। পুরো গ্যালারিতে তখন কোহলি কোহলি চিৎকারে গমগম করছিল। শচীনও চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে করতালিতে অভিনন্দন জানান বিরাটকে। এমন দিনটিই তো ভারতের ব্যাটিং ঈশ্বর দেখতে চেয়েছিলেন বহুকাল আগে।
ভারতের ব্যাটিংয়ে যে পরিকল্পনা ছিল তা বোঝা গেছে স্পষ্ট। প্রথম পাওয়ার প্লে’তে ৮৪ রান তোলার পর পরের ২০ ওভারে রান করে যথাক্রমে ৬৬ ও ৬৪ করে। এরপর শ্রেয়াস ও বিরাট যখন ব্যাটিংয়ে ছিল তখন ১০ ওভারে তোলে ৭৩। ৪০ ওভারে তাদের রান ১ উইকেটে ২৮৭। সেখান থেকে বিরাট সেঞ্চুরি পেয়ে যান। শ্রেয়াস তিন অঙ্কে পৌঁছে যান মাত্র ৬৭ বলে। ৪ চার ও ৮ ছক্কায় সাজানো ইনিংসটি ছিল ১৫০ স্ট্রাইক রেটে। আর দলের হয়ে সর্বোচ্চ রান করা বিরাট করেন ১১৭ রান। ৯ চার ও ২ ছক্কা ছিল তার ইনিংসে।
ভারত শেষ ১০ ওভারে ১১০ রান তুলে নেয়। যা দলের পুঁজিকে আরও বড় করে তোলে। যার কৃতিত্ব দিতে হবে রাহুলকে। মাত্র ২০ বল খেলার সুযোগ পেয়ে ৩৯ রান করেন ৫ চার ও ২ ছক্কায়। তাতেই নিউ জিল্যান্ডের সামনে পাহাড় সমান লক্ষ্য।
মাঠে নামার আগে বাড়তি সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ উঠে ভারতের বিপক্ষে। শেষ মুহূর্তে উইকেট পরিবর্তন হয়েছে বলেই খবর প্রকাশ পায়। আইসিসি জানিয়েছে, পূর্বনির্ধারিত পিচ বাদ দিয়ে ভিন্ন পিচে খেলা চালানো নতুন কিছু নয়, অস্বাভাবিকও নয়। পিচ চূড়ান্তকরণের বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট ধারা নেই। যে ভেন্যুতে খেলা হবে, তারা ম্যাচের সম্ভাব্য সেরা পিচ ও আউটফিল্ড দেখে খেলার ব্যবস্থা করে। সব আলোচনা থামিয়ে দিতে এতোটুকুই যথেষ্ট নয়?
বিরাট ও সামির ইতিহাস গড়া ম্যাচ জিতে ভারত আরেকটি বিশ্বকাপের ফাইনালে। ১৯৮৩ সালের পর ২০১১ সালে শিরোপা জিততে ভারতে লেগেছিল ২৮ বছর। এক যুগ পর আবার তারা ফাইনালে। কপিল দেব, মাহেন্দ্র সিং ধোনির পর রোহিতের হাতে কি শিরোপা উঠবে? উত্তরটা জানতে অপেক্ষা করতে হবে ১৯ নভেম্বর পর্যন্ত। বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে সেদিনই ভাঙবে মিলনমেলা।