কোচ উপজাতির আভিজাত্য, মোঘল আমলের সৌন্দর্য, বারোভূঁইয়াদের বীরত্বের ইতিহাস ভেতরে গোপন করে মাটির সঙ্গে প্রায় মিলেমিশে গেছে ঐতিহাসিক নিদর্শন এগারসিন্দুর দুর্গ। লাল মাটির বুকে ভেঙে পড়েছে এই মোঘল নিদর্শন।
ঝোপঝাড় বেষ্টিত এগারসিন্দুর সামনে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম ভেঙে পড়েছে কিন্তু এখনও এর গুরুত্ব হারিয়ে যায়নি। এখনও যদি এই এগারসিন্দুর দুর্গ এলাকা খনন করা যায়, এখানেও ওয়ারী বটেশ্বরের মতো কোনো মূল্যবান প্রত্নতত্ত্বের খোঁজ মিলে যেতে পারে। অথচ কোনোরকম রক্ষণাবেক্ষণ নেই। বাঁধাই করা কবরটি ভেঙে পড়ে গেছে। একটা জরাজীর্ণ পুকুর দেখলাম। এর আশেপাশের জায়গা মোটামুটি দখল হয়ে গেছে। লাল মাটি, ভাঙা স্থাপনা, ঘন রোদ-ছায়ায় ডুবতে বসেছে একটা সময়ের ইতিহাস।
গিয়েছিলাম কিশোরগঞ্জের উদ্দেশ্যে। পাকুন্দিয়া শহরে পৌঁছানোর পরে হঠাৎ মনে হলো যে এগারসিন্দুরতো পাকুন্দিয়াতে। স্থানীয়দের কাছে এগারসিন্দুর রাস্তার কথা জানতে চেয়ে বুঝলাম সে রাস্তা অনেক পেছনে ফেলে এসেছি। মনে হলো এতো কাছে এসে এমন ঐতিহাসিক একটি স্থান না দেখে চলে যাওয়া ঠিক হবে না। এরপরে গাড়ি ঘুরিয়ে প্রায় দশ-বারো কিলোমিটার পেছনে গেলাম। সেখানে মৃতপ্রায় ব্রক্ষ্মপুত্র নদ আছে। ওই জায়গাটা থানা ঘাট হিসেবে পরিচিত। পাকুন্দিয়া-গাজীপুরের যে কাপাসিয়া সেখানে ঢুকতেই একটা ব্রিজ চোখে পড়ে। ব্রিজটা পার হয়ে ডান দিকে গেলে চোখে পড়ে ইটের রাস্তা। রাস্তায় একটা সাইনবোর্ডে দিকনিদের্শনা দেওয়া আছে। ওইটা দেখে শনাক্ত করলাম যে এটাই এগারসিন্দুর। জায়গাটি মূল রাস্তা থেকে পাঁচ-ছয়শো মিটার ভেতরে। কিন্তু গিয়ে দেখলাম মূল স্থাপনার তেমন কিছু নাই। এর আশেপাশে সাধারণ বাড়ি ঘর।
জনশ্রুতি আছে, বেবুধ নামে এক কোচ উপজাতি প্রধান ষোড়শ শতাব্দীতে এগারসিন্দুর দুর্গ নির্মাণ করেন। বারো ভূঁইয়াদের নেতা ঈশা খাঁ বেবুধ রাজার কাছ থেকে দুর্গটি দখল করেন এবং একে শক্তিশালী সামরিক ঘাঁটিতে পরিণত করেন। ১৫৯৮ সালে মানসিংহ দুর্গটি আক্রমণ করেন। এই এগারসিন্দুরেই ঈশা খাঁ ও মানসিংহের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ হয়েছিল। কথিত আছে - যুদ্ধের প্রাক্কালে ঈশা খাঁ বলেছিলেন সাধারণ সৈন্যদের যুদ্ধে না জড়িয়ে দুই দলের দুই প্রধানের মধ্যে যুদ্ধ হোক। কথা অনুযায়ী ঈশা খাঁ ও মানসিংহের তরবারি লড়াই শুরু হয়। একপর্যায়ে ঈশা খাঁর তরবারির আঘাতে মানসিংহের তরবারি ভেঙে গেলে ঈশা খাঁ তাকে আঘাত না করে নিজের সেনাপতিকে বলেন মানসিংহকে আরেকটি তরবারি দিতে। ঈশা খাঁর এই মহানুভবতা দেখে মানসিংহ আর যুদ্ধ না করে সন্ধির প্রস্তাব দেন। ঈশা খাঁর বীরত্ব ও মহত্তের স্মৃতিবিজড়িত এগারসিন্দুর দুর্গ ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের উচিত এগারসিন্দুর সৃষ্টিকাল, স্থায়ীকাল এবং ধ্বংসকাল বিবেচনায় নিয়ে এই ঐতিহাসিক স্থাপনাটি রক্ষণাবেক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া এবং খননকার্য চালানো। তাহলে মিললেও মিলতে পারে প্রত্মতাত্ত্বিক -ঐতিহাসিক অনেক কিছু।