মতামত

নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে কথা শুরু

শুরু করি শিক্ষার নামে নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে যে ডামাডোল শুরু হয়েছে, তা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে যে মূল দ্বিধাদ্বন্দ্বে ফেলে দিয়েছে তা হলো এই, নতুন শিক্ষাক্রম আসলে কী? ভালো না মন্দ? এই দ্বিধাদ্বন্দ্বের সাথে যুক্ত হয়েছে আতঙ্ক। বিশেষত  আমাদের মতো মধ্যবিত্তদের, যাদের দেশের এই প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা ছাড়া গত্যন্তর নেই আমরা পড়েছি মহাবিপদে। যারা সন্তানদের দেশে লেখাপড়া করানোর কথা ভাবেন না তারা আর যারা প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়াকেন্দ্রিক জীবন ও জীবিকাকে জীবনের সাফল্য হিসেবে বিবেচনা করেন না তাদের এই পরিবর্তন, রূপান্তর নিয়ে না ভাবলেও চলে। কিন্তু দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ, নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত, যারা নিজের জীবনের বঞ্চনা, হতাশা অপ্রাপ্তি নিয়ে সন্তানকে কেন্দ্র করে মরণপণ করে বসেন সফল হবেন, তারা পড়েছেন মহাবিপদে।

মহাবিপদে পড়ারই কথা। আমাদের আজন্ম দেখে আসা, অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আসা শিক্ষা পদ্ধতির আমূল রূপান্তর এই নতুন শিক্ষাক্রম। সম্পূর্ণ অপরিচিত এই শিক্ষা পদ্ধতির গতি প্রকৃতি দেখে আমরা হতবিহ্বল। এর প্রধান কারণ এই যে আমরা অধিকাংশই এই শিক্ষা পদ্ধতির ভবিষ্যৎটা দেখতে পারছি না। আমাদের ভবিষ্যৎ চিন্তা তো এখনো পরীক্ষার ভালো ফল, ভালো ভর্তি পরীক্ষা কিংবা চাকরির ভালো ইন্টারভিউ আর সন্তানকে দেশের বাইরে প্রতিষ্ঠিত করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ফলে আমরা আদৌ নিশ্চিত নই এই শিক্ষা আদতেই আমাদের সন্তানদের জন্য কার্যকরি  হবে নাকি হবে না। মূলত এই শিক্ষাপদ্ধতি শিক্ষাক্রমের কোনো পরিমার্জন বা পরিবর্ধন নয়। বরং আমূল-পরিবর্তন। পরিবর্তনটা উত্তর মেরু দক্ষিণ মেরু।

ধাক্কাটা কোথায় ধাক্কাটা একেবারে উৎসে। আমরা বর্তমানে যে শিক্ষা পদ্ধতিতে আছি তা মূলত বৃটিশ আমলে প্রণীত। বৃটিশরা তথাকথিত আধুনিক শিক্ষার গোড়াপত্তন করেছিল তাদের স্বার্থে। স্কুল কলেজ স্থাপনের মাধ্যমে ইংরেজি থেকে অনুবাদের মাধ্যমে নেটিভদের তারা শিখিয়ে পড়িয়ে নেওয়ার আয়োজন করেছিল। এটা তারা করেছিল সম্পূর্ণ তাদের শাসনকার্য মসৃণ রাখার স্বার্থে। দুঃখজনক হলেও সত্যি আমরা উনিশ-বিশ পরিবর্তন ছাড়া কমবেশি সেই শিক্ষাক্রমটাকেই ধরে রেখেছি। এই শিক্ষাক্রম প্রমথ চৌধুরীর ভাষায় অনেকটা দর্জির দোকানে এক মাপে কাটা জামার মতো। শিক্ষার্থীর আগ্রহ, প্রবণতা, সামর্থ্য, ক্ষমতা ইত্যাদি কোনকিছুকেই যেখানে কোন গুরুত্ব দেওয়া হয় না। নির্ধারিত পাঠ্যবই, পাঠ্যসূচি এবং পরীক্ষা ও নাম্বারকেন্দ্রিক মূল্যায়ন পদ্ধতি। বর্তমান শিক্ষা পদ্ধতি বলতে গেলে এর সম্পূর্ণ রূপান্তর। এখানে প্রতিটি শিক্ষার্থীর ব্যক্তি মেধা, আগ্রহ ও মূল্যায়নের সুযোগ রয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে এক দুই নাম্বার বেশি পাওয়ার প্রতিযোগিতা করার কোনো সুযোগ নেই। বসে বসে পড়া মুখস্থ করার আয়োজন নেই। পরীক্ষার হলে তিন ঘণ্টা পারফরম্যান্স এর ওপর জীবনের সব সাফল্য ব্যর্থতা নির্ভর করে নেই।

