কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) ব্যবস্থাপনা শিক্ষা বিভাগের শিক্ষক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর কাজী ওমর সিদ্দিকীর পিএইচডি ডিগ্রি নথিভুক্তকরণ নিয়ে দেখা দিয়েছে বিতর্ক। নথিভুক্তকরণ কমিটি সুপারিশ না করলেও তার পিএইচডি ডিগ্রি নথিভুক্ত হয়েছে বলে জানান ওই কমিটির আহ্বায়ক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. হুমায়ুন কবির। তবে কাজী ওমর সিদ্দিকী বলছেন, নিয়ম মেনেই সম্পূর্ণ হয়েছে তার পিএইচডি ডিগ্রি নথিভুক্তকরণ প্রক্রিয়া।
গত ১৭ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) মো: আমিরুল হক চৌধুরী স্বাক্ষরিত এক অফিস স্মারকে কাজী ওমর সিদ্দিকীর ডিগ্রির সনদ নথিভুক্তের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়। এর আগে মালয়েশিয়ার পুত্রা বিজনেস স্কুলে (পিবিএস) ২০২০ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হন তিনি।
জানা গেছে, ওই সময় করোনা মহামারীর কারণে ভিসা জটিলতায় অনলাইনে কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার জন্য ২০২০ সালের ৩১ আগস্ট আবেদন করেন কাজী ওমর সিদ্দিকী। সেই আবেদনের প্রেক্ষিতে একই বছরের নভেম্বর মাসে তৎকালীন রেজিস্ট্রার আবু তাহের স্বাক্ষরিত চিঠিতে তাকে ২০২০ সালের ৫ সেপ্টেম্বর থেকে অনলাইনে কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেয় প্রশাসন।
একই বছরের ১ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হওয়া ৭৬তম সিন্ডিকেট সভার ৪৫তম আলোচ্য সূচিতে ভিসা জটিলতার কারণে যে সব শিক্ষককে অনলাইনে কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি প্রদান করা হয়, তাদের শিক্ষা ছুটি নীতিমালা অনুযায়ী ক্লাস শুরুর দিন থেকে ছুটি নেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। তবে কাজী ওমর সিদ্দিকী শিক্ষা ছুটি নেননি। তিনি ২০২২ সালে পিএইচডির কাজে ২২ দিন, ২০২৩ সালে ২৮ দিন এবং পরবর্তীতে আরও ২১ দিন মালেয়শিয়ায় অবস্থান করেন।
এ ব্যাপারে কাজী ওমর সিদ্দিকী বলেন, 'আমার পিএইচডি ডিগ্রি নথিভুক্তকরণ যথাযথ নিয়ম মেনেই হয়েছে। সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমি আমার পিএইচডি ডিগ্রি চলাকালীন সময়ে শিক্ষা কার্যক্রম কোন পর্যায়ে আছে এবং তা শেষ করার সময়সীমা সম্পর্কে সুপারভাইজার থেকে একটি প্রত্যয়নপত্র সংগ্রহ করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বরাবর দিয়েছি। তখন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আমাকে শিক্ষা ছুটি নেওয়ার ব্যাপারে কিছু জানায়নি। এরপর আমি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডির কাজে ছুটি নিয়ে মালয়েশিয়াতে গিয়েছি। তখনও আমাকে কোনো কিছু জানানো হয়নি।’
তিনি আরও বলেন, 'এটা করোনাকালীন সময়ের ঘটনা। সাধারণ সময় আর করোনা কালীন সময় এক না। পরিস্থিতি বিবেচনায় আমাকে অনলাইনে কার্যক্রম চালানোর অনুমতি দিয়েছিলো। সেই অনুযায়ীই আমি করেছি।'
এরপর ২০২২ সালের ২৫ আগস্ট অনুষ্ঠিত হওয়া ৮৫তম সিন্ডিকেট সভায় বৈশ্বিক করোনাকালীন সময়ে যে সব শিক্ষকগণকে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে উচ্চশিক্ষার অনুমতি দেওয়া হয়েছে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারকে পত্র প্রদানের মাধ্যমে খোঁজ খবর নিয়ে সংগৃহীত তথ্যসহ বিষয়টি পরবর্তী সিন্ডিকেট সভায় উপস্থাপনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
