রাজনীতি

‘রেকর্ড আছে, কাদের চুন্নু সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্র করেছেন’

জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও মহাসচিব সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্র করেছেন বলে অভিযোগ তুলেছেন নিজ দলের কেন্দ্রীয় নেত্রী ও পার্টির রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক সাহিন আরা সুলতানা (রিমা)। তার কাছে এ সংক্রান্ত রেকর্ড রয়েছে বলেও দাবি করেন তিনি।

রোববার রাজধানীর কাকরাইলে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে জাতীয় পার্টির বিক্ষুব্ধ প্রার্থীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি এসব কথা বলেন।

সাহিন আরা সুলতানা বলেন, ‘শনিবার আমি বনানী অফিসে গিয়েছিলাম। মহাসচিব, শেরিফা ও রেজাউল আমাকে হুমকি দিয়ে ভয় দেখিয়েছেন। আমি মুক্তিযোদ্ধার মেয়ে ভয় দেখিয়ে কোনো লাভ নেই।’

মুজিবুল হক চুন্নুকে জাতীয় পার্টির ইতিহাসের ‘সর্বনিকৃষ্ট মহাসচিব’ উল্লেখ করে সাহিন আরা সুলতানা বলেন, ‘তিনি (মুজিবুল হক চুন্নু) বলেছেন ‘‘এই মেয়ে তুমি এত কথা বলো কেন?’’ আর লম্পট রেজাউল আমাকে বলেছে, ‘‘আমাকে দেখে নেবে!’’ শেরিফা কাদের বলেছে, ‘‘হাউ ডেয়ার ইউ! আই ওয়ান্ট টু সি ইউ, আই উইল শো ইউ হাউ ডেয়ার আই অ্যাম’’। আমাকে এত সজহে কাবু করা যাবে না।’

এ সময় জিএম কাদেরের কঠোর সমালোচনা করেন সাহিন আরা সুলতানা। তিনি বলেন, ‘দলের চেয়ারম্যানের স্ত্রী শেরিফা কাদের। নির্বাচনের আগে কি কারণে তাকে প্রেসিডিয়াম করা হলো। কি যোগ্যতা রয়েছে তার? জবাব চাই। তার বিনিময়ে কেন বাবলা, ফিরোজ, খোকা, সালমা ইসলামসহ ত্যাগী নেতাদের বলি দেওয়া হলো? জানতে চাই। চেয়ারম্যানের আশেপাশে সব আগাছা। এদের জন্য আজ দল ডুবেছে। নির্বাচনে মনোনয়ন বাণিজ্য হয়েছে, তারা অনেক টাকা গুঁজেছেন।’

‘প্রেসিডিয়াম হয়েও কেরানির মতো ফাইল নিয়ে ঘোরেন। আপনারা তার নাম মুখে নিতে চান না। ভয় কিসের? ভয় করলে রাজনীতি করা যাবে না। সে হলো রেজাউল ইসলাম ভুইয়া। দলের এক নম্বর লম্পট ও বাটপার!’ 

এ সময় নেতাকর্মীরা চিৎকার করে সাহিন আরা সুলতানাকে সমর্থন জানান।

গোলাম মোহাম্মদ কা‌দে‌র, মুজিবুল হক চুন্নু, শে‌রিফা কা‌দের

সভায় দলের চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুর বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন দলটির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক শফিকুল ইসলাম সেন্টু।

তিনি বলেন, ‘প্রার্থীদের সঙ্গে কথা না বলে, পুলিশ ডেকে বনানী অফিসে ক্ষোভ বিক্ষোভের ইস্যু আপনারা তৈরি করেছেন। আমরা চেয়েছিলাম আপনাদের সঙ্গে কথা বলতে। অভিনন্দন জানাতে ফুলের তোড়াও নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু পরিস্থিতি আপনারাই উত্তপ্ত করেছেন। মাননীয় চেয়ারম্যান, ঘুঘু দেখেছেন, ফাঁদ দেখেননি। খোদার কসম করে বলছি- ফাঁদ দেখতে চাইলে দেখিয়ে দেব।’

এ সময় তিনি দ্রুত ফিরোজ রশীদ ও সুনীল শুভ রায়ের বহিষ্কার প্রত্যাহার করার দাবি জানিয়ে বলেন, ‘শেরিফা কাদেরকে একটা ছেলে গালি দিয়েছে, তাকেও আপনি বহিষ্কার করেছেন। চেয়ারম্যান সাহেব, আঘাত দিতে দিতে, বহিষ্কার করতে করতে এই বহিষ্কৃতরা এখন সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে গেছে। তারা এক হয়ে গেলে আপনার ঠিকে থাকা মুশকিল হয়ে যাবে।’

