দ্রুত হাতে প্লেটে ভাত বাড়ে সাফিয়া। ভাতের একপাশে তরকারি দিয়ে, ডাল দেয় মাঝখানে। ছোট বেঞ্চটাতে বসার জায়গা পায়নি বলে, থালা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়েই খাচ্ছে অনেকে। খেতে থাকা লোকগুলোর মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করে সে, খেয়ে তৃপ্তি পাচ্ছে কি না লোকগুলো?
দুপুরবেলা ভিড় এমনিতেই বেশি থাকে। আজকে যেন অন্যদিনের চেয়ে বেশিই মানুষ খেতে এসেছে। ভাত বেড়ে দিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারছে না সাফিয়া। রিকশাওয়ালা, ঠেলাওয়ালা, ভ্যানচালকেরা তো আছেই- প্রতিদিনের মতো। আজকে পাশের বিল্ডিং-এর অফিসের লোকেরাও খাচ্ছে। আসলে ওরা পাশের যে হোটেলটায় খায়, সেটা কেন জানি বন্ধ আজ। সে কারণেই তার ফুটপাতের দোকানে এত ভিড়।
তা ভিড়ে খুশিই সাফিয়া। খরিদ্দার বেশি এলে কোন বিক্রেতা না খুশি হয়? আজকে বোধহয় তার রান্না করে আনা ভাতে কুলাবে না। ভাতের পাতিলে অর্ধেক ভাতও নেই। অন্যদিন পড়ন্ত বেলা পর্যন্ত খাবারে চলে। আজ যারা দাঁড়িয়ে আছে, তারা সবাই খাবার পায় কি না সন্দেহ। আহা, প্রতিদিন যদি এমন ভিড় হতো। বেচা-বিক্রি হতো মেলা। আয়টা বাড়ত। হয়তো বাড়তো কষ্টও। বেশি ভাত, বেশি তরকারি মানে বেশি খাটুনিইতো। তাহলেও, লাভওতো হতো বেশি।
কামরাঙ্গীর চরে নাকি আগুন লাগছে? খেতে খেতে একজন পাশের জনকে জিজ্ঞেস করে। সব ঘর-বাড়ি পুইড়া ছাই। মানুষজনও পুড়ছে কিছু? কেমনে লাগলো আগুন? আরেকজন প্রশ্ন করে। শুনলাম, কেমিকেলের গোডাইনেত্থে লাগছে। কথা শুনে কান খাড়া করে সাফিয়া। চিন্তায় পড়ে যায় সে। তার বাসাটাতো কামরাঙ্গীর চরেই। আগুন কি অই দিকেই লাগল? একবার গিয়ে দেখে আসবে নাকি?
আগুন সত্যিই লাগলে মহাবিপদ! তার তিন তলার বাসাটা কাঠের। যে বাড়িতে ভাড়া থাকে তার পুরোটাই আসলে সস্তা ধরণের হালকা কাঠ দিয়ে তৈরি। আগুন ছুঁলে অই বাড়ি ছাই হতে সময় লাগবে না। নিচের দুতলায় কেউ থাকে না। পুরনো সব রাবারের জিনিসপত্র, নষ্ট টায়ার, পুরনো জুতা স্যান্ডেল রেখে তালা দিয়ে রাখা হয়। ভাড়া কম বলেই অই বাসাতে আছে সাফিয়া। নচে ওটা ঠিক বাসাও না, বসবাসের যোগ্যও না। পানি আনতে হয় দূর থেকে। বাথরুম পায়খানা সব নিচে। আগুন লাগলে যে কেউ ছেলে আর তার বাপকে বাঁচাবে, সে সম্ভাবনাও কম। আসলে অই বাসাতে যে তারা ভাড়া থাকে, অনেকে হয়তো জানেই না।
এত এত মানুষকে খাবার বেড়ে দিচ্ছে সাফিয়া, কিন্তু তার ঘরের লোকদের কাছে বসিয়ে যে দুটো খাওয়াবে, সেটা ভাগ্য নেই তার। বের হওয়ার আগে ছেলে আর স্বামীর জন্য খাবার রেঁধে ঢেকে রেখে আসে। মমিন খেয়ে ছেলেকেও খাওয়ায়। আজ বাপ ছেলে খেলো কিনা? চিন্তা করতে করতে ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সাফিয়া।
