প্রবাসী আয় কমে যাওয়া ও ডলার সঙ্কটের মধ্যে কেটে গেছে ২০২৩ সালের অধিকাংশ সময়। এসব কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ধারাবাহিকভাবে কমেছে রিজার্ভ। এতে অর্থনীতিতে আঁধার নেমে আসার শঙ্কা দেখা দেয়। তবে, বছরের শেষদিকে প্রবাসী আয়ে সুবাতাস ও বিদেশি ঋণের অর্থ ছাড়ের ফলে রিজার্ভ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। আঁধার কেটে অর্থনীতিতে আলো দেখা দিয়েছে। প্রবাসী আয়সহ অর্থনীতির অন্যান্য সূচক ইতিবাচক ধারায় থাকলে আগামীতে রিজার্ভ বাড়ার সম্ভাবনা আছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
করোনাভাইরাস মহামারির পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে ডলারের বাজারে অস্থিরতা শুরু হয়। এর ধারাবাহিকতায় ২০২৩ সালের অধিকাংশ সময় দেশের ডলার বিনিময় হার ঘন ঘন পরিবর্তন হয়েছে। সঙ্কট কাটাতে অন্যান্য ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবু, ২০২৩ সালে ডলারের দাম বেড়ে আন্তঃব্যাংক ১১১ টাকা এবং খোলা বাজারে ১২৫-১২৬ টাকার রেকর্ড গড়েছে। ডলারের যোগান দিতে গিয়ে রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে কমেছে। ফলে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত অনুযায়ী রিজার্ভের সক্ষমতা অর্জন হয়নি। এ কারণে আইএমএফ ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি পাওয়াসহ নানা সঙ্কটে অর্থনীতিতে এক ধরনের শঙ্কা সৃষ্টি হয়। কিন্তু, সব বাধা পেরিয়ে আইএমএফ ঋণের দ্বিতীয় কিস্তিসহ অন্যান্য দেশ থেকে ঋণের তহবিল আসতে শুরু করায় বছরের শেষদিকে রিজার্ভ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া, নানা সঙ্কটের মধ্যেও ডলারের দাম দুই দফা কমেছে। সব মিলিয়ে ২০২৩ সালের শুরুতে ডলার সঙ্কট, প্রবাসী আয় ও রিজার্ভ নিয়ে অর্থনীতিতে যে শঙ্কা দেখা দিয়েছিল, শেষদিকে তা কেটে যাচ্ছে ধীরে ধীনে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে আগামীতে অর্থনৈতিক চাপ কমবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ২০ ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট বা গ্রস রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৬০৪ কোটি ডলার বা ২৬ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার। আলোচ্য সময়ে আইএমএফের বিপিএম ৬ হিসাব পদ্ধতি অনুযায়ী রিজার্ভের পরিমাণ ২ হাজার ৬৮ কোটি ডলার বা ২০ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলার।
গত নভেম্বর মাসে মোট রিজার্ভ ছিল ২ হাজার ৪৮৯ কোটি ডলার বা ২৪ দশমিক ৮৯ বিলিয়ন ডলার। এ সময়ে আইএমএফের বিপিএম ৬ হিসাব পদ্ধতি অনুযায়ী রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৯৩০ কোটি ডলার বা ১৯ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলার। রিজার্ভ এত নিচে নেমে যাওয়ায় দেশের ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদদের মধ্যে উদ্বেগ দেখা দিয়েছিল। কিন্তু, এক মাসের ব্যবধানে রিজার্ভ ঘুরে দাঁড়ানোর কারণে উৎকণ্ঠা কেটেছে।
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আইনুল ইসলাম রাইজিংবিডিকে বলেছেন, রিজার্ভ কমে যাওয়ার কারণে অর্থনীতিতে উৎকণ্ঠা ছিল। আইএমএফের ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি এবং এডিবির ঋণের অর্থ দেশের আসার পর রিজার্ভ বেড়েছে, যা অর্থনীতির জন্য সুখবর। এই ধারা অব্যাহত রাখতে প্রবাসী আয় বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে রপ্তানি বাড়াতে হবে। প্রবাসী ও রপ্তানি আয় বাড়লে আমাদের অর্থনীতিতে যে চাপ ছিল, তা কমে আসবে। একই সঙ্গে রিজার্ভ বাড়বে।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পর্যালোচনায় দেখা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সালের আগস্টে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ ছিল ৪ হাজার ৮০০ কোটি ডলার বা ৪৮ বিলিয়ন ডলার। করোনা মহামারি-পরবর্তী সময়ে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে ২০২২ সাল থেকেই বিশ্বব্যাপী জ্বালানি, ভোগ্যপণ্য ও পরিবহন খাতে খরচ বেড়ে যায়। ফলে, অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের আমদানি খরচ আগের তুলনায় অনেক বাড়ে। তবে, সে তুলনায় দেশে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বাড়েনি। বিপরীত দিকে, জরুরি জ্বালানি, খাদ্যপণ্য, রাসায়নিক সারসহ বিভিন্ন পণ্য আমদানির দায় মেটাতে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফলে, রিজার্ভ কমতে থাকে।