যে সব শিক্ষক করোনাকালীন উচ্চ শিক্ষার্থে অনলাইনে ক্লাস কার্যক্রম চালানোর অনুমতিপ্রাপ্ত হয়েছেন, তাদেরকে কমপক্ষে দুই বছর সরাসরি উচ্চ শিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে হবে বলে শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়। অন্যথায় তাদের অর্জিত উচ্চ শিক্ষার ডিগ্রি (পিএইচডি) কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রহণযোগ্য হবে না বলে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসের ১ তারিখে অনুষ্ঠিত সিন্ডিকেটের ৮৬তম সভায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এরই প্রেক্ষিতে কাজী ওমর সিদ্দিকীসহ ব্যবস্থাপনা শিক্ষা বিভাগের আরও দুই শিক্ষক একত্রে উচ্চশিক্ষা কার্যক্রম শেষ পর্যায়ে থাকায় সরাসরি দুই বছর অংশগ্রহণের শর্ত পুনঃবিবেচনার জন্য আবেদন করেন।
এর প্রেক্ষিতে গত ৬ এপ্রিল অনুষ্ঠিত ৮৭তম সিন্ডিকেটে শুধু করোনার সময়ে অনলাইনে পিএইচডি শিক্ষাকার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার জন্য অনুমতিপ্রাপ্ত শিক্ষকেরদের শিক্ষাকার্যক্রম সম্পর্কে সুপারভাইজার থেকে একটি প্রত্যয়নপত্র সংগ্রহ করে সরাসরি সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে সম্পন্ন করার নির্দেশনা প্রদান করা হয়। তবেই এটা নিয়মিত ডিগ্রি হিসেবে বিবেচিত হবে বলে সিদ্ধান্ত হয়।
উপরোক্ত সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্তের আলোকে কাজী ওমর সিদ্দিকী তার সুপারভাইজার থেকে একটি প্রত্যয়নপত্র সংগ্রহ করে রেজিস্ট্রার দপ্তরে জমা দেন। সেখানে দেখা যায়, তার সুপারভাইজার তাকে বাংলাদেশে অবস্থান করে তার কর্ম সম্পাদনের অনুমতি দেন। সর্বশেষ ২০২৩ সালের ১১ অক্টোবর তিনি তার পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন এবং ১৫ নভেম্বর তিনি তার অর্জিত ডিগ্রির সনদ নথিভুক্তকরণের জন্য রেজিস্ট্রার দপ্তরে জমা দেন, যা বিভাগীয় প্রধান এবং ডিন কর্তৃক সুপারিশকৃত। পরবর্তীতে তার সুপারভাইজার ও পুত্রা বিজনেস স্কুল থেকে সনদ ভেরিফাই হয়ে আসে।
সার্বিক বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা শিক্ষা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. কাজী ওমর সিদ্দিকী বলেন, ‘উপাচার্য স্যার আমাকে প্রক্টর বানানোর পর অনেকেই আগের মত অনিয়ম, টেন্ডারবাজি করতে না পারায় আমার বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লেগেছে। সেই প্রেক্ষাপটে আমার পিএইচডি ডিগ্রি বিতর্কিত করার চেষ্টা করছে। যা এক প্রকার ষড়যন্ত্র।’
ডিগ্রি নথিভুক্তকরণ কমিটির আহ্বায়ক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. হুমায়ুন কবির বলেন, ‘ডিগ্রি নথিভুক্তকরণের জন্য একটি প্রক্রিয়া রয়েছে। ওনাকে যখন অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চালানোর অনুমতি দেওয়া হয়েছে তখন শিক্ষা ছুটি নীতিমালা অনুযায়ী শিক্ষা ছুটি নেওয়ার কথা বলা হয়েছিলো। কিন্তু তিনি নেননি। পরবর্তীতে সিন্ডিকেট যখন দুই বছর শিক্ষা ছুটি নেওয়ার বিষয় আসে, তখন ওনার হাতে এত সময় ছিল না। সম্ভবত পাঁচ মাস ছিল। কিন্তু তিনি পিএইচডির জন্য পাঁচ মাসেও শিক্ষা ছুটি নেননি। তাই নথিভুক্তকরণ কমিটি এই বিষয়ে সুপারিশ করেননি।'
এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এফ এম আবদুল মঈন বলেন, ‘এটা পুরোপুরি আইন মেনেই করা হয়েছে। ৮৬তম সিন্ডিকেট সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছিল কমপক্ষে দুই বছর শিক্ষা ছুটি নিতে হবে। তখন বেশ কয়েকজন শিক্ষক ৮৬তম সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্তের আগে পিএইচডির কাজ ৯৫ শতাংশ সম্পন্ন করে ফেলেছে। ৮৭তম সভায় সিদ্ধান্ত হয় সুপারভাইজারের কাছ থেকে প্রত্যয়ন পত্র আনতে হবে পিএইচডির প্রোগ্রেসের বিষয়ে। ওমর (কাজী ওমর সিদ্দিকী) সেটা করেছে এবং সেখানে তার কাজ শেষ হওয়ার কথা ও দেশে অবস্থানের ব্যাপারে তিনি কোনো আপত্তি জানাননি। ফলে সবকিছু নিয়ম মেনেই হয়েছে।’