ছেলেটার বয়স নয় বছর। জড়ভরত। প্রতিবন্ধী। জন্মের পর থেকেই হাত পা ছোট ছোট। হাঁটতে বা ধরতে- কিছুই পারে না। যেখানে শুইয়ে রাখা হয় কী বসিয়ে দেওয়া হয়, সেখানেই থাকে। সব কাজ তার করে দিতে হয়। কপাল এমন, ছেলেটা যেদিন হলো, তার তিনদিন পরে ট্রাকের ধাক্কায় রাস্তায় ছিটকে পড়ে হাঁটুর নিচ থেকে দু-পা কাটা গেল বাপের। এখন হাঁটুর উপর ভর করে হাঁটে সে। আসলে হাঁটে না, চলে। তবু, সাফিয়া বের হলে অই পঙ্গু মমিনই ছেলের ভরসা।
মমিন রিকশা চালাত। আয় মন্দ ছিলো না। এখন ঘরেই আছে নয় বছর ধরে। সংসার চলে সাফিয়ার আয়ে। কাটা পা নিয়েই মমিন চলে ছেচড়ে ছেচড়ে। ছেলেকে খাওয়ায়। নিজে খায়। সংসারের টুকিটাকি কাজ করে।
খরিদ্দারের ভিড়ে চিন্তা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না সাফিয়ার। প্লেট ধুয়ে দাঁড়িয়ে আছে কজন। তাদের যত্ন করে ভাত-তরকারি বেড়ে দেওয়ায় মন দেয়। আর চিন্তা করে-ই-বা কী লাভ? নিশ্চয়ই স্বামী সন্তান খেয়ে নিয়েছে। যেমন খায় আর সব দিন। সাফিয়ার অনুপস্থিতিতে তাদেরতো বাঁচতে শিখতে হবে। তারা যতটা পারে আত্মনির্ভরশীল হোক। অবশ্য এতদিনে অভ্যস্ত তারা হয়েও গেছে। বাঁচতে শিখছে, ছোট ঘরটাতে আটকে থেকেই। তাহলেও, মনের চিন্তাটা যেতে চায় না সাফিয়ার।
রাস্তার পাশে ফুটপাথ দখল করে চারটা কাঠের বেঞ্চ নিয়ে ভাতের দোকান। অতি নিম্ন আয়ের লোকেরাই মূলত খেতে আসে এখানে। পুলিশের ঝামেলা সামলে, নেতাদের ধরে দোকান টিকিয়ে রাখতে শিখে গেছে সাফিয়া। সকালে বাসা থেকে ভাত, ডিম ভুনা, পাতলা ডাল, আলু ভর্তা, কলমি কী পুঁইশাক, পাঙ্গাস বা সস্তার কোন মাছ রেঁধে নিয়ে আসে। পড়ন্ত দুপুর পর্যন্ততাই বেচে, শূন্য হাড়ি-পাতিল নিয়ে ফেরার পথে ভাত বেচা টাকা থেকে কিছু টাকা দিয়ে পরের দিনের রান্নার জন্য বাজার করে।
সাফিয়া উঠে সেই ফজরের আযান দিলে। উঠে নামাজ পড়ে। ছেলেটার হাত মুখ ধোয়ায়। প্রস্রাব পায়খানা করায়। মাছ তরকারি কুটা বাছা আর গোছগাছ শেষে রান্না করে, ছেলে-স্বামীকে খাইয়ে, নিজে খেয়ে তৈরি হতে হতে বের হওয়ার সময় হয়ে যায়। রোজের ভ্যানওয়ালা আছে। সে সময় মতো হাজির হয় প্রতিদিনই। সব নিয়ে পৌঁছতে পৌঁছতে প্রায় বারোটা বাজে। পৌঁছতে না পৌঁছতেই লোকজন চলে আসে খেতে। তার কিছু বাঁধা লোক আছে। তারাই আগে বসে। হয়তো তার হাতের রান্নার গুণে বা তিরিশ টাকায় এত ভালো খাবার আশেপাশে পায় না বলেই সাফিয়ার দোকানে এত ভিড়। তার রান্নার স্বাদে আকৃষ্ট হয়ে আজকাল কিছু ভদ্রগোছের লোকও খেতে আসতে শুরু করেছে। যেমন আজ।