২০২২ সালের ডিসেম্বরে দেশে মোট রিজার্ভ ছিল ৩ হাজার ৩৭৪ কোটি ডলার বা ৩৩ দশমিক ৭৪ বিলিয়ন ডলার। ২০২৩ সালের শুরুতে জানুয়ারি মাসে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৩ হাজার ২২২ কোটি ডলার বা ৩২.২২ বিলিয়ন ডলার। পরের মাসে কিছুটা বেড়ে রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ২২৬ কোটি ডলার বা ৩২.২৬ বিলিয়ন ডলার। এর এক মাস পরে মার্চ মাসে রিজার্ভ কমে দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ১১৪ কোটি ডলার বা ৩১.১৪ বিলিয়ন ডলার। এপ্রিলে রিজার্ভের পরিমাণ আরও কমে দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৯৬ কোটি বা ৩০.৯৬ বিলিয়ন ডলারে। এর পরের মাসে রিজার্ভ ৩০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে যায়। মে মাসে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৯৮৭ কোটি ডলার বা ২৯.৮৭ বিলিয়ন ডলার। তবে, পরের মাস জুনে কিছুটা বাড়লে জুলাইয়ে রিজার্ভ আরো কমে যায়। জুনে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ১২০ কোটি ডলার বা ৩১.২০ বিলিয়ন ডলার। এর পর ধারাবাহিকভাবে জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ৫ মাস রিজার্ভ কমেছে। সর্বশেষ নভেম্বরে আইএমএফের বিপিএম ৬ হিসাব পদ্ধতি অনুযায়ী রিজার্ভ ২০ বিলিয়নের নিচে নেমেছে। ওই সময় দেশের ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদদের মধ্যে দেশের অর্থনীতি নিয়ে বড় ধরনের শঙ্কা সৃষ্টি হয়। কিন্তু, সব শঙ্কা কাটিয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের দ্বিতীয় কিস্তির ৬৮ কোটি ৯৮ লাখ ডলার ও এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এডিবি) ঋণের ৪০ কোটি মার্কিন ডলারসহ অন্যান্য অর্থ ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে দেশে আসার পর বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ বেড়েছে।
আইএমএফ ও এডিবির ঋণের অর্থ দেশে আসার পর বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক জানান, আইএমএফ ও এডিবি ঋণের অর্থ রিজার্ভে যোগ হয়েছে। আর্থিক সঙ্কটের সময় এটি আমাদের স্বস্তি দেবে।
ডলারের দাম পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০২১ সালের ২২ আগস্টে প্রথমবারের মতো ডলারের দাম ৮৫ টাকা ছাড়ায়। ওই সময় বড় ধরনের আমদানি ব্যয় পরিশোধ করতে গিয়ে ডলার সঙ্কট শুরু হয়। ২০২২ সালের ডলারের দাম ১০০ টাকা অতিক্রম করে। ওই সময় ডলারের বিনিময় হার নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) এবং ব্যাংকের নির্বাহী কর্মকর্তাদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) কাছে দায়িত্ব দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এর পর থেকে সংগঠন দুটি ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণ করে আসছে। গত নভেম্বরের শুরুতে ডলারের বিনিময় হার ১১১ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল, যা ছিল সর্বোচ্চ আন্তঃব্যাংক ডলারের বিনিময় হার (খোলা বাজারে প্রতি ডলার সর্বোচ্চ ১২৫-১২৬ টাকায় বেচাকেনা হয়েছে)। পরবর্তীতে তিন দফা কমিয়ে ডিসেম্বরে ডলারের নতুন দাম নির্ধারণ করা হয়। এবিবি ও বাফেদা নির্ধারিত সর্বশেষ দাম অনুযায়ী রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় কিনতে ডলারের দাম সর্বোচ্চ ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা এবং আমদানি দায় মেটাতে ডলারের দাম ১১০ টাকা।
প্রবাসী আয়: ডলারের বাজার যখন অস্থির, তখন বৈধ পথে রেমিট্যান্স আহরণ কমতে থাকে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক রেমিট্যান্স আয় বাড়াতে নানা উদ্যোগ নেয়। নানা উদ্যোগের ফলে রেমিট্যান্স আয় ডিসেম্বরে বাড়তে থাকে।
রেমিট্যান্স আয় পর্যালোচনায় দেখা গেছে, গত ডিসেম্বরের ২২ দিনে রেমিট্যান্স এসেছে ১৫৭ কোটি মার্কিন ডলার। ২০২২ সালের ডিসেম্বর এসেছিল ১৬৯ কোটি ডলার। চলতি মাস ডিসেম্বরে রেমিট্যান্স আয় আগের বছরের একই সময়ে চেয়ে বাড়বে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে রেমিট্যান্স এসেছে ১৯৭ কোটি ৩১ লাখ ৫০ হাজার মার্কিন ডলার, আগস্টে ১৫৯ কোটি ৯৪ লাখ ৫০ হাজার ডলার, সেপ্টেম্বরে ১৩৩ কোটি ৪৩ লাখ ডলার, অক্টোবরে ১৯৭ কোটি ১৪ লাখ ৩০ হাজার ডলার এবং নভেম্বর মাসে এসেছে ১৯৩ কোটি মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স। ডিসেম্বরের ২২ দিনে এসেছে ১৫৭ কোটি মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স। মাস শেষে তা নতুন রেকর্ড গড়বে বলে প্রত্যাশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
২০২২-২৩ সালের জুলাইয়ে রেমিট্যান্স এসেছে ২০৯ কোটি মার্কিন ডলার, আগস্টে ২০৩ কোটি ডলার, সেপ্টেম্বরে ১৫৩ কোটি ডলার, অক্টোবরে ১৫২ কোটি ডলার, নভেম্বরে ১৫৯ কোটি ডলার এবং ডিসেম্বরে ১৬৯ কোটি ডলার।