আজ যিনি পরিণত বয়স্ক, যিনি তারুণ্যে, বৃদ্ধ কিংবা বৃদ্ধা, অভিভাবক এবং শিক্ষক সবাই আজন্ম যে পরীক্ষা পদ্ধতি দেখে এসেছেন, লেখাপড়ার প্রক্রিয়া দেখে এসেছেন তা সমূলে উৎপাটনের এই আয়োজন মেনে নেওয়া কঠিন বটে। অনভ্যস্ত দৃষ্টিতে আমরা যেখানে একটা অন্যরকম পোশাকই মেনে নিতে পারি না, সেই জায়গায় শিক্ষা ব্যবস্থার এই আমূল পরিবর্তন আমাদের স্রোতে গা ভাসিয়ে রাখা জনতার পক্ষে মেনে নেওয়া কেবল কঠিন বললে কম বলা হয়। বরং বলা ভালো অসম্ভবই।

কী ছিল প্রচলিত শিক্ষাপদ্ধতি এ নিয়ে বিশদ কিছু বলার নেই। আমরা সবাই কমবেশি জানি। মুখস্থ বিদ্যানির্ভর, পরীক্ষা নির্ভর এই শিক্ষা পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীর মুখস্থ বিদ্যা ছাড়া আর কোনো পারদর্শিতার তেমন মূল্যায়ন নেই।  সৃজনশীল পদ্ধতির নামে বেঞ্জামিন  ব্লুম প্রবর্তিত যে শিক্ষা পদ্ধতি প্রবর্তন করা হয়েছিল, এক দশকের মধ্যেই তা অকার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। এই সৃজনশীল পদ্ধতির নাম ছিল মূলত কাঠামোগত পদ্ধতি। যা আমাদের শিক্ষাবিদগণ সৃজনশীল পদ্ধতি নামে প্রচলন করেছিলেন। এতে  শিক্ষার্থীর মস্তিষ্কের  ১.কগনিটিভ ডোমেইন, ২.সাইকো মোটর ডোমেইন ৩.এফেক্টিভ ডোমেইন এই তিন ভাগের ওপর নির্ভরশীল শিখন পদ্ধতি। ব্যাপারটি মোটামুটি শিক্ষা মনোবিজ্ঞাননির্ভর ছিলো।

কিন্তু পাঠ্যসূচির সীমাবদ্ধতা, পরীক্ষায় মূল্যায়নের সীমাবদ্ধতা, সিস্টেম বা অবকাঠামো গত সীমাবদ্ধতা, শিক্ষকদের পারদর্শিতার অভাব ইত্যাদি নানাবিধ কারণে এই পদ্ধতি বৃটিশ আমলের মুখস্থবিদ্যা নির্ভর আর নাম্বার ভিত্তিক মূল্যায়ন থেকে খুব একটা আলাদা কিছু হয়নি। গ্রেডিং সিস্টেম চালু করে ২/৪ নাম্বারের পার্থক্যে মেধা যাচাইয়ের পদ্ধতি অস্বীকার করার চেষ্টা করা হলেও তার থেকে বের হওয়া যায়নি।  সেই গৎবাঁধা পড়ার চাপ, পরীক্ষা ভীতি, নাম্বার পাওয়ার ইদুর দৌড় কিছুরই কোন পরিবর্তন হয়নি। শিশুদের আনন্দময় শৈশব কৈশোর গিলে খাওয়া সিস্টেমের বিন্দুমাত্র পরিবর্তন ঘটানো যায়নি সৃজনশীল পদ্ধতিতে। বোঝা যাচ্ছে এ নিয়ে আমাদের শিক্ষার নীতি নির্ধারক রা দূরদর্শিতার পরিচয় দিতে পারেননি।