‘আপনি মিডিয়াকে বলেছেন, চমক দেখাবেন। ২৮৩ আসন নেমে এলো ২৬-এ। আপনি স্ত্রী, পুতরা, ভাগিনা সবাইরে দিলেন। আর রানিং এমপিসহ বাকী সবাইকে জবাই করে দিলেন। এটাই কি আপনার চমক?’ যোগ করেন সেন্টু।

‘সারাদেশে যারা নির্বাচনে অংশ নিয়েছে তারা প্রত্যেকেই এলাকায় সম্মানিত। কাউকে সম্মান না করেন, অসম্মান করার অধিকার আপনাদের নেই। পোস্টারে যা লিখেছেন তা দেখে নেতাকর্মীরা শুধু বিব্রত নয়, আওয়ামী লীগের লোকজনও লজ্জা পেয়েছে। চেয়ারম্যান, রাজনীতিতে আপনি আমাদের জুনিয়র। ৯০-এর পরে রাজনীতিতে এসেছেন। আর মঞ্চে যারা আছেন তারা সবাই ৯০-এর আগে। আপনাদের ভেলকিবাজি নেতাকর্মীরা বুঝে গেছে।’ বলেও মন্তব্য করেন তিনি। 

বক্তব্যে জাতীয় পার্টির ভয়াবহ বিপর্যয়ের জন্য চেয়ারম্যান ও মহাসচিবকে দায়ী করে সেন্টু বলেন, ‘দলীয় বিপর্যয়ের জন্য আপনারা সরাসরি দায়ী। আপনারা নির্বাচনে যাবেন না বলে অনেক নাটক করেছেন। সমঝোতার নামে একমাত্র আপনারা দুজনই ডায়ালগ করেছেন। কাউকে রাখেননি। ভিক্ষার সিট নেবেন না বলেছেন, কিন্তু আপনার স্ত্রীকে নিয়ে ভিক্ষার সিট নিয়েছেন। 

আওয়ামী লীগের প্রতি কোনো অভিযোগ নেই উল্লেখ করে মহানগর উত্তরের এই আহ্বায়ক বলেন, ‘তারা (আওয়ামী লীগ) নির্বাচনের যাওয়ার বদলে আপনাদের আসন দিয়েছে, টাকাও দিয়েছে। তারা দুহাত ভরে দিয়েছে। প্রার্থীদের আপনারা টাকা দেননি। তাই নির্বাচনে ভরাডুবি ঘটেছে। এজন্য আপনারা দায়ী, আওয়ামী লীগ নয়।’

এ সময় প্রেসিডিয়াম সদস্য হাজী সাইফুদ্দিন আহমেদ মিলন বলেন, ‘জিএম কাদেরকে আমি স্বচ্ছ্ব ও সজ্জন ব্যক্তি হিসেবে জানতাম। কিন্তু নির্বাচনে যা হয়েছে সেই সত্যিটা বলতে হয়েছে। আর সত্যিটা বললে হয়তো বহিষ্কার হতে হবে। আমরা চাই না দল ক্ষতিগ্রস্ত হোক। আমি যা বলেছি, দলের পক্ষে বলেছি। আজকে আমাকে, কাজী ফিরোজ, বাবলাকে বহিষ্কার করতে পারবেন, সে ক্ষমতা আপনার (জিএম কাদের) আছে। কিন্তু আরেকটি মিলন, কাজী ফিরোজ বা বাবলা জন্ম দিতে পারবেন না।’

ক্ষোভ ও অভিমান করে দলের অতিরিক্ত মহাসচিব লিয়াকত হোসেন খোকা বলেন, ‘আমাদের রক্ত ঘামে এই দল। জীবনের সব কিছু উজাড় করে দিয়েছি। এই দল নিয়ে কেউ ছিনিমিনি খেলবে সেটা আমরা হতে দেবো না। এই দল আমাদের। দলের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হলে দাঁতভাঙ্গা জবাব দেওয়া হবে।’

তিনি বলেন, ‘নির্বাচনে আমাদের সঙ্গে বেঈমানি করা হয়েছে। প্রার্থীরা তাদের ক্ষোভের কথা বলেছেন। তাদের টাকা আত্মসাত করা হয়েছে। তারা নির্বাচনে নেমে সবকিছু হারিয়ে এখন বিক্ষুব্ধ। আমরা তাদের কথা শুনতে, দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে এই সভার আয়োজন করেছি।’ 

