ব্যাংক খাতে সুশাসন নিশ্চিত ও খেলাপি ঋণ কমাতে ১৭ দফা পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে সুশাসন নিশ্চিত করতে ৬টি ও খেলাপি ঋণ কমাতে ১১টি পরিকল্পনার কথা জানিয়েছে ব্যাংক খাতের এই নিয়ন্ত্রক সংস্থা। কোনো গ্রাহক ঋণ নিয়মিত পরিশোধ না করলে তাকে ইচ্ছাকৃত খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করা হবে। ঋণখেলাপিদের বিভিন্ন সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হবে। তারা নতুন কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খোলারও সুযোগ পাবেন না।
বুধবার (৪ ফেব্রুয়ারি) বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের সভায় এসব সিদ্ধান্ত হয়েছে। সভায় সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার।
সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবু ফারাহ মো. নাসের। এ সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হকসহ অন্যান্য কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন।
ডেপুটি গভর্নর জানান, ব্যাংক খাতে ২০২৬ সালে ৩০ জুনের মধ্যে খেলাপি ঋণের হার সার্বিক ৮ শতাংশের পাশাপাশি রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার যথাক্রমে ১০ ও ৫ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনতে চায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এছাড়া, ব্যাংকিং খাতে কর্পোরেট সুশাসন নিশ্চিতের মাধ্যমে সীমাতিরিক্ত, বেনামী স্বার্থ সংশ্লিষ্ট এবং জালিয়াতি ও প্রতারণার মাধ্যমে ঋণ বিতরণের পরিমাণ শূন্যে নামিয়ে আনার লক্ষ্যে রোডম্যাপ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপিদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছে। কোনো গ্রাহক ঋণ নিয়মিত পরিশোধ না করলে তাকে তাকে ইচ্ছাকৃত খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করা হবে। এই খেলাপিদের সমাজে অনেক সুবিধা থেকে বঞ্চিত করার সুযোগ তৈরি হবে। আগামীতে খেলাপিরা জমি কিনতে গেলে রেজিস্ট্রেশন করতে পারবেন না। নতুন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান কিংবা পুরাতন ব্যবসা সম্প্রসারণ করতে পারবেন না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সকল ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দেওয়া হবে যেন ঋণখেলাপিকে কোনো সহযোগিতা না করে। এমনকি তারা গাড়ি-বাড়ি কিনতে পারবেন না। এমন অবস্থায় পড়তে কোনো ব্যবসায়ী চাইবেন না। তাই, তারা ঋণ নিয়মিত পরিশোধ করবেন।
বেনামে ঋণ কত আছে, জানতে চাইলে ডেপুটি গভর্নর বলেন, বেনামে ঋণ চিহ্নিত করা যাচ্ছে না। তাই কত আছে, এর সঠিক তথ্য নেই। পত্র-পত্রিকায় বেনামে ঋণের তথ্য আসছে। তাই, কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করছে, যেহেতু খবর প্রকাশ হচ্ছে কিছু না কিছু আছে, এটি চিহ্নিত করা হবে।
ডেপুটি গভর্নর জানান, ব্যাংকিং আইন সমুন্নত রেখে ও গত তিন বছরের শ্রেণিকৃত ঋণের তথ্য পর্যালোচনা করে রোডম্যাপ ঘোষণার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এটি বাস্তবায়ন করতে পরলে খেলাপি ঋণ কমবে এবং একই সঙ্গে ব্যাংকিং খাতে সুশাসন নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
তিনি জানান, দুর্বল ব্যাংক সংস্কারের বড় উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। মূলধন, খেলাপি ঋণসহ চারটি সূচকের ভিত্তিতে দুর্বল ব্যাংক চিহ্নিত করা হবে। সবল কোনো ব্যাংকের সঙ্গে দুর্বল ব্যাংক একীভূত হবে। গত ব্যাংকার্স সভায় ব্যাংকগুলোকে বলে দেওয়া হয়েছে—যারা দুর্বল, তারা আগে থেকে প্রস্তুতি নেবে যে, কার সঙ্গে একীভূত হবে। যদি কেউ এ ধরনের প্রস্তুতি না নেয়, তাহলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আর্থিক অবস্থা বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়ে একীভূত করে দেবে।
রোডম্যাপে যা আছে বাংকিং খাতে ২০২৬ সালে ৩০ জুনের মধ্যে খেলাপি ঋণের হার ৮ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনতে নতুন রোডম্যাপ করা হয়েছে। এর মধ্যে একটি খেলাপি ঋণ কমানো, আরকেটি কর্পোরেট সুশাসন নিশ্চিত করা। খেলাপি ঋণ কমাতে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, সেগুলো হলো-
তফসিলি ব্যাংকের কোনো ঋণ দুই বছর মন্দ বা ক্ষতিজনক মানে শ্রেণিকৃত থাকলে তা অবলোপন (রাইট অব) করা যাবে। তবে, সেসব ঋণের বিপরীতে ১০০ শতাংশ প্রভিশন রাখতে হবে। বর্তমানে ৩ বছর মন্দ বা ক্ষতিজনক মানে শ্রেণিকৃত থাকলে ঋণ অবলোপন করার সুযোগ রয়েছে। এর ফলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৪৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকা বা ২ দশমিক ৭৬ শতাংশ কমবে বলে মনে করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
অবলোপন করা ঋণ আদায়ের জন্য দেশের প্রত্যেকটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা প্রধান নির্বাহীর সরাসরি তত্ত্বাবধানে ‘অবলোপনকৃত ঋণ আদায় ইউনিট’ নামে একটি পৃথক ইউনিট গঠন করা হবে।
মন্দ ঋণ এবং রাইট অব করা সম্পদ বিক্রির জন্য বেসরকারি খাতে অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি প্রতিষ্ঠায় আইন প্রণয়ন করা হবে। এই আইনটি খসড়া করা হয়েছে, যা অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। এই আইনের ফলে ব্যাংকগুলো তাদের ব্যালেন্স শিট পরিষ্কার করতে পারবে এবং প্রাপ্ত অর্থ ব্যাংকের আয় খাতে দেখাতে পারবে।
মন্দ, অবোলপন, পুনঃগঠন করা ঋণ বা স্টিজ অ্যাসেটের বিপরীতে আরোপিত সুদ প্রকৃত আদায় না করে আয় খাতে দেখানো যাবে না। স্টিজ অ্যাসেট আদায় বা নিয়মিত না হওয়া পর্যন্ত ব্যালেন্স শিটে দেখাতে পারবে না। কারণ, এই অ্যাসেট ভবিষ্যতে ঋলাপি ঋণে পরিণত হতে পারে।
মহামারি করোনা ও বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার কারণে ঋণ পরিশোধের জন্য দেওয়া বিভিন্ন বিশেষ সুবিধার মেয়াদ আর বাড়ানো হবে না।
মেয়াদী ঋণের মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার সংজ্ঞা, এ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক উত্তম চর্চার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা এবং এ লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট গাইডলাইন ও পরিপত্র সংশোধন অথবা হালনাগাদ করার মাধ্যমে আর্থিক খাত সংস্কারের শর্ত পূরণ হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানায়, বর্তমানে অর্থ ঋণ আদালতে ৭২ হাজার ৫৪৩টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। যেখানে অনাদায়ী অর্থের পরিমাণ ১ লাখ ৭৮ হাজার ২৭৭ কোটি টাকা। ব্যাংকগুলোর বিদ্যমান লিগ্যাল টিম বা আইন বিভাগকে শক্তিশালী করা হলে মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি হবে বলে মনে করছে নিয়ন্ত্রণ সংস্থা।
ব্যাংকের অনাদায়ী অর্থ দ্রুত আদায়ের লক্ষ্যে অর্থ ঋণ আদালত আইন, ২০০৩ এর আওতায় বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি (এডিআর) পদ্ধতিতে আদালতের বাইরে মামলা নিষ্পত্তির জন্য ব্যাংকগুলোকে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়া হবে।
ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের লাগাম টানতে ব্যাংক কোম্পানি (সংশোধন) আইনে সংজ্ঞায়িত ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা হবে।
খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য যেসব কর্মকর্তা কাজ করবেন, তাদেরকে বিশেষ ভাতা দেওয়া হবে।
বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর নিজস্ব মূল্যায়নের পাশাপাশি তালিকাভুক্ত জামানত মূল্যায়নকারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ঋণের বিপরীতে প্রদত্ত জামানত মূল্যায়ন বাধ্যতামূলক করা হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্পোরেট সুশাসন নিশ্চিত করতে আরো ছয়টি পদক্ষেপ ঘোষণা করেছে, এর মধ্যে আছে— যোগ্য পরিচালক নির্বাচিত হলে ব্যাংকের করপোরেট সুশাসন নিশ্চিত হবে, যা ব্যাংকের সামগ্রিক ঋণ ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনাকে শক্তিশালী করবে। তাই, ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডার পরিচালক নিয়োগে বর্তমান ফিট অ্যান্ড প্রোপার টেস্ট প্রক্রিয়া এবং দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কিত নীতিমালা সংশোধন ও হালনাগাদ করা হবে।
ব্যাংকের স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ, সম্মানি নির্ধারণ এবং দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কিত নতুন নীতিমালা প্রণয়ন করা হবে।
ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পদে নিয়োগ ও পুনঃনিয়োগের বাছাই প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনা হয়েছে, যা আগামীতে কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা হবে। তাদের নিয়োগে কর্ম মূল্যায়নে পারফরম্যান্স ইন্ডিকেটর যুক্ত করা হবে।
কর্পোরেট সুশাসনের মান উন্নত এবং খেলাফি ঋণের পরিমাণ কমাতে একক গ্