এই সৃজনশীল পদ্ধতির সবচেয়ে বড় ত্রুটি হলো, এতে শিক্ষার্থীদের মানসিক চাপ কমার বদলে আরও বেড়ে যায়। ফলে কোচিং সেন্টার আর প্রাইভেট টিউটরদের প্রয়োজনও উত্তোরত্তোর বেড়ে যায়। জিপিএ ফাইভ নামক এক সোনার হরিণের পেছনে দৌড়াতে থাকে অভিভাবক কুল। হ্যাঁ, অভিভাবককুল, যাদের পিছু তাড়ার ফলে শিক্ষার্থীদের সেই দৌড়ে সামিল না হয়ে উপায় থাকে না।

কী নেই নতুন শিক্ষাক্রমে কী আছে জানার আগে জানি, নতুন শিক্ষাক্রমে কী নেই। সবার আগে নেই গৎবাঁধা পরীক্ষা। সকাল বিকাল বসে বসে পড়া মুখস্থ করার তাড়া নেই। কোচিং কিংবা প্রাইভেট শিক্ষকের প্রয়োজন একেবারেই নেই।

নতুন শিক্ষাক্রমে গণিত পরীক্ষার দিন যেকোনো স্কুলে ঢুকে দেখবেন ছেলেরা স্কুল মাঠে ফুটবল খেলছে। তাদের পরীক্ষা খারাপ হওয়ার ভয় নেই, সূত্র ভুলে যাবার আতঙ্ক নেই। এই দৃশ্য দেখে ব্যক্তিগতভাবে আমার খুব ভালো লাগে। কারণ প্রতিবার পরীক্ষার আগে আমার বাচ্চাদের যে মানসিক চাপ আমি দেখেছি, আমার ইচ্ছে হতো এদের বলি আর পরীক্ষা দিতে হবে না। আমার সামর্থ্য থাকলে আমি ওদের এই জাঁতাকলে তাদের পিষ্ট হতে দিতাম না। রাতজাগা পড়া, তিন ঘণ্টার মরণপণ যুদ্ধের প্রস্তুতি... এই শিক্ষাক্রম আমাদের লক্ষ লক্ষ সন্তানের আত্মার শক্তিকে ধ্বংস করেছে। তাদের শৈশব কৈশোর যৌবনের আনন্দ কেড়ে নিয়ে তাদের ঠেলে দিয়েছে ক্যারিয়ারমুখী দৌড়ে। যার উপজাত হিসাবে জন্ম নিয়েছে নকল, প্রশ্নফাঁস, নাম্বার অর্জনের অসুস্থ প্রতিযোগিতা। নতুন শিক্ষাক্রম এসব অসুস্থতার বিরুদ্ধে একটি মূর্তিমান প্রতিবাদ।

কী আছে নতুন শিক্ষাক্রমে সবই আছে, ভাষা, গণিত, বিজ্ঞান সবই। শিক্ষার্থী ভাষা ও সাহিত্য পড়বে। সাথে পড়বে যোগাযোগের প্রক্রিয়া। প্রাজ্ঞ অভিভাবক বলতেই পারেন, এতকাল কী মানুষ একে অপরের সাথে যোগাযোগ করেনি? করেছে। কিন্তু পারিবারিক শিক্ষা না থাকলে, আপনার আমার সন্তান শ্রমজীবী মানুষকে তুচ্ছার্থক সর্বনামে সম্বোধন করেছে। আর আমাদের বেশিরভাগ পরিবারের পারিবারিক শিক্ষাই তো এই প্রজন্মকে তৈরি করেছে। যারা অন্তঃসত্ত্বা নারীকে বসার আসন ছেড়ে দিতে শিখেনি। অপরকে ঠকিয়ে যেন তেন ভাবে নিজে বড় হওয়াকেই বড় বলে জেনেছে। বিপদে পড়া মানুষকে সাহায্য না করে গা বাঁচিয়ে পালিয়ে যায়।

