নতুন বছরের শুরুতেই জাতীয় নির্বাচন। ফলে চলতি বছরজুড়েই দেশে-বিদেশে সরকারের ভাবমূর্তি রক্ষা এবং অর্জনের চাপ ছিল কূটনৈতিক অঙ্গনে। তবে সরকার সাফল্যের সঙ্গেই বিষয়গুলো মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়েছে। পাশাপাশি সরকারের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে অর্থনৈতিক কূটনীতিতেও চলতি বছরে সরকারের অর্জনকে সাফল্য হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
নির্বাচন ঘিরে কূটনৈতিক তৎপরতা, বেশ কিছু আন্তর্জাতিক অর্জনের পাশাপাশি দেশে কয়েকটি সফল আয়োজন সরকারের সক্ষমতার পরিচয় বহন করছে। তবে গত কয়েক বছরের মতো এবারও কূটনীতিতে অসংখ্য অর্জনের ভিড়ে সরকার হোঁচট খেয়েছে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যুতে। এ বিষয়ে গত বছরের ধারাবাহিকতায় মিয়ানমারের ইতিবাচক সাড়া ছিল। বন্ধু রাষ্ট্র চীনের ভূমিকাও ছিল উল্লেখ করার মতো। কিন্তু মিয়ানমারের অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে বিষয়টি সমাধানে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। উল্লেখ্য যে, এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক কিছু প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা ছিল অসহযোগিতামূলক। যা পুরো প্রক্রিয়ায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, চলতি বছরের সেপ্টেম্বরের শুরুতে নেপিদোতে বাংলাদেশ-মিয়ানমারের মহাপরিচালক পর্যায়ে হওয়া বৈঠকে পাইলট প্রকল্পের আওতায় শুরুতে প্রায় তিন হাজারের কিছু বেশি রোহিঙ্গা দিয়ে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করতে রাজি হয় মিয়ানমার। পরে যাচাই-বাছাই করে ধাপে ধাপে রোহিঙ্গাদের নিতেও রাজি হয় দেশটি। প্রথম ধাপে সফলতা আসলে যাচাই-বাছাইয়ের আওতায় থাকা রোহিঙ্গাদের পরবর্তী ধাপে প্রত্যাবাসন করানোর লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশ সরকারের। কিন্তু চীনের মধ্যস্থতায় প্রত্যাবাসনের লক্ষ্যে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের চলমান কর্মযজ্ঞের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো থেকে বারবারই বলা হয়েছে, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে অনুকূল পরিবেশ এখনও হয়নি।
সর্বশেষ, বছরের শেষদিকে যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি আফরিন আখতার তৃতীয় দফায় বাংলাদেশ সফরে এসে বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরু করার মতো প্রতিকূল পরিবেশ এখনো মিয়ানমারে নেই।’
শ্রম ইস্যু, জাতীয় নির্বাচনসহ বিভিন্ন ইস্যুতে চলতি বছরেও বিদেশী কূটনৈতিকদের হস্তক্ষেপ ছিল চোখে পড়ার মতো। আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে ঢাকায় দায়িত্বরত বিদেশি কূটনীতিকদের তৎপরতা যেন সবকিছু ছাপিয়ে গেছে। যা অতীতে দেখা যায়নি। বর্তমান সরকারের শেষ সময়ে এসে তাদের ভূমিকা আরও বেশি দৃশ্যমান হয়েছে। বিশেষ করে, মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস এবং যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার সারাহ কুকের কর্মতৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতো। সারাবছর বিদেশী কূটনৈতিকদের বিভিন্ন ইস্যুতে মন্তব্য, বিবৃতি, প্রতিক্রিয়া মিডিয়া অঙ্গণে আলোচিত ছিল। বিশেষ করে রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের গতিবিধি যেন সবার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়।
বিদেশি কূটনীতিকদের তৎপরতা নিয়ে এক অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম বলেন, ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে তাদের এতটা সক্রিয় দেখিনি। এখন যতটুকু দেখছি। এবার তারা অনেক আগে থেকেই সক্রিয়। এর উদ্দেশ্য ও কারণ তারাই বলতে পারবেন।
গত ১৪ মে থেকে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ মোট ছয়টি দেশের কূটনীতিকদের বাড়তি প্রটোকল সুবিধা বাতিল করে সরকার। চলতি বছরে কূটনৈতিক অঙ্গনে সাড়া ফেলে বিষয়টি। কূটনীতিকদের বাড়তি প্রটোকল সুবিধা বাতিলের বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, বর্তমানে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক ও নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তাই কূটনীতিকদের বাড়তি নিরাপত্তা দেওয়ার কোনো আবশ্যকতা নেই।