গোডাউনে বলে ড্রাম ভর্তি এসিড আছিল? তার থাইক্যা আগুন লাগছে। আরে এসিড না, গোডাউনে গ্যাসের সিলিন্ডার আছিল। খেতে খেতে লোকগুলো আগুনের আলাপ করেই যাচ্ছে। চিন্তাটা বাড়ে সাফিয়ার। আগুন লাগাটা যদি গুজব হয়ে থাকে, তাহলে হুট করে দৌড় দেওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। একা মানুষ সে। হাড়ি-পাতিল, খাবার-দাবার কার কাছে রেখে যাবে? ঢাকা শহর বড় খারাপ জায়গা। এখানে নিজেকে ছাড়া কাউকে বিশ্বাস করা যায় না। ফেলে গেলে সব লুট হতে দু মিনিটও লাগবে না। এখানে তার এমন কোন বান্ধবও নেই যার কাছে সব রেখে যাবে।
আবার আগুন যদি সত্যিই লাগে, তাহলে বাপ ছেলের কেউ-ই নিজে নিজে তিন তলা থেকে কাঠের সরু সিঁড়ি বেয়ে নামতে পারবে না। ছেলেতো চলতেই পারে না। তার শরীরটা আবার কমাস আগে থেকে হঠাৎ করে অস্বাভাবিক মোটা হয়ে গেছে। ডাক্তার দেখিয়েও কাজ হয়নি। ডাক্তার বলেছে, শুয়ে থাকে বলেই এ অবস্থা। এখন বাবার চেয়ে ছেলের ওজন বেশি।
ভাবতে ভাবতে আকাশের দিকে চোখ যায় সাফিয়ার। কামারাঙ্গীচরের আকাশও দেখে। সে আকাশে ঝলকে ঝলকে ধোঁয়া উঠছে। সাফিয়া আর আগপিছ ভাবে না। আগে জীবন। তারপরে হাড়ি পাতিল। সে বাসার দিকে হাঁটা দেয়। ২. আগুনের লাল জিভ ঘর-বাড়ি-মানুষ খেয়ে যেন আকাশ খেতে যাচ্ছে! চারপাশ দাউ দাউ জ্বলছে। রাস্তার লাগোয়া ছোট দোকানটাতে ব্রয়লার মুরগি বিক্রি করতো লোকটা। তার কাছ থেকে কতবার মুরগি কিনেছে সাফিয়া। এখনো তার কাছ থেকে লোকটা সাতশ টাকা পাবে। মুরগিগুলোর সাথে পুড়ে কয়লার মতো হয়ে গেছে মালিকও। লোকজন কালো দেহটাকে রাস্তায় এনে ফেলে রেখেছে। মানুষ বলে চেনার উপায় নেই। যেন বড় কোন কয়লার টুকরা। দেখে শরীর কেঁপে উঠে সাফিয়ার। পোড়া মাংসের গন্ধে গা গুলায় তার।
আগুনটা লাগছে, হোটেলের গ্যাস সিলিন্ডার ফাইট্যা গিয়া। পাশেই আছিল ক্যামিকেলের ড্রাম ভর্তি তালা দেওয়া দোকান। কেমিকেলের কারণেই আগুন দৌড়াইছে। চাপা গলির কারণে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি আসতে পারতাছে না, আগুন নিভাইতে। গাড়ি আসতাছে, তয় ঘুইরা। সময় লাগবো। লোকজন নানান কথা বলছিল। কারো কথাই যেন কানে যায় না সাফিয়ার। সে অস্থিরভাবে হাঁটতে থাকে। লোকজন হইহই করে তাকে বাধা দিতে আসে। তবু আগুনের ভেতর দিয়েই কোন মতে সরু কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে পারে সাফিয়া। চারপাশেই জ্বলছে আগুন। উত্তাপ লাগছে গায়ে। কাপড়ের কোণায় কখন আগুন ধরে গেছে তার। হঠাৎ প্রবল ভয় গ্রাস করে তাকে। সবাইকে নিয়ে নিরাপদে নামতে পারবে তো? নিচের ঘরের মালামালে আগুন ধরে গেলে নামবে কীভাবে?