গণিত, বিজ্ঞান কিংবা ইংরেজি ইত্যাদি জ্ঞানমূলক বিষয়গুলোর যেকোনো বই হাতে নিয়ে তুলনা করবেন, পরীক্ষা পদ্ধতি বাদ দিলেও আগের পাঠ্যসূচি থেকে এই পাঠ্যসূচি কোনদিকে অনুন্নত? অযথা কান নিয়েছে চিলের পেছনে না দৌড়ে আসুন না তথ্য প্রমাণ নিয়ে কথা বলি।

নতুন শিক্ষাক্রমে নতুন যে বিষয় যুক্ত হয়েছে এবং যেগুলো নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা সেগুলো হলো ১.জীবন ও জীবিকা। ২.স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা। ৩. শিল্প ও সংস্কৃতি। মূলত এই বিষয়গুলো নতুন সংযুক্ত। এই বিষয়গুলো ছাড়া অন্য বিষয়গুলো সবই আছে। বদলেছে পড়া, পড়ানো আর মূল্যায়নের পদ্ধতি।

ইদানিং যে সোশ্যাল মিডিয়া উত্তাল, তা মূলত এই তিনটি বিষয় নিয়েই। যেখানে ছাত্ররা ডিমভাজি কিংবা আলু ভর্তা বানিয়ে জীবনের জন্য আবশ্যিক কিছু বিষয় শিখছে। সম্প্রতি আমার সন্তানদের বাইরে পড়তে দিয়ে টের পাচ্ছি এই বিষয়গুলো শিখে যাওয়া কত জরুরি ছিলো এদের জন্য। আমরা আহ্লাদী অভিভাবকরা সযত্নে সন্তানদের এসব জরুরি কাজগুলো থেকে দূরে রাখি। এরা বসে বসে উপপাদ্য সম্পাদ্য আর বিজ্ঞানের জয়যাত্রা রচনা মুখস্থ করে আর একটু বড় বেলায় বাড়ির বাইরে গিয়ে বুয়া একবেলা না এলে না খেয়ে থাকছে। উন্নত দেশে পড়তে গিয়ে আমাদের সন্তানেরা বিব্রত হয় যখন দেখে উন্নত বিশ্বের একটি ছেলে নিজেকে চালিয়ে নেওয়ার মতো গৃহস্থালী ঠিকই জানে অথচ সে জানে না। যখন দেখে বরফের চাঁইয়ে বড় হয়েও এরা সাঁতার কাটতে জানে,অথচ নদীমাতৃক দেশের সন্তান হয়ে তারা জানে না। বিদ্যালয়ে মোজা পরা থেকে জুতার ফিতে বাঁধা সবই শিখে তারা। এগুলো তাদের সবার জন্য শিক্ষণীয়, আবশ্যিক শিক্ষার অঙ্গ। এখানেও তাই করা হয়েছে। এসব বিষয়কে বিদ্যালয়ের আনুষ্ঠানিক শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

তবে কি সম্পাদ্য উপপাদ্য, বাংলা, ইংরেজি বিজ্ঞান নেই এদের শেখার তালিকায়? অবশ্যই আছে। গণিত বিজ্ঞান সাহিত্যের সব বিষয় আছে।  শুধু প্রক্রিয়াটি ভিন্ন। বিমূর্ত ধারণার মতো নেই। গণিতের সূত্রগুলো হাতে কলমে শেখার পদ্ধতি আছে। যার জন্য চৌকোনা বাক্স আর কাঁচি দরকার পড়ছে। রঙিন কাগজে জাতীয় পতাকা বানিয়ে এরা শিখে নিচ্ছে বৃত্ত চতুর্ভুজ আয়তক্ষেত্র জাতীয় অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ টার্ম। স্বাস্থ্য সুরক্ষায় তাকে শিখতে  হচ্ছে শরীরের সব অঙ্গ প্রত্যঙ্গ আর প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা সংক্রান্ত বিষয়গুলো। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে তো ত্রিশ বছর আগেই দেখেছি এই বিষয়টি শিক্ষাক্রমে অন্তর্ভুক্ত।

সবচেয়ে গুরুতর সমস্যাটি তৈরি হয়েছে শিল্প ও সংস্কৃতি বিষয়টি নিয়ে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বিশ্বাস আর সংস্কারের সাথে সাংঘর্ষিক এই বিষয়টি বিদ্যালয়ে পড়ানোর মতো শিক্ষক পাওয়া যাচ্ছে না। আমি অভিজ্ঞতায় জানি অনেক শিক্ষক পড়াতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। কারণ বিষয়টিতে শিক্ষার্থীদের পরিচিত করিয়ে দেওয়া হয় রবীন্দ্র সংগীতের সাথে, লালনের গানের সাথে। ছাত্রদের সাথে শিক্ষককেও জোর গলায় গাইতে হয়, আমরা সবাই রাজা। জানতে হয় এস এম সুলতানকে, জয়নুল আবেদীনকে।

সারা বছর ঘাড় গুঁজে ডিসিপ্লিন এসে মুখস্থ করা প্রজন্মের কাছে এসব বিষয় তো বিরাট আপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলত সরকারের চাপিয়ে দেওয়া এই নতুন শিক্ষাক্রম আজন্ম লালিত ধর্মবিশ্বাস এবং ক্রমবর্ধমান গোঁড়ামির অন্ধকারে তলিয়ে যাওয়া মানুষ না পারছে গিলতে না পারছে ফেলতে৷ ফলে অন্যান্য সকল বিষয়কে অগ্রাহ্য করে সচেতনভাবে এই নতুন সসংযোজিত বিষয়গুলোকে সামনে নিয়ে এসে পুরো শিক্ষাক্রমকে বিতর্কিত করার অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

তবে কী এই শিক্ষাক্রম খুবই যুগোপযোগী? সমস্যাটা এখানেই। এই শিক্ষা ফিনল্যান্ডের আদলে। কিন্তু আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপটের ভিত্তিতে, জীবনের লক্ষ্য উদ্দেশ্য, জীবনমান কোনদিক থেকেই আমাদের দেশ ফিনল্যান্ডের মতো নয়। জাপান যদি মডেল হয়, জাপানের সাথে কোন দিক দিয়েই তুলনীয় নয় বাংলাদেশ।

ফিনল্যান্ড কিংবা জাপানের ছেলে-মেয়েদের সামনে দেশের বাইরে স্যাটেল হবার এক এবং একমাত্র উদ্দেশ্য থাকে না। আমাদের অভিভাবকরা আতঙ্কিত বোধ করছেন এই শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে আমাদের সন্তানেরা দেশের বাইরে তাল মিলাতে পারবে কিনা। আমাদের অভিভাবকরা আতঙ্কিত এই শিক্ষায় শিক্ষিতদের জন্য দেশে এবং বিদেশে চাকরির বাজার প্রস্তুত কিনা।

নীতি নির্ধারকরা কী উত্তর জানেন এটি একটি বিরাট প্রশ্ন। প্রায় আড়াইশ বছর ধরে প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার বিপরীতে প্রবর্তিত এই শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষিত হয়ে আসা প্রজন্মের ভবিষ্যৎ কী! হয়তো নীতি নির্ধারকরা এ প্রশ্নের উত্তর জানেন, কিন্তু যাদের জানা দরকার সেই শিক্ষকরা জানেন না, অভিভাবকরা জানেন না, সর্বোপরি যাদের জন্য এই ব্যবস্থার প্রবর্তন, সবকিছুর মূলে যে শিক্ষার্থী তারা নিজেরাও জানে না তারা কী পড়ছে কেন পড়ছে। এই শিক্ষাক্রম নিয়ে যেসব বিতর্ক তার উত্তর সবার আগে নীতি নির্ধারকরা পরিস্কারভাবে জানবেন, মানুষকে জানাবেন। তারপরও যদি কেউ অবুঝের মতো আচরণ করেন তবে তাকে অগ্রাহ্য করা যায় সহজেই।

আপাত হট্টগোলের কারণ উপরে যা বললাম তা সবই ভবিষ্যতের শঙ্কা। কিন্তু এই শিক্ষাক্রম নিয়ে তো বর্তমান সময় পাড়ি দেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে৷ সম্পূর্ণ নতুন এবং বৈপ্লবিক এই শিক্ষাক্রম আমাদের শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে যার জন্য শিক্ষকদের কোনো প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়নি৷ স্বল্প, মাত্র দিন পাঁচেকের প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে মাঠে৷ তাদের অধিকাংশই পাঁচদিনে এর আগা মাথা কিছুই বুঝে উঠতে পারেননি। বিদ্যালয়গুলোতে পর্যাপ্ত শিক্ষক নেই। ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত একেবারেই এই সিস্টেমের উপযোগী নয়। এ যেন হালচাষ না করে ফসলের বীজ বপন করে দেওয়া। ফলে যা হবার তাই হচ্ছে৷ আতঙ্কে কিংবা শংকায় কিংবা উদ্দেশ্যমূলকভাবে যেকোনো কারণেই হোক মানুষ যখন এর বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে, অপপ্রচার চালাচ্ছে তাদের কেউ পক্ষে যুক্তিসংগত গ্রহণযোগ্য কোনো বক্তব্য হাজির করতে পারছে না। পক্ষে কিংবা বিপক্ষে যেই যা বলছে সব ধারণা আর উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে পড়েছে।

যে কথার শেষ নেই  আপাতভাবে নতুন শিক্ষাক্রমের বইগুলো হাতে নিয়ে আমার মনে হয়েছিল এই শিক্ষাক্রম এদেশে আরও ৫০ বছর আগেই প্রবর্তন করা উচিত ছিলো। কিন্তু শিক্ষক হিসাবে শিক্ষার্থীদের পড়াতে গিয়ে আমি উপলব্ধি করলাম এই বিষয়গুলো কীভাবে পড়াতে হবে আমার জানা নেই। অভিভাবক হিসাবে আমি লক্ষ্য করলাম আমাদের এই শিক্ষাক্রম থেকে আমাদের সন্তানদের লেখার দক্ষতা পড়ার দক্ষতা কিছুই দৃশ্যমান হচ্ছে না। আমরা তো সেই শিক্ষক, যারা ক্লাস ফাঁকি দিয়ে প্রাইভেট পড়াই। আমরা তো সেই অভিভাবক যারা ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র সন্তানের হাতে তুলে দিয়ে তাকে ক্লাসে ফার্স্ট বানাতে চাই।

যদি আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার নীতি নির্ধারকেরা জানেন, এই শিক্ষার ভবিষ্যৎ কী তবে তা সবার আগে মাঠ পর্যায়ের শিক্ষকদের জানানো উচিত। তাদের এই শিক্ষাক্রম অনুযায়ী পাঠ দেওয়ার জন্য উপযোগী করে তোলা। 

পক্ষে বিপক্ষে যে যে উদ্দেশ্যেই যা কিছু বলুক শেষ কথা বলার সময় হয়নি কোনভাবেই।

লেখক: শিক্ষক, নাট্যকার, কথাসাহিত্যিক