সাক্ষাৎকার

বাংলার পথ ধরে হেঁটে চলেছি সংস্কৃতির সন্ধানে : সুমনকুমার দাশ

সুমনকুমার দাশ সাংবাদিক, লোকসংস্কৃতি গবেষক ও প্রাবন্ধিক। ফোকলোরে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি সম্প্রতি বাংলা একাডেমি পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। গ্রামাঞ্চল ঘুরে প্রাচীন ও বিলুপ্তপ্রায় গান সংগ্রহ করেন তিনি। তার ব্যক্তিগত সংগ্রহে নানা ধারা-উপধারার প্রায় ৭০ হাজার লোকগান রয়েছে। সুমনকুমার দাশের রচিত ও সম্পাদিত বইয়ের সংখ্যা ৭১টি। সুমনকুমার দাশের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রাইজিংবিডিরর সিলেট প্রতিনিধি নূর আহমদ। 

রাইজিংবিডি : বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্তিতে আপনাকে অভিনন্দন। পুরস্কারপ্রাপ্তির খবর শোনার পর আপনার প্রথম যে অনুভূতি সেই কথাটি জানতে চাচ্ছি।   সুমনকুমার দাশ : ধন্যবাদ। খবরটি যখন প্রথম পেলাম, তখন সামান্য সময়ের জন্য নিজের ভেতরে একটা উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল। মুঠোফোনে একের পর এক কল আসছিল। শুভাকাঙ্খীরা শুভেচ্ছা জানাচ্ছিলেন, ভালো লাগা প্রকাশ করছিলেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক সয়লাব হয়ে যাচ্ছিল শুভেচ্ছা বার্তায়। তবে ঘণ্টাখানেক পর সে ঘোর কেটে যায়। মন অনেকটাই শান্ত হয়ে আসে। ভাবি, পুরস্কার হয়তো-বা সামনের দিনগুলোতে কিছুটা অনুপ্রেরণা দেবে। তবে শেষ পর্যন্ত নিজের কাজটাই করে যেতে হবে। যেভাবে আনন্দ নিয়ে লোকায়ত বাংলার পথ ধরে হেঁটে চলেছি গান আর আচার-সংস্কৃতির সন্ধানে, সেটাই করে যেতে হবে। আসলে দ্রুতই আমি এ পুরস্কারের বিষয়টা ভুলে যেতে চাই। 

রাইজিংবিডি : সাহিত্যচর্চার বিষয় হিসেবে আপনি লোকসাহিত্য কেন বেছে নিলেন? সুমনকুমার দাশ: আর পাঁচ-দশজন বাঙালি লেখকের মতো কবিতা দিয়ে আমার সাহিত্যচর্চা শুরু হয়। তবে যেহেতু আমার জন্ম হাওরের প্রত্যন্ত এক গ্রামে, ফলে লোকায়ত সংস্কৃতির নানা ধারা-উপধারার সঙ্গে আমি পরিচিত ছিলাম। রাতে যাত্রাগান দেখে কিংবা বাউলগান, মালজোড়াগান শুনে-শুনে বড় হয়েছি। তাই কবিতায় প্রায়ই লোকজ উপকরণ ব্যবহার করতাম। পরে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি, তখন আমার লেখালেখিতে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। ফেলে আসা গ্রাম আর মাটি আমাকে টানতে শুরু করে। এ অবস্থায় গ্রামীণ লোকায়ত সংস্কৃতির নানা ধারা-উপধারাগুলো নিয়ে কাজ করার আগ্রহ জন্মায়। শহুরে সমাজে অনেকটাই অপরিচিত গ্রামীণ প্রতাপশালী গীতিকার-শিল্পী-সাধকদের জীবন ও দর্শন ছড়িয়ে দেওয়ার ইচ্ছে থেকেই লোকসাহিত্য নিয়ে কাজ করা শুরু করি। সেই যে লোকসাহিত্যের প্রেমে পড়া, এখনো তা অব্যাহত আছে।

রাইজিংবিডি : লোকসাহিত্য সংগ্রহের জন্য আপনাকে বিভিন্ন ধরনের কাজ করতে হয়েছে। নিশ্চয়ই অনেক অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে। বিভিন্ন শিল্পীর সান্নিধ্যে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। সে কথাগুলো জানতে চাই।  সুমনকুমার দাশ : লোকগান সংগ্রহ, শিল্পী-সাধকদের সাক্ষাৎকার নেওয়া থেকে শুরু করে গানের আসরে রাতের পর রাত কাটিয়ে দেওয়ার স্মৃতি আসলে বলে শেষ করা যাবে না। ছাত্রজীবনে হাওরের বিভিন্ন গ্রামে লোকগান, লোকনাটক, পাঁচালি, যাত্রাপালাসহ লোকসাহিত্যের বিভিন্ন পাণ্ডুলিপি সংগ্রহে দিনের পর দিন পড়ে ছিলাম। রাতের পর রাত গ্রামীণ শিল্পী, সাধক, মহাজন, সুরকারদের সঙ্গ করেছি। তাদের সঙ্গে মিশে লোকায়ত ধারার সাহিত্য আর তাদের জীবনযাপন সম্পর্কে ধারণা পেতে চেষ্টা করেছি। পরে মূলত সেসবই লিখেছি। বলা যেতে পারে, দেখা থেকে লেখা। তবে এ কাজ করতে গিয়ে তিক্ত-মধুর নানা ঘটনারই মুখোমুখি হয়েছি। এ পরিসরে সেসব বলা একটু কঠিন। কারণ এমন অভিজ্ঞতার তো শেষ নেই। প্রসঙ্গক্রমে একটা কথা বলি, নিজের দেখা কিংবা অভিজ্ঞতার বাইরে একটি পঙ্‌ক্তিও আমি কখনো লেখার চেষ্টা করিনি।  

রাইজিংবিডি : আমাদের লোকসাহিত্য বিশেষ করে সিলেট অঞ্চলের লোকসাহিত্য সম্পর্কে আপনার নিজস্ব যে মতামত তৈরি হয়েছে সে সম্পর্কে জানতে চাচ্ছি।  সুমনকুমার দাশ : আমাদের যে সমৃদ্ধ লোকসাহিত্য রয়েছে, সেসব তুলনামূলকভাবে কম আলোচিত হচ্ছে। আসলে সাহিত্যের এ ক্ষেত্রটিতে অজ্ঞাতকারণে আলো কম পড়েছে। বাংলার গ্রামে-গ্রামে কতশত সাধক, চারণ কবি, গীতিকার, লোকনাট্যকারের জন্ম হলেও তারা কখনোই প্রচারে আসেননি। প্রচারের আলোয় থাকা শহরের অনেক সুপ্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিকের চেয়েও অনাহারে-অর্ধাহারে নাগরিক সভ্যতার বাইরে গ্রামে থাকা অনেক লোকায়তধারার সাহিত্যিকের লেখায় নিজস্ব দর্শন ও মৌলিকতা রয়েছে। অথচ তারা আড়ালেই রয়ে যাচ্ছেন। সাম্প্রতিক সময়ে মুষ্টিমেয় গ্রামীণ শিল্পী-সাধক প্রচারের আলোয় এলেও অনেকে এখনো সেভাবে পরিচিতি পাননি। আসলে পরিচিতি পাননি বললে ভুলও হয়, গ্রামীণ সমাজে তারা ডাকসাইটে শিল্পী-লেখক হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি পেলেও শহরে মানুষের কাছে ঠিকই অপরিচিত রয়ে যাচ্ছেন। অর্থাৎ, আমাদের লোকসাহিত্যিকদের যথাযথভাবে আমরা উপস্থাপন করতে পারছি না। এটা আমাদেরই ব্যর্থতা। তবে আশার কথা হচ্ছে, লোকসাহিত্যের নানা উপকরণ সংগ্রহে আমাদের জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলো এখন কাজ শুরু করেছে। এটা আরও বিস্তৃত করতে হবে। আর আমরা সকলেই কমবেশি জানি যে, বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় লোকসাহিত্যের দিক দিয়ে সিলেট অত্যন্ত সমৃদ্ধ। এখানকার অনেক বাউলশিল্পী ও লোকশিল্পী দেশ-বিদেশে নিজেদের কর্মে পরিচিতি ও সমীহ আদায় করে নিয়েছেন। ধামাইলগান, ঘাটুগান, ভট্টসংগীত, ঢপযাত্রাসহ লোকসাহিত্যের নানা ধারার জন্মও এই সিলেট অঞ্চলে হয়েছে। অত্যাধুনিক এ প্রযুক্তির যুগে এসে যখন লোকায়ত সাহিত্যের বিভিন্ন ধারা বিলুপ্তির দিকে যাচ্ছে, সেখানে এখনো সিলেট অঞ্চলে লোকগান, লোকনাট্য, লোকক্রীড়া আর লোকায়ত ধারার সাহিত্যের সজীব একটা ধারা প্রবহমান। তবে এ ধারায় ভাটা পড়ার আগে প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতার প্রয়োজন।

রাইজিংবিডি : লোকসাহিত্যে হাওর অঞ্চল সমৃদ্ধ, এর বিশেষ কোনো কারণ আছে কী?  সুমনকুমার দাশ : হাওরের ভৌগলিক পরিবেশ এবং প্রকৃতি আলাদা। এখানে ছয় মাস শুকনো আর ছয় মাস পানি। বারো মাসে এখানে তেরো পার্বণ। দিনভর কাজ শেষে রাতে বসে লোকগানের আসর। হিন্দু-মুসলিম অধ্যুষিত প্রায় গ্রামে এখনো নানা উৎসব উপলক্ষে ঘটা করে লোকগান ও লোকনাট্যের আসর বসে। মূলত দিগন্তবিস্তৃত হাওরাঞ্চলের প্রাকৃতিক ও নান্দনিক বৈচিত্রই লোকগানের জমি ঊর্বর করে রেখেছে।

রাইজিংবিডি : বাংলাদেশের লোকসাহিত্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণে কী ধরনের উদ্যোগ নেওয়া যায়, যদি একটু বলতেন? সুমনকুমার দাশ : কেবল পৃষ্ঠপোষকতাই পারে লোকসাহিত্যের সমৃদ্ধ ধারা টিকিয়ে রাখতে। যেহেতু ধীরে ধীরে লোকসাহিত্যনির্ভর ধারাগুলোর পরিবেশনার ক্ষেত্র সংকুচিত হচ্ছে, তাই অনেক কিছুই এখন বিলুপ্ত হতে চলেছে। এ অবস্থায় টেক্সট ও ভিজ্যুয়াল উভয় পদ্ধতিতেই লোকসাহিত্যের উপকরণগুলো সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা উচিত। এক্ষেত্রে বাংলা একাডেমি ও বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির উদ্যোগ আরও বাড়ানো প্রয়োজন। এ দুটো প্রতিষ্ঠানের সম্পূর্ণ পৃষ্ঠপোষকতা ও উদ্যোগে গ্রামের হারিয়ে যেতে বসা সাংস্কৃতিক উপকরণগুলো সংগ্রহে ব্যাপক উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। তবেই বিলুপ্তি ঠেকানো সম্ভব।  

রাইজিংবিডি : এ প্রসঙ্গে পাঠকদের উদ্দেশ্যে কিছু বলতে চান কি না? সুমনকুমার দাশ : একটা বার্তা আমি পাঠকদের দিতে চাই। সেটা হচ্ছে, নিজেদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষার স্বার্থে আমরা প্রত্যেকেই কিন্তু চাইলে একেকজন সংগ্রাহকের ভূমিকা পালন করতে পারি। নিজ গ্রাম কিংবা পাশের বয়স্ক ব্যক্তির কাছ থেকে তাদের জানা লোকগান, লোকনাট্য, পাঁচালি, প্রবাদ-প্রবচন-ছিল্লক, ধাঁধা, কেচ্ছা, গীতিকা সংগ্রহ করে প্রত্যেকেই সে সব সংরক্ষণ করে রাখার প্রচেষ্টা করতে পারি। এতে করে প্রতিটি অঞ্চলের লোকসাহিত্য সহজেই নিজেদের সম্মিলিত প্রয়াসের মাধ্যমে সংরক্ষণ করে নিতে পারি। এতে যেমন আমাদের সমৃদ্ধ লোকসাহিত্য সংরক্ষিত হবে, তেমনই পরবর্তী প্রজন্মের জন্য গর্ব করার মতো সাংস্কৃতিক ধারা-উপধারাগুলো উদাহরণ হিসেবে পরিচিতি পাবে।