সাতসতেরো

তারাশঙ্কর গবেষক অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী

‘বাংলা ভাষাতেই আমি যেন মুক্তির আনন্দ খুঁজে পাই, আমার মনন, চিন্তা আর জীবনজুড়ে রয়েছে এই বাংলা।’ অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী মূলত সাহিত্য-গবেষক, সমালোচক। সিলেট শহরের সুরমা নদীর তীর ঘেঁষা তোপখানায় তার জন্ম ১৯৫৭ সালের ৩০ নভেম্বর। পিতা ছিলেন সিলেটের শিক্ষাবিদ অবনিকান্ত চৌধুরী, মা পারুলদেবী সততই চিন্তিত ছিলেন পুত্রের শিক্ষা নিয়ে। যদিও পারিবারিক শিক্ষার আবহ ভীষ্মদেবকে সেই ছেলেবেলা থেকেই অনুপ্রাণিত করেছিল বাংলার শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতি। 

প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত তাঁর শিক্ষাজীবন অতিবাহিত হয়েছে সিলেট শহরে। স্নাতক সম্মান এবং স্নাতকোত্তর অধ্যায়ন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্যবাহী বাংলা বিভাগে (১৯৭৬-৮২)। উভয় পর্যায়ের পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অর্জন করেন তিনি।

‘তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস : সমাজ ও রাজনীতি’ শিরোনামে অভিসন্দর্ভের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একাডেমিক পরিষদ ১৯৯৫ সালে তাঁকে পিএইচডি ডিগ্রি প্রদান করে। ভীষ্মদেব চৌধুরীর শিক্ষকতা দিয়ে চাকরি জীবনের সূচনা ১৯৮৪ সালে এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই। বর্তমানে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক। অধ্যায়ন, পাঠদান ও গবেষণাতেই ভিষ্মদেবের কর্মধারা কেন্দ্রীভূত। তিরিশোত্তর বাংলা কথাসাহিত্য, রবীন্দ্র ছোটগল্প, এবং বাংলাদেশের সাহিত্য ছিল তাঁর পাঠদান, চিন্তা-চর্চা আর লেখার প্রধান বিষয়। সৃষ্টিমূলক মূল্যায়নধর্মী সাহিত্য গবেষণায় ও বিবেচনায় তিনি স্বছন্দ ও সফল। 

স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশের রুপকার বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরে ১৯৭৮ সালে যখন বঙ্গবন্ধুর নাম নেয়াটাও নিষিদ্ধ, সেই সময় দাঁড়িয়ে তিনি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রকাশিত প্রথম কবিতা-ছড়ার সঙ্কলন ‘এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়’-এর অন্যতম উদ্যোক্তা ও সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ২০১০ সাল অবধি তিনি বাংলাদেশের এশিয়াটিক সোসাইটির পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্বভার সামলেছেন।  পাশাপাশি তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান। বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য। সাহিত্য, জগৎ-জীবন বিষয়ক পত্রিকা অন্তর্দেশ-এর সম্পাদক ও প্রকাশক। তাঁর সম্পাদিত একটি স্মরণীয় পত্রিকা ‘প্রভাতসূর্য: রবীন্দ্রনাথ সার্ধশত জন্মবর্ষ স্মরণ’ সংখ্যাটি। সম্পাদিত অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে তারাশঙ্কর স্মারকগ্রন্থ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় : শতবার্ষিকী স্মরণ, আবদুল গফফার চৌধুরী : নির্বাচিত গান, আহমদ রফিক সম্মাননা গ্রন্থ ইত্যাদি। 

তাঁর রচিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ জগদীশ গুপ্তের পত্র, পঙ্ক ও পঙ্কজ (১৯৮৮), বাংলাদেশের সাহিত্য গবেষণা ও অন্যান্য, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস : সমাজ ও রাজনীতি (১৯৯৮), তারাশঙ্কর স্মারক গ্রন্থ (২০০১)।

ব্যক্তি অধ্যাপক ভীষ্মদের চৌধুরীর সাথে আমার প্রথম সাক্ষাৎ ১৯৯৯ সালের মার্চ মাসে উনি তখন এক শিক্ষকের সাথে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে রিফ্রেসার্স কোর্সে বাংলাদেশের সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করতে এসেছিলেন। একই সময় তার সহকর্মী অধ্যাপক রফিক উল্লাহ খান এবং ভাষাসৈনিক আহমদ রফিকও কলকাতায় কবি মঞ্জুষ দাসগুপ্তের আমন্ত্রণে কলকাতার বাংলা একাডেমির জীবনান্দ সভাগৃহের আর একটি অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। আমার উপরে দায়িত্ব পরে সেদিন সন্ধ্যাবেলা কলেজ স্ট্রীটের মহাবোধী সোসাইটির অতিথিশালা থেকে অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরীকে নিয়ে আসার। 

কলেজ স্ট্রীট থেকে রবীন্দ্র সদন যাত্রা পথে হলুদ ট্যাক্সিতে বসে মন দিয়ে সিলেট সম্পর্কিত বিভিন্ন গল্প শুনেছিলাম তার মুখ থেকে। পরবর্তী সময় ১৯৯৯ সালে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ সফরে গিয়ে এপ্রিলের ১৫ তারিখ তাকে দেখেছিলাম আরো কাছ থেকে। সেই সময়েই বুঝেছিলাম তাঁর বাংলাদেশের প্রতি প্রেম ও ভালোবাসা। বুঝেছিলাম তাঁর রাজনৈতিক চিন্তা ও চেতনা বাংলাদেশ ভারত তথা সমগ্র এই উপ মহাদেশ নিয়ে। বুঝেছিলাম তিনি একজন প্রকৃত বাম আদর্শে বিশ্বাসী এবং একজন আপোসহীন মানুষ। বিভিন্ন সময় বাংলাদেশে গিয়ে পরবর্তী সময় জেনেছিলাম ছাত্র অবস্থায় তিনি কীভাবে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শিশু-কিশোর সংগঠন খেলাঘরের সাথে জড়িয়ে পরেন। সেই ছাত্রাবস্থায় থেকে এখন অবধি তিনি কীভাবে এই সংগঠনের মাধ্যমে শিশু-কিশোরদের শারীরিক, মানসিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশের ক্ষেত্রে নিরলস কাজ করে শিশু-কিশোরদের ভবিষ্যতের যোগ্য এবং সচেতন নাগরিক গড়ে তোলার পথে সব ভালো কাজের একনিষ্ঠ অংশীদার হয়ে আছেন সেইসব গল্প।

অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী প্রকৃত শিক্ষকের পাশাপাশি সৌখিন মানুষ। তিনি একদিকে যেমন কঠিন তাঁর ছাত্রদের সামনে, পাশাপাশি তিনি চায়ের কাপে তুফান তুলতে পারেন ছাত্রদের সঙ্গেও। তিনি একদিকে যেমন খাদ্যরসিক আবার অন্যদিকে পরিবারের প্রতি দায়িত্ববান। ২০০১ সালে একত্রে কুমিল্লা ভ্রমণের সময় এবং পরে ২০০৬ সালে কলকাতায় কিংবা ২০০৮ সালে দিল্লিতে আমি নিজের চোখে সাক্ষী থেকেছি। এর পাশাপাশি তাঁর ভারত তথা আসামের বরাক উপত্যকা এবং ত্রিপুরার প্রতি এক গভীর ভালোবাসা রয়েছে। এ বছর ২৯শে জুন বরাক উপত্যকার হাইলাকান্দি শহরে হাইলাকান্দি রোটারি ক্লাবের দ্বারা আয়োজিত এক ঘরোয়া আড্ডায় তাঁর মুখ থেকে শোনা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় মাত্র ৯ বছর বয়সে কিভাবে এই ছোট্ট জনপদে পরিবারের অন্যদের সাথে তিনি তাঁর পিসির বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন, সেই স্মৃতি কথা শুনতে শুনতে উপস্থিত সকলেই আবেগপ্রবণ হয়ে পরেছিলাম। 

তিনি উচ্চকণ্ঠে বলতে পারেন ‘হতাশ না হওয়ার শক্তি। কোনো পরিস্থিতিতেই হতাশা আমাকে গ্রাস করতে পারে না। আজকের তুলনায় আগামী দিনটি সুন্দরতর হবে- এই বিশ্বাসের ওপর ভর করে চলি। আমার প্রয়াত পিতার কাছ থেকে পাওয়া শিক্ষা। আমার কোনো আক্ষেপ নেই, আমি পরিতৃপ্ত মানুষ।’ 

আজ তাঁর ৬৫তম জন্মদিন। তাঁর দীর্ঘায়ু কামনা করছি। আশারাখি আগামী অবসর জীবনে তাঁর হাত থেকে আরো অনেক বেশি নতুন তথ্যসমৃদ্ধ লেখার মাধ্যমে আমরা করবো আমাদের জ্ঞানভাণ্ডার পরিপূর্ণ।