বছরের শেষ ছয়মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) নির্বাচন পর্যবেক্ষক দলের আসাকে কেন্দ্র করে কূটনৈতিক তৎপরতা, প্রাক-পর্যবেক্ষক দলের আসা, এসব প্রতিনিধি দলের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট দেশের প্রতিক্রিয়া- এসব বিষয়ও বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
চলতি বছরের সবচেয়ে নিকটতম প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে সর্ম্পকের বিষয়টিও ছিল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। বিশেষ করে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারতের আগ্রহ সবচেয়ে বেশি। কিন্তু বছরের শেষ সময় পর্যন্ত দেশটি খোলাসা কোনো বার্তা দেয়নি। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা। এর বাইরে দৃশ্যমান কোনো কূটনৈতিক তৎপরতা দেখা যায়নি ভারতের পক্ষ থেকে।
ইউক্রেন যুদ্ধের পর নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে রাশিয়ার কূটনীতিতে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বেশকিছু ইস্যুতে পাল্টা বিবৃতির ঘটনা ঘটেছে। রাশিয়াকে অতীতের মতো বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে এবারো কোনো মন্তব্য করতে দেখা যায়নি। তবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিরূপ মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে নিজেদের কঠোর অবস্থানের কথা জানায় মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের পরীক্ষিত এই বন্ধু দেশ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাংলাদেশ ইস্যুতে বেশ কয়েকবার দেশ দুটি তর্কে জড়ায়। এমনকি বছরের শেষ মাসে ‘আরব বসন্ত’ প্রসঙ্গ নিয়ে দেশ দুটোর পাল্টাপাল্টি মন্তব্যের ঘটনা ঘটেছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন বিশ্বের বর্ধনশীল পাঁচটি অর্থনীতির একটি। জিডিপিতে বাংলাদেশ বিশ্বের ৩৫তম, ২০৩৭ সালের মধ্যে বাংলাদেশ ২০তম জিডিপির দেশ হিসেবে আবির্ভূত হবে বলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চলতি বছরে ঘোষণা দিয়েছেন। অন্যান্য অনুঘটকের পাশাপাশি অর্থনৈতিক কূটনীতিতে বাংলাদেশের সাফল্য এতে প্রভাব ফেলেছে বলে মন্তব্য করেছেন কূটনীতিকরা।
মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে থাকা অনেক দেশ স্বাধীনতার এতো বছর পর এসে নিজেদের ‘ভুল’ স্বীকার করছে। এটি বাংলাদেশের কূটনীতির অন্যতম সাফল্য হিসেবে দেখা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে এক অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম বলেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় যেসব দেশ পাকিস্তানকে সহায়তা বা দেশটির পক্ষ নিয়েছিল, তাদের অনেকের অবস্থানগত পরিবর্তন হয়েছে। ভূ-রাজনৈতিক কারণে বর্তমান বিশ্বের অনেক রাষ্ট্র আছে, যারা মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে ছিল। যারা আমাদের স্বকীয়ভাবে সমর্থন দেয়নি অথবা প্রচ্ছন্ন, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পাকিস্তানকে সহায়তা করেছে; তাদের অনেকের অবস্থানগত পরিবর্তন হয়েছে। তারা প্রাইভেট মিটিংয়ে আমাদের বলেন, এ কাজগুলো ঠিক হয়নি, ভুল ছিল। কিন্তু পাবলিকলি তারা বলেন না।
৪৫ বছর পর ঢাকায় আবারও নিজেদের দূতাবাস চালু করেছে আর্জেন্টিনা। দূতাবাস খোলার ঘোষণা দিয়েছে মেক্সিকো, ব্রাজিলসহ কয়েকটি দেশ।
চলতি বছর ভূমিকম্পকবলিত তুরস্কসহ ফিলিস্তিন, নেপাল, শ্রীলঙ্কায় মানবিক সহায়তা দিয়েছে বাংলাদেশ। দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার ক্ষেত্রে এসব সহায়তা ভূমিকা রাখছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
এছাড়া সৌদি আরব, কাতার এবং ইউরোপের কয়েকটি দেশে বাংলাদেশী কর্মী প্রেরণের অগ্রগতি, ঢাকায় আইওসি রিজিওনাল কমিটির অধিবেশন আয়োজন, জাতিসংঘে প্রথমবার গণহত্যার আলোকচিত্র প্রদর্শনী, অষ্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশের ফেস্টিভালে বাংলাদেশের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ড প্রদর্শন করা প্রভৃতি ইস্যুতে চলতি বছরে দেশের অর্জন ছিল।