চিন্তা করে নষ্ট করার মতো সময় হাতে নেই। সাহস সঞ্চয় করে, আঁচলের আগুন নিভিয়ে তিনতলায় উঠে যায় সাফিয়া। ঘরে এখনো আগুন পুরোপুরি পৌঁছায়নি। ভেতরে বাপ-বেটা দুজন ভয়ে কাঁপছে। তাকে দেখে এক সাথে শব্দ করে উঠে ওরা। যাক, অক্ষতই আছে দুজন।
দ্রুত ঘরের কোণায় গিয়ে, কাঠের বাক্সে খুলে বাড়ি থেকে আনা গলার চেনটা আর জমানো কিছু টাকা নিজের কোমরের কাছে শাড়ির কোণায় বাঁধে সাফিয়া। চৌকি, টেবিল, হাড়ি পাতিল এসব নামানোর সময় নেই। আগে মানুষ।
নিচের ঘরের মালামালে বোধহয় আগুন ধরেই গেছে। কাঠের পাটাতনের নিচে গরমটা টের পাওয়া যাচ্ছে। আন্দাজ করা যায়, আগুন ধেয়ে আসছে উপরে। দেখতে দেখতে ঘরের দরজার কাছেও চলে আসবে আগুন। একবার নিচে নেমে আবার উপরে উঠা সম্ভব না। ততক্ষণে আগুন পুরো ঘরে ছড়িয়ে যাবে। যা করার একবারেই করতে হবে। আগুন ঘরের বেড়া ছুঁল বলে! পুরো ঘর ধোঁয়ায় ভরে উঠছে। অনেক কষ্টে কাশি আটকে রাথে সাফিয়া। অসহায় মানুষের চিৎকার আর পোড়া গন্ধে ভয়টা বেড়ে যায় তার। কেমন বমি বমি লাগে।
কী করবে, সাফিয়া ঠিকমত ভাবতে পারছিল না। অস্থিরভাবে একবার ছোট ঘরটার কোণে গিয়ে, আবার দরজার কাছে যায়। স্বামী আর ছেলে জড়সড়ো হয় বসে আছে ঘরের মাঝে। বাপ ছেলে এমনভাবে জড়াজড়ি করে আছে, যেন তাদের শীত লাগছে। অথচ, ঘর ভর্তি গরম।
জানালার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে সাফিয়া। প্রাণপণে। মানুষের সাহায্য চায়। কিন্তু বৃথা। তার চিৎকারে কেউ সাড়া দেয় না। তাকে উপরে উঠতে বাধা যারা দিয়েছিল, তারা কোথায় গেল কে জানে! কেউ উপরে এলেতো বড় উপকার হতো সাফিয়ার। কী জানি, তারা হয়তো নিজেদের ঘরের আগুন নেভাতেই ব্যস্ত।
মমিন ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরে কেমন কাঁপছে। মমিনই তাদের রক্ষা করার কথা। অথচ, ভাগ্যের মারে সে এখন সাফিয়ার মুখের দিকে চেয়ে আছে। বোবা ছেলেটার চোখে প্রবল আতঙ্ক। বোধবুদ্ধিহীন হলেও, সে বিপদ ঠিকই বুঝেছে।
হঠাৎ সাফিয়া বুঝতে পারে, ভয়ঙ্কর বিপদে পড়েছে সে! তার সামনে অগ্নিপরীক্ষা! তার এখন কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আগে হয় ছেলে, না হয় স্বামী। অথচ, হাতে সময় খুবই কম। আগুন বোধহয় চালেও ধরেছে। মাথার উপর তাপ বাড়ছে। ঘরটা মোটেই মজবুত নয়। সস্তার কাঠ আর পাতলা টিন দিয়ে তৈরি। ভেঙে পড়তে পারে যে কোনো সময়।
স্বামী সন্তান দুজনেই দৃষ্টিতেই প্রত্যাশা। চোখ করকর করে ওঠে সাফিয়ার। তবে, বেশিক্ষণ ভাবে না সে। কয়েক মুহূর্ত। তারপরই মনস্থির করে। কাছে গিয়ে ছেলেকে কোলে নিয়ে বিছানায় শোয়ায়। তারপর স্বামীকে বাচ্চাদের মতো কাঁধে ঝুলিয়ে পা বাড়ায়।