সভাপতির বক্তব্যে সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা বলেন, ‘আমাদের রক্ষক্ষরণ হচ্ছে। বউয়ের সোনা বন্ধক দিয়ে নির্বাচন করে নিঃস্ব হয়ে গেছে অনেকেই। তাদের কথা শুনতে হবে।’

নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ করে জাতীয় পার্টিরকে শক্তিশালী করার আহ্বান জানান তিনি।

ভৈরবের নুরুল কাদের সোহেল বলেন, ‘নির্বাচন এলে আমাদের মাথা বিক্রি করেন, আর মাথা বিক্রি করবেন না। সংসার, দোকান পাট বিক্রি করে নির্বাচন করেছি, নিঃস্ব হয়ে গেছি। বলতে কান্না আসছে, কি বলবো, নৌকা, স্বতন্ত্র প্রার্থীদের হামলার মুখে নির্বাচনি মাঠে ছিলাম। কথা দিয়েও আমাদের একটা টাকা দিলেন না। চেয়ারম্যান মহাসচিব একটি বার ফোন ধরলেন না। আপনাদের সহযোগিতা তো চাইনি, কিন্তু আমাদের জন্য যে টাকা আসলো সেটা কোথায় গেলো? আপনাদের জবাব দিতে হবে।’

জিএম কাদেরকে উদ্দেশ্য করে সাবেক এমপি ও সিলেটের প্রার্থী ইয়াহিয়া চৌধুরী  বলেন, ‘আপনার স্ত্রীকে এমপি করতে চান। তিনি শুধু আপনাকে রান্না করে ভাত খাওয়ান, দলে তার কি অবদান বলেন? আমাদের টাকা আপনারা ভাগ বাটোয়ারা করেছেন। আপনাদের জবাব দিতে হবে। আপনি গণতন্ত্র শিখিয়েছেন, আপনার মধ্যে গণতন্ত্র নেই। আপনি স্ত্রীর জন্য  ফিরোজ, বাবলা, খোকা, পীর ফজলু, আতিক, ভাসানিসহ নয়টি সিট কোরবানি দিয়েছেন। সমাঝোতার আসনের জন্য নিজের স্ত্রী, নাতি আর মেয়ের ভাসুরের জন্য দৌড়াদৌড়ি করেছেন।’

নোয়াখালীর ফজলে এলাহী সোহাগ বলেন, ‘চেয়ারম্যাান আপনি আল্লাহকে হাজির নাজির করে ওয়াদা দিয়েছিলেন, এককভাবে নির্বাচন করবেন, নির্বাচনে আমাদের পাশে থাকবেন, কিন্তু আপনি কোনো কথা রাখেননি। আমাদের পথে নামিয়ে দিয়েছেন। আপনি চেয়ারম্যান হওয়ার আগে নীতিকথা বলতেন, চেয়ারম্যারন হওয়ার পরিবর্তন হয়ে গেছেন।’

জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও মহাসচিবের বাধার মুখে সারাদেশ থেকে সভায় দলের ১২০জন প্রার্থীসহ বিপুলসংখ্যক তৃণমূল নেতাকর্মী উপস্থিত ছিলেন। সভাপতিত্ব করেন দলের কো-চেয়ারম্যান ও ঢাকা-৪ থেকে নির্বাচনে অংশ নেওয়া সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা।

দলের প্রচার সম্পাক খোরশেদ আলম খুশুর পরিচালনায় সভায় অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন দলের ভাইস চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম পাঠান, আমানত হোসেন খান, যুগ্ম মহাসচিব আমির উদ্দিন আহমেদ ডালু, ফখরুল আহসান শাহজাদা, লিয়াকত চাকলাদার, আব্দুল হামিদ খান ভাসানি, হাসান ইফতেখার, মিজানুর রহমান মিরু, সুজন দে, শেখ মাসুক, শাহনাজ পারভীন।

তৃণমূল প্রার্থীদের মধ্যে বক্তব্যা রাখেন মুন্সীগঞ্জ-৩ এর আব্দুল বাতেন, সিরাজগঞ্জ-৫ এর ফজলুল হক নুরু, নোয়াখালী-৩ এর ফজলে এলাহী সোহাগ, সিরাজগঞ্জ-৬ এর মুখতার হোসেন, সিরাজগঞ্জ-১ এর জহিরুল ইসলাম, গাজীপুর-৪ এর শামসুদ্দিন খান, ভৈরবের নুরুল কাদের সোহেল প্রমুখ।