সাতসতেরো

মুঘল রাজবংশের একমাত্র নারী শাসক

রানি এলিজাবেথের থেকে বৈচিত্রময় তার রাজ্যশাসন। জন্মের সময় তার নাম দেওয়া হয়েছিল মেহেরুন নিসা। কিন্ত স্বামী মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর পরে তার নাম পাল্টে রেখেছিলেন নূরজাহান। যার অর্থ (জগতের আলো)। ইংল্যান্ডে রাণী প্রথম এলিজাবেথের জন্মের কয়েক দশক পরে এই মুসলিম নারীর জন্ম। 

ষোড়শ শতকের শুরু থেকে পরবর্তী প্রায় তিনশো বছর ধরে ভারতবর্ষ শাসন করেছে মুঘলরা। এই রাজবংশকে বলা হয় ভারতের সবচেয়ে বড় এবং শক্তিশালী রাজবংশ। কিন্তু পুরো মুঘল রাজবংশের একমাত্র নারী শাসক ছিলেন নূরজাহান। নুরজাহান ছিলেন একজন কবি, দক্ষ শিকারি এবং স্থপতি। স্থপতি হিসেবে তিনি এতোটাই দক্ষ ছিলেন যে, আগ্রায় নূরজাহানের তৈরি করা নকশাতেই নির্মাণ করা হয়েছিল তার বাবা-মায়ের সমাধি সৌধ। পরে এই স্থাপত্য রীতিই নাকি তাজ মহলের স্থাপত্য নকশার অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে। কিন্তু নূরজাহান কোনো রাজকীয় পরিবার থেকে আসেননি। সম্রাটের হারেম থেকে তার উত্থান ঘটে এক দূরদর্শী রাজনীতিক হিসেবে। তিনি হয়ে যান সম্রাট জাহাঙ্গীরের প্রিয়তমা স্ত্রী। কার্যত বিশাল মুঘল সাম্রাজ্য তিনি এবং সম্রাট জাহাঙ্গীর মিলে একসঙ্গেই শাসন করতেন।

১৫৭৭ সালে কান্দাহারের কাছে (আজকের আফগানিস্তানে) নূরজাহানের জন্ম। তার পরিবার ছিল ইরানের এক অভিজাত বংশ। কিন্ত সাফাভিদ রাজবংশের অসহিষ্ণুতার কারণে তারা নিজেদের রাজ্য ছেড়ে মুঘল সাম্রাজ্যে এসে আশ্রয় গ্রহণ করেন। পিতা-মাতার জন্ম স্থানের ঐতিহ্য আর মুঘল রীতি-নীতি, এই দুটির আবহে বেড়ে উঠেন তিনি। নূরজাহানের প্রথম বিয়ে হয় এক মুঘল রাজকর্মচারীর সঙ্গে। তার স্বামী ছিলেন এক সেনা কর্মকর্তা। স্বামীর সঙ্গে তিনি পূর্ব ভারতের বাংলায় চলে আসেন। সেখানেই তার একমাত্র ছেলের জন্ম হয়।

তবে সম্রাট জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে এক ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার অভিযোগে নূরজাহানের স্বামীর চাকরি যায়। এক লড়াইয়ে নিহত হন নূর জাহানের স্বামী। বিধবা নূরজাহানকে পাঠানো হয় মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের হারেমে। সেখানে নূরজাহান অন্য মুঘল নারীদের আস্থা এবং বিশ্বাসের পাত্র হয়ে উঠেন। ১৬১১ সালে সম্রাট জাহাঙ্গীর তাকে বিয়ে করেন। তিনি ছিলেন জাহাঙ্গীরের বিশতম স্ত্রী।

জাহাঙ্গীরের স্মৃতিকথায় ১৬১৪ সালের পর থেকে তার সঙ্গে নূরজাহানের বিশেষ সম্পর্কের উল্লেখ আছে বার বার। তিনি নূরজাহানকে একজন বিশ্বস্ত সঙ্গী, চমৎকার সেবাদাত্রী, বিজ্ঞ পরামর্শদাতা, দক্ষ শিকারি, বিচক্ষণ কূটনীতিক এবং শিল্পবোদ্ধা হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। অনেক ইতিহাসবিদের মতে জাহাঙ্গীর ছিলেন এক মদমত্ত সম্রাট। তিনি সম্রাজ্য পরিচালনার ভার ছেড়ে দিয়েছিলেন স্ত্রীর হাতে। কিন্তু এটি পুরোপুরি সত্য নয়। মূলত নূরজাহান এবং জাহাঙ্গীর ছিলেন পরস্পরের পরিপূরক। স্ত্রী যে সাম্রাজ্য শাসনে তার পাশে আসন নিয়েছিলেন, সেটি নিয়ে জাহাঙ্গীরের কোনো অস্বস্তি ছিল না।

তাদের বিয়ের পরপরই নূরজাহান প্রথম যে রাজকীয় ফরমান জারি করেছিলেন তা ছিল এক রাজকর্মচারীর জমির অধিকার রক্ষায়। সেখানে তিনি স্বাক্ষর করেন নূরজাহান পাদশাহ বেগম নামে, যার অর্থ নূরজাহান, সাম্রাজ্ঞী। তিনি যে সার্বভৌম এবং তার ক্ষমতা যে বাড়ছে, এটি ছিল তারই ইঙ্গিত। ১৬১৭ সালে সম্রাট জাহাঙ্গীর এবং তার নাম লেখা স্বর্ণ এবং রৌপ্য মূদ্রা ছাড়া হয়। সে সময় মুঘল রাজদরবারের লেখক, বিদেশি কূটনীতিক, বণিক এবং পর্যটকরা উপলব্ধি করেন মুঘল সাম্রাজ্য পরিচালনায় নূরজাহানের বিরাট প্রভাব আছে।

একজন রাজকর্মচারী একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করেছিলেন তার লেখায়। নূরজাহান একদিন রাজপ্রাসাদের বারান্দায় দেখা দিয়েছিলেন। এটি এর আগে পর্যন্ত কেবল পুরুষদের জন্যই সংরক্ষিত ছিল। তবে পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে নূরজাহানের এটিই একমাত্র বিদ্রোহ ছিল না। শিকারে বের হওয়া থেকে শুরু করে নিজের নামে রাজকীয় মূদ্রা এবং রাজকীয় ফরমান জারি, বড় বড় রাজকীয় ভবনের নকশা তৈরি, দরিদ্র নারীদের কল্যাণে ব্যবস্থা গ্রহণ, এরকম নানা কাজে নূরজাহান তার স্বাক্ষর রেখেছেন। যা ছিল সে কালের নারীদের মধ্যে ব্যতিক্রম। তার স্বামীকে যখন জিম্মি করা হয়, তখন নূরজাহান তাকে রক্ষায় সেনাবাহিনীর অধিনায়কের দায়িত্বও পালন করেছেন, যা তাকে ইতিহাসের পাতায় আর জনমানসে চিরদিনের জন্য স্থায়ী জায়গা করে দিয়েছে।

তথ্যসূত্র: বিবিসি