ক্যালেন্ডারের পাতা ঘুরে শেষ হলো আরও একটি বছর। ঘড়ির কাঁটা রাত ১২টার ঘরে যেতেই শুরু হবে আরও একটি বছর। রাত পোহাতেই সূর্যোদয় হবে দুই হাজার চব্বিশের। এর মধ্যে চলছে তেইশের পাওয়া না পাওয়ার হিসেব-নিকেশ। তেইশে কেমন কেটেছে দেশের ক্রিকেট?
বিশ্বকাপ ব্যর্থতা সবার আগে আসলেও তেইশের ক্রিকেট সরগরম ছিল মাঠের বাইরের নানা ঘটনায়। যার ছাপ পড়েছিল খেলাতে। এ বছর বাংলাদেশ ৪৬টি ম্যাচ খেলে জিতে ২৩টি ম্যাচে। ২০১৮ সালে এর আগে সর্বোচ্চ ২১টি জিতেছিল। সবচেয়ে শক্তিশালী একদিনের ক্রিকেটে খাবি খেলেও অন্য দুই সংস্করণে মিলেছে সাফল্যের দেখা। এ ছাড়া নারী ক্রিকেটও ভেসেছে সাফল্যে। সবচেয়ে বড় সাফল্য আসে যুবাদের হাত ধরে। বড় পাওয়া অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্ত। আর সবচেয়ে বড় ক্ষতি হুট করে তামিমের অবসর ঘোষণা দেওয়া। সেসবের দিকে আরেকবার আলোকপাত করা যাক।
বিশ্বকাপ ব্যর্থতার বছর তেইশের বিশ্বকাপ ঘিরে বহু স্বপ্ন ছিল। পাশের দেশ ভারতে আসর বলে কথা। আফগানিস্তানকে হারিয়ে স্বপ্নের শুরু হয়েছিল। এরপর অচেনা বাংলাদেশ। একের পর এক ম্যাচ যায়, বাংলাদেশের হারের মিছিল লম্বা হতে থাকে। অবস্থা এমন দাঁড়ায়, পঁচা শামুকে কাটে পা। ক্রিকেটের নন্দন কানন ইডেনে হারতে হয়েছে নেদারল্যান্ডসের সঙ্গেও! বোলাররা পাচ্ছিলেন না উইকেট আর ব্যাটারদের ব্যাটে দেখা নেই রানের!
উনিশ বিশ্বকাপের রানের ফোয়ারা তোলা সাকিব আল হাসান ছিলেন ছায়া হয়ে, একই পথের সারথী ছিলেন নাজমুল হোসেন শান্ত কিংবা মুশফিকুর রহিমরা। তাদের মাঝে ব্যতিক্রম ছিলেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। সবমিলিয়ে ৯ ম্যাচে ২ জয়। সেমিফাইনালের স্বপ্ন নিয়ে খেলতে গিয়ে দেশের বিমান ধরতে হয়েছে অষ্টম হয়ে। অধিনায়ক সাকিব বলেই দিয়েছেন, বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ বিশ্বকাপ হলো তেইশের বিশ্বকাপ। আসলেই তো তাই!
তামিমের অবসর কাণ্ড মাঠের পারফরম্যান্সের চেয়েও তেইশে দেশের ক্রিকেট আলোচনায় ছিল মাঠের বাইরের বিষয় নিয়ে। এর মধ্যে অন্যতম হলো তামিম ইকবালের হঠাৎ অবসর ঘোষণা। আফগানিস্তানের বিপক্ষে দ্বিতীয় ওয়ানডের পর ৬ জুলাই সংবাদ সম্মেলন ঢেকে অবসর ঘোষণা দেন তামিম। হুট করে তার এমন ঘোষণায় সাজানো-গোছানো ওয়ানডে দল ওলট-পালট হয়ে যায়।
একদিনের ব্যবধানে প্রধানমন্ত্রীর আহবানে অবসর থেকে ফেরেন তামিম। তাকে ফেরানোয় জড়িত ছিলেন সাবেক অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা। কোমরের চিকিৎসা নিয়ে এশিয়া কাপের পর বিশ্বকাপের আগে তামিম ফেরেন ওয়ানডেতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিশ্বকাপ দলে তার জায়গা হয়নি।
তামিম-সাকিব দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে বিশ্বকাপ দল ঘোষণার শেষ দিন অপেক্ষা করছিল চমক। এর মধ্যে আগেই চাউর হয়ে যায় যে থাকছেন না তামিম ইকবাল। শেষ পর্যন্ত তাই হলো। বাংলাদেশ বিশ্বকাপের বিমান ধরার পর এই প্রসঙ্গে ফেসবুকে ভিডিও বার্তা দেন তামিম। জানান, তাকে বোর্ডের নীতিনির্ধারকদের একজন ফোন করে বলেন, ব্যাটিং অর্ডারে নিচে খেলার জন্য। তামিম এটি মানতে পারেননি, সরাসরি জানান তিনি এই নোংরামির মধ্যে থাকতে চান না। তামিমের ভিডিও বার্তার পরদিন একটি টিভি চ্যানেলে দুই পর্বের সাক্ষাৎকার দেন সাকিব। এই সাক্ষাৎকারে বিভিন্ন বিষয়ের জন্য প্রকাশ্যে তামিমকে দোষারোপ করেন তিনি।
ওয়ানডে নেতৃত্বে সাকিবের ফেরা তামিমের অবসরের পর অন্তর্বতীকালীন অধিনায়ক হিসেবে লিটন দায়িত্ব পালন করেছিলেন। কিন্তু এশিয়া কাপ ও বিশ্বকাপ থাকায় একজন অভিজ্ঞ ও নিয়মিত অধিনায়ক খুঁজতেই হতো বোর্ডকে। সাকিবের বিকল্প কেউ ছিল না, শেষ পর্যন্ত তার কাঁধেই ওঠে নেতৃত্বের ভার। তার নেতৃত্বে এশিয়া কাপে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে হার দিয়ে শুরু করছিল বাংলাদেশ। আফগানিস্তানকে উড়িয়ে সুপার ফোর নিশ্চিত হয়েছিল। সুপার ফোরে প্রথম দুই ম্যাচ হেরে আগেই বিদায় নিশ্চিত হয়ে যায় বাংলাদেশের। তবে শেষ ম্যাচে ভারতকে হারিয়ে কোনোমতে শেষটা ভালো করে বাংলাদেশ। এশিয়া কাপ থেকে এসে সাকিব দিয়েছিলেন পদত্যাগপত্র। তবে বোর্ড এটি মেনে নেয়নি। আর বিশ্বকাপে সাকিবের নেতৃত্বে আসে মাত্র ২টি জয়! চার টেস্টে তিন জয় বাংলাদেশ সবচেয়ে শক্তিশালী এক দিনের ক্রিকেটে। এই সংস্করণে ভরাডুবি হলেও সবচেয়ে দুর্বল সাদা পোশাকে দারুণ করেছে বাংলাদেশ। চার টেস্ট খেলে তিনটিতেই জয়। তার মধ্যে আফগানিস্তানের বিপক্ষে টেস্ট ইতিহাসের তৃতীয় সর্বোচ্চ ৫৪৬ রানের জয় এসেছে। এ ছাড়া ঘরের মাঠে শক্তিশালী নিউ জিল্যান্ডকে হারানোর কৃতিত্ব অর্জন করে লাল সবুজের দল।
টি-টোয়েন্টিতেও রঙিন বাংলাদেশ সাকিব আল হাসানের নেতৃত্বে তেইশে টি-টোয়েন্টিতে দারুণ কাটিয়েছে বাংলাদেশ। ১১ ম্যাচে ৮টিতেই জয়। তার মধ্যে ঘরের মাঠে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডকে ধবলধোলাই করেছে। সাকিব শুরুটা করলেও শেষ হয়েছে নাজমুল হোসেন শান্তর হাত ধরে। তার নেতৃত্বে নিউ জিল্যান্ডকে নিউ জিল্যান্ডের মাটিতে প্রথমবারের মতো টি-টোয়েন্টিতে হারিয়েছে বাংলাদেশ।
সাফল্যের পাল উড়ছে নারী ক্রিকেটে তেইশে নিগার সুলতানা জ্যোতির নেতৃত্বে অসাধারণ খেলছে বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দল। বছরের শুরুতে ভারতের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টিতে জেতা, ওয়ানডে সিরিজ ড্র। এরপর পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কাকেও ধারবাহিকভাবে হারিয়েছে বাংলাদেশ। বছরের শেষে এসে জ্যোতিরা যেন আরও ছাপিয়ে গেছেন নিজেদের। দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে তাদেরই ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টিতে হারানোর কৃতিত্ব অর্জন করেছে তারা।
বছরের সেরা সাফল্য যুবাদের হাত ধরে নারী এশিয়া কাপে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার নজির থাকলেও ছেলেদের ক্রিকেটে এই অর্জন ছিল না। যুবাদের হাত ধরে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ দেখা পায় এশিয়া কাপ ট্রফির। দুবাইয়ে আরব আমিরাতকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় লাল সবুজের প্রতিনিধিরা। এনে দেয় বছরের সেরা সাফল্য।