বাংলাদেশ হাউজে আসতে আমাদের মিনিট পাঁচেক সময় লাগল। এবারই প্রথম আমি কাঠমান্ডুতে বাংলাদেশ হাউজে এলাম। মিল্লাত ভাইয়ের সঙ্গে যেহেতু এসেছি, তাই গেইটের নিরাপত্তা কর্মীকে আর আমার পরিচয় দিতে হলো না। প্রবেশের পর বাসার সামনে ডান পাশে সবুজ ঘাসে মোড়ানো ফাঁকা জায়গা। চারপাশেই ছোটবড় গাছ। সেখানেই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
চারপাশে সারিবদ্ধভাবে চেয়ার রাখা হয়েছে। ক্যাটারিং সার্ভিসের কর্মীরা খাবার প্রস্তুত করছে অতিথিদের জন্য। রাষ্ট্রদূত সালাউদ্দিন নোমান চৌধুরী দাঁড়িয়ে থেকে তদারকি করছেন। তার দিকে এগিয়ে যেতেই আমাকে দেখে হাসিমুখে এগিয়ে এলেন। আমি সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কেমন আছেন? আমার দিকে হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, আমি ভালো আছি। আপনি এসেছেন, খুশি হয়েছি। মোর্শেদ, শাকিল তোমার সাথেই থাকছে নাকি? মিল্লাত ভাই বললেন, জি স্যার। আমার বাসাতেই রেখেছি। স্যার বললেন, ভালো করেছেন। এতো বড় একটা সাহসী কাজ করছে, আমাদেরও তো তার পাশে থাকা দরকার। শাকিল শুকিয়ে গেছে, ভালো ভালো খাবার খাওয়াবেন। কথাটি বলেই আমার কাঁধে হাত রেখেই আমার অভিযান সম্পর্কে জানতে চাইলেন। আমিও উৎসাহ নিয়ে বলতে শুরু করলাম।
পড়ুন দ্বিতীয় পর্ব : দোগারি পর্বতে বাংলাদেশের প্রথম অভিযান
আজকের এই আয়োজন ফুটবল দলের জন্য কাঠমান্ডুতে নেপালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সালাউদ্দিন নোমান চৌধুরীর বাসভবনে পুরো স্কোয়াডের বিশেষ আয়োজন। রাষ্ট্রদূতের বাসভবন বাংলাদেশ হাউজে বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দলের সব খেলোয়াড়, কোচিং স্টাফ ও কর্মকর্তারা নৈশভোজে অংশগ্রহণ করবে। এখনো তারা এসে পৌঁছায়নি। টুর্নামেন্টের শেষে আজকের দিনটাই পেয়েছে বিশ্রামের জন্য। আগামীকাল দেশে ফিরে যাবে। তাই আজ সবাই বেরিয়েছে কাঠমান্ডু শহর ঘুরে দেখতে এবং কেনাকাটা করতে।
সন্ধ্যার পরে মাসুদ স্যার পুরো টিম ও টিমের কর্মকর্তাদের নিয়ে বাংলাদেশ হাউজে এলেন। শুধু অধিনায়ক সাবিনা খাতুন এলেন আরো আধ ঘণ্টা পরে। সবাইকে অভ্যর্থনা জানালেন সালাউদ্দিন নোমান চৌধুরী স্যার, ইশরাত জাহান ম্যামসহ বাংলাদেশ দূতাবাসের অন্যান্য কর্মকর্তা। জার্মান রাষ্ট্রদূত ড. থমাস প্রিন্জ ও মিসেস প্রিন্জও এসেছেন। অনুষ্ঠানে সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে সালাউদ্দিন নোমান চৌধুরী সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন ও টুর্নামেন্টের চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় সবাইকে অভিনন্দন জানান। কথা বললেন, জার্মান রাষ্ট্রদূত, কোচ গোলাম রাব্বানী ছোটন, টিম ম্যানেজার এবং অধিনায়ক সাবিনা খাতুন।
অনুষ্ঠানে সালাউদ্দিন নোমান স্যার আমাকে ও আমার অভিযান গুরুত্বসহকারে সবার সামনে তুলে ধরেন। তিনি বলেন, মেয়েরা যেমন ইতিহাস গড়ে সাফ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে তেমন বাংলাদেশের সাহসী তরুণ পর্বতারোহী ইকরামুল হাসানও আছেন আমাদের মাঝে। সে হিমালয়ে এমন এক অভিযানে আছেন যেটা পৃথিবীর মাত্র কয়েকজন মানুষ সফলভাবে শেষ করতে পেরেছে। আশাকরি সেও এই অভিযান সফলভাবে শেষ করে পর্বতারোহণে ইতিহাস গড়বে। অনুষ্ঠান শেষে সবাই নৈশভোজে যোগ দিলেন। এরপর গিফট বক্স দেওয়ার পালা। সবশেষে আমরা মেতে উঠলাম নাচ-গানে।
আজ ২৩ সেপ্টেম্বর শুক্রবার। আমি কাঠমান্ডুতে মিল্লাত ভাইয়ের বাসায় আছি। ঢাকায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী হলে বাংলা মাউন্টেনিয়ারিং অ্যান্ড ট্রেকিং ক্লাব (বিএমটিসি) এর সংবাদ সম্মেলন হলো সকাল দশটায়। ফেসবুক লাইভে সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠান দেখছি। বাংলাদেশ-নেপালের কূটনৈতিক সম্পর্কের সুবর্ণজয়ন্তীতে ৬ হাজার ৫৩৬ মিটার বা ২১ হাজার ৪৪৩ ফুট উঁচু ‘দোগারি হিমাল’ শৃঙ্গে প্রথমবারের মতো দুই দেশের পতাকা ওড়াতেই এই অভিযানে অংশ নিচ্ছে দুই দেশের আট পর্বতারোহী। এই পর্বত চূড়ায় এখন পর্যন্ত কেউ অভিযান করেনি। এটাই প্রথম কোনো অভিযান হতে যাচ্ছে। যে কারণে এই অভিযানের গুরুত্ব অনেক বেশি।
বাংলাদেশের চার পর্বতারোহী এবং নেপালের চার পর্বতারোহী এই অভিযানে অংশ নিচ্ছেন। বাংলাদেশ দলের নেতৃত্ব দেবেন দু’বারের এভারেস্ট আরোহণকারী এম এ মুহিত। বাকি তিন সদস্যের মধ্যে বাহলুল মজনু বিপ্লব, রিয়াসাদ সানভী এবং কাঠমান্ডু থেকে আমি যোগ দেব। চার সদস্যের নেপাল দলের নেতৃত্বে আছেন বিখ্যাত পর্বতারোহী ও গাইড কিলু পেম্বা শেরপা। বাকি তিনজন হলেন তামটিং শেরপা, আংডু শেরপা এবং নিমা নুরু শেরপা। এ অভিযানটি বাংলা মাউন্টেইনিয়ারিং অ্যান্ড ট্রেকিং ক্লাব ও ইমাজিন নেপাল যৌথ অভিযান। অনুষ্ঠানে ব্র্যাকের চেয়ারম্যান ও অর্থনীতিবিদ ড. হোসেন জিল্লুর রহমান আমাদের উৎসাহ দিয়ে বক্তব্য রাখলেন। নেপালের রাষ্ট্রদূত ঘনশ্যাম ভান্ডারীও আমাদের উৎসাহ দিয়ে অনেক কথা বললেন। পুরো অনুষ্ঠানটি ফেসবুক লাইভে বসে বসে দেখলাম এবং অতিথিদের উৎসাহমূলক কথায় অনুপ্রাণিত হলাম।
অক্টোবরের তিন তারিখ ঢাকা থেকে মুহিত ভাই, বিপ্লব ভাই ও সানভী ভাই কাঠমান্ডুতে আসার কথা। কিন্তু বিমানের টিকেট জটিলতায় তাদের আসার তারিখ পিছিয়ে সাত অক্টোবর পর্যন্ত যায়। এদিকে বাংলাদেশের প্রথম এভারেস্ট আরোহণকারী নারী পর্বতারোহী নিশাত মজুমদার পৃথিবীর অষ্টম উচ্চতম পর্বত শিখর ৮ হাজার ১৬৩ মিটার উচ্চতার মানাসলু পর্বতে অভিযানে আছেন। এ বছর মানাসলুর আবহাওয়া ভয়াবহ রকমের খারাপ যাচ্ছে শুরু থেকেই। একাধিক পর্বতারোহী ও শেরপার মৃত্যু দেখে ফেলেছে পর্বতারোহীরা। প্রতিদিন তুষার ঝড়, তুষার ধ্বস হয়েই চলছে। হাতে গোনা কয়েকজন পর্বতারোহী শুধু চূড়া স্পর্শ করতে পেরেছেন। বাকি সবাই অভিযান স্থগিত করে ফেরার পথ ধরেছেন। প্রতিদিন এসব নিউজ দেখে ভয় হচ্ছে। নিশু আপু কেমন আছেন, তিনি কি নিরাপদে আছেন কিনা? দিনদিন আবহাওয়া শুধু খারাপই হচ্ছে।
তিন অক্টোবর নিশু আপুসহ ইমাজিন নেপালের সকল পর্বতারোহী ও শেরপা হেলিকপ্টারে কাঠমান্ডুতে ফিরে আসেন। দাওয়া শেরপার কাছ থেকে আমি প্রতিদিন মানাসলুর খোঁজ নিচ্ছিলাম। তার কাছ থেকেই জানতে পারি নিশু আপুদের ফিরে আসার কথা। রাতেই নিশু আপুর হোয়াটস অ্যাপে মেসেজে জানিয়ে রাখলাম আমি এখন কাঠমান্ডুতে আছি। সকালে আপনার হোটেলে আসতেছি। দেখা হবে আপু।