তুমি আগে ছেলেটারে নামাও। মমিন সাফিয়ার পিঠ থেকে নেমে পড়তে চায়। সাফিয়া স্বামীর হাত টেনে ধরে রাখে। না, আগে তুমি নাম। ছেলের লাইগ্যা আবার আসমু। বলতে বলতে পেছনে ফিরে তাকায় সাফিয়া। বিছানায় শান্ত হয়ে বসে আছে ছেলেটা। চোখের জলে ছেলের অবয়ব আবছা লাগে তার কাছে। চোখের জল, নাকি আগুনের বেড়া আড়াল করেছে ছেলেকে? দ্বিধান্বিত সাফিয়া চোখ ফিরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নামতে থাকে। দু ধাপ নামতেই, সিঁড়ির নিচের ধাপগুলো অদৃশ্য হয়ে যায়। সামনের কিছুই দেখতে পায় সাফিয়া। বুকটা হঠাৎই শূন্য হয়ে যায় তার। অপত্য স্নেহ যেন দু-পা পেছন থেকে টেনে ধরেছে।
তার অচল ছেলেটা আগুনে পুড়ে মরবে? অত কষ্ট সয়ে যাকে জন্ম দেওয়া, নয় নয়টা বছর তিলে তিলে বড় করা, সে আগুনে পুড়ে কয়লা হবে? দ্রুত পায়ে উপরে উঠে, সাফিয়া মমিনকে কাঁধ থেকে নামিয়ে বিছানার দিকে ছেলের কাছে যেতে গিয়েও থেমে যায়।
ছেলেটা অই প্রান্ত থেকে একটু এগিয়ে এসেছে বিছানার দিকে। সাফিয়া তাকাতেই দুহাত বাড়ায়। ক্ষণিকের তরে সাফিয়ার চোখের সামনে থেকে লেলিহান আগুন অদৃশ্য হয়ে যায়। চোখের সামনে ভেসে উঠে ছোট একটা চৌকি, পাশে সদ্যোজাত সন্তান। প্রসবজনিত ব্যথার রেশ তখনো তার শরীরে। ছেলে না মেয়ে প্রসব করেছে করেছে সে, তখনো তাকে বলেনি দাই। দাই সন্তানকে তার মুখের কাছে শোয়াতেই সাফিয়া চুমু খায় তার গালে, কপালে। কেমন একটা গন্ধ শিশুটার গা থেকে তার নাকে প্রবেশ করে। সে গন্ধে তার শরীরের সমস্ত কষ্ট নিমিষেই নাই হয়ে যায়।
আজ হঠাৎই যেন গন্ধটা আবার পায় সাফিয়া। তার নাড়িছেঁড়া ধন আশা নিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। ছেলেটার পেছনে ঘরের বেড়াতে আগুন জ্বলছে। হয়তো আগুনের আঁচ লাগছে ছেলের গায়েও। তাহলেও, সে ছেলের উপর থেকে চোখ ফিরিয়ে তাকায় মমিনের দিকে।
মমিনও কি এতক্ষণ তাকিয়ে ছিল তার দিকে? সাফিয়া তাকাতেই চোখে চোখ পড়ে। দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে থাকে নির্ণিমেষ। এক কী দু মুহূর্ত কাটে। চোখ সরিয়ে সাফিয়া ফের তাকায় ছেলে দিকে। এই করতে করতে অতি মূল্যবান আরো কয়েক মুহূর্ত সময় নষ্ট হয়।
মমিনকে ছাড়া বেঁচে থাকাটা অর্থহীন হবে সাফিয়ার। মমিনই তার নিঃশ্বাসের বাতাস। মমিনই তার শ্বাস! বাপ-মা-ভাই-বোন সবাইকে সে তাকে ত্যাগ করেছে মমিনকে ভালোবেসে। ধর্ম ছেড়ে, শান্তিরাণী থেকে হয়েছে সাফিয়া। যদিও এসব নিয়ে তার কোনো আফসোস নেই। অচল স্বামী, অথর্ব সন্তান, গরিবী দশা নিয়েও অসুখী নয় সাফিয়া। বরং, ওদের খুশি করার জন্য সংগ্রাম করে সুখই পায় সে।
চারপাশের আগুনটা বাড়ছেই। প্রবল তাপে দাঁড়িয়ে থাকাই দায়। সাফিয়া মনে মনে দ্রুত দূরত্ব মাপে। স্বামী সন্তানের ঠিক মাঝখানে সে দাঁড়িয়ে আছে। যা করার দ্রুতই করতে হবে। ভেবে সময়ই নষ্ট হচ্ছে। সাফিয়ার মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছে। পায়ের তলায় কাঠের পাটাতান কাঁপছে। চোখের জলে সব কিছু ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে যেন। কিন্তু তবু, সামনে পা বাড়ায় সে।
পা যেন কোন অতলে পড়ে সাফিয়ার। শাঁই শাঁই করে নিচের দিকে পড়তে থাকে সে!