উৎসব মুখর পরিবেশ নেই। প্রতিযোগিতা, প্রতিদ্বন্দিতা ও অংশগ্রহণমূলকের বালাই নেই। তাপ-উত্তাপ নেই। নির্বাচনি মাঠে মূলতঃ শাসক দল, সঙ্গে কিংস পার্টি। রাস্তার মধ্যে মাথার ওপরে টাঙানো পোস্টার প্রমাণ করছে দ্বাদশ নির্বাচন। জনগোষ্ঠী দুই ভাগে বিভক্ত। একপক্ষ নির্বাচনের দিকে। অন্যপক্ষ নির্বাচন থেকে দূরে লোকচক্ষুর অন্তরালে। শাসক দলের প্রার্থী দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। তার শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী জাতীয় নির্বাচনে নতুন মুখ, তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী। তার পক্ষেই জনমত গড়ে উঠেছে।
এই চিত্র রূপসা উপজেলার আইচগাতী ইউনিয়নের শোলপুর থেকে শ্রীফলতলা ইউনিয়নের নন্দনপুর গ্রামের। গ্রামগুলো খুলনা-৪ আসনের।
ভৈরব নদের তীরে আইচগাতী আর আঠারোবেকী নদীর তীরে শ্রীফতলা ইউনিয়ন। শহরতলীর ইউনিয়ন দুটোই বিএনপি’র ঘাঁটি বলে খ্যাত। আইচগাতীতে পৈত্রিক ভিটে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা আজিজুল বারি হেলালের। অদূরে মৈশাগুনিতে জন্ম ইসলামি আন্দোলনের মহাসচিব হাফেজ মাওলানা ইউনুস আহমেদের। তাদের ভোট ও সমর্থক হাতে গোনা নয়, ক্যালকুলেটরে গুণতে হয়।
এই আসনে শাসক দলের প্রার্থী খ্যাতিমান ফুটবল প্লেয়ার আবদুস সালাম মূর্শেদী। তিনি দশম (উপ-নির্বাচন) ও একাদশ নির্বাচনে জয়ী হয়ে সংসদ সদস্য হন। দেশের শীর্ষ শিল্পপতিদের একজন তিনি। তার শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী এস এম মোর্ত্তজা রশিদী দারা। রাজনৈতিক পরিচয় তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের দর্শনে বিশ্বাসী। শাসক দলের কোনো কমিটিতে তার অবস্থান নেই। ছিলেন জেলা ছাত্রলীগের একসময়ের সভাপতি ও সুন্দরবন কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক ভিপি। এ আসনের প্রয়াত সংসদ সদস্য মোস্তফা রশিদী সুজার সহোদর। প্রয়াত এ জনপ্রতিনিধির ইমেজ ও অনুকম্পা পেয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী।
১৯৯১ সালে খুলনা-৪ আসন থেকে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা রশিদী সুজা দলের মনোনয়ন পান। তিনি দলের প্রাণ পুরুষ হিসেবে সেখানে আবির্ভূত হন। ১৯৯১, ১৯৯৬ (১২ জুন) ও ২০১৪ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। মুসলিম লীগ অধ্যুষিত আইচগাতী ও শ্রীফলতলা ইউনিয়নে তৃণমূল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের দর্শনকে পৌঁছে দেন। রাজনৈতিক ইমেজ ছিল শীর্ষে। তিনি এখানকার অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতা হিসেবে স্বীকৃতি পেঁয়েছেন।
এলাকার সূত্র বলেছে, ২০১৪, ২০১৮ ও উপজেলা নির্বাচনে জনগণ ভোট দিতে না পারায় শাসক দলের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তারা নির্বাচন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এই ইউনিয়নের ২৪ জন ভোটারের ওপর জরিপের ফলাফলে ৫০ শতাংশ নির্বাচন বর্জনের পক্ষে। বিশেষ করে নির্বাচন বর্জনকারী বিএনপি, ইসলামী আন্দোলন, জামায়াত ইসলামী, খেলাফত মজসিল ও সিপিবি’র শক্ত ঘাটি রয়েছে।
নির্বাচনে ভোট দিতে যাবেন না এমন ব্যক্তিরা হচ্ছেন- জোয়ার গ্রামের সাত্তার মল্লিক, মৈষাঘুনি গ্রামের ইয়ার মল্লিক, আ. সাত্তার মল্লিক, নন্দনপুর গ্রামের মো. আফতাব হোসেন, ইসরাইল শেখ প্রমুখ। ভোটের পক্ষে যারা রয়েছেন, তাদের সিংহভাগ স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে।
যে কারণে সংসদ সদস্যের সমর্থন কমেছে: দ্রবমূল্যের উর্দ্ধগতি, দফায় দফায় বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি, ঘরভাড়া বৃদ্ধি, ভোটে জনরায়ের প্রতিফলনের সুযোগ না থাকা, রাজনৈতিক অস্থিরতা, তৃণমূল কর্মীদের সঙ্গে দলের সম্পর্ক না থাকা, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন দলীয় মনোনয়নের বাইরে পছন্দমত প্রার্থীকে সমর্থন দেওয়া, দলের মধ্যে দ্বিধাবিভক্তি এবং ৫ বছর জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত না থাকা। জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত না থাকায় বর্তমান সংসদ সদস্য বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন বলে মন্তব্য করেছেন অ্যাডভোকেট মোস্তাকুজ্জামান।
দারার পক্ষে সমর্থনের পাল্লা ভারি: মূলত তিনি এ আসনের রাজনীতিতে নতুন মুখ, আঞ্চলিকতার উর্দ্ধে, প্রয়াত মোস্তফা রশিদী সুজার ভাই, আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বঞ্চিতরা তার পক্ষে, ইউপি নির্বাচনে সংসদ সদস্যের বিরোধীদের সমর্থন, বিএনপি, জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন, খেলাফাত মজলিস ও সিপিবির একটি উৎসাহী অংশ নৌকা প্রতীককে হারাতে চায়।
এ অভিমত শিরগাতী গ্রামের রোকসানা বেগম, বাঁধাল গ্রামের সোহের মৃধা, মৌষাঘুনি গ্রামের সুফিয়া খাতুন, ডোমরা গ্রামের প্রিয়া আকতার, প্রদিপ কুমার শীল, ভদ্রাগাতি গ্রামের জামাল শেখ, শ্রীফলতলা গ্রামের রমজান মল্লিক, জুগিহাটি গ্রামের শাহিদুল ইসলাম, রোমেছা খাতুন, শোলপুর গ্রামের গাজি হুমায়ুন কবির, যুগিহাটি গ্রামের মুর্শিদা বেগম, শেখ আবু হাসান, শেখ ইসমাইল, আশিকুজ্জামান, দেয়াড়া গ্রামের আসাদুজ্জামান মুন্সী ও রাজাপুর গ্রামের মাহাবুব সর্দার। এবারের নির্বাচনে নতুন ভোটার বঙ্গবন্ধু কলেজের শিক্ষার্থী শিরগাতি গ্রামের ছালমা খাতুন ভোটের সমর্থন দানের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি।
প্রসঙ্গত, খুলনা-৪ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সংখ্যা ১১ জন। এ আসনের প্রার্থীরা হলেন- আওয়ামী লীগের প্রার্থী আব্দুস সালাম মুর্শেদী (নৌকা), স্বতন্ত্র প্রার্থী খুলনা জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও ক্রীড়া সংগঠক এস এম মোর্ত্তজা রশিদী দারা (কেটলী), জাতীয় পার্টির মো. ফরহাদ আহমেদ (লাঙ্গল), বিএনএমের এস এম আজমল হোসেন (নোঙর), এনপিপির মো. মোস্তাফিজুর রহমান (আম), স্বতন্ত্র এমডি এহসানুল হক (সোফা), বাংলাদেশ কংগ্রেসের মনিরা সুলতানা (ডাব), স্বতন্ত্র জুয়েল রানা (ট্রাক), রেজভি আলম (ঈগল), ইসলামী ঐক্যজোটের রিয়াজ উদ্দিন খান (মিনার) এবং তৃণমূল বিএনপির মো. হাবিবুর রহমান (সোনালি আঁশ)।
খুলনা-৪ আসনে ১৯৯১ সালের নির্বাচনে ৪১ হাজার ৬৯৩ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন জেলা আওয়ামী লীগের প্রয়াত সাধারণ সম্পাদক এস এম মোস্তফা রশিদী সুজা। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে সুজা ৫৯ হাজার ৫১৬ ভোট পেয়ে পুনরায় জয়লাভ করেন। ২০০১ সালে বিএনপি নেতা এম নুরুল ইসলাম ১ লাখ ২ হাজার ৯৬৫ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি মোল্লা জালাল উদ্দিন ১ লাখ ৯ হাজার ২১৬ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন। আর ২০১৪ সালের নির্বাচনে সুজা বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন।
সুজার মৃত্যুর পর খুলনা-৪ আসনের উপ-নির্বাচনে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় সালাম মুর্শেদী নির্বাচিত হন। খুলনা-৪ আসনে ভোটার ৩ লাখ ৫৫ হাজার ১৫৩। এর মধ্যে পুরুষ ১ লাখ ৭৭ হাজার ২৯২ এবং নারী ভোটার ১ লাখ ৭৭ হাজার ৮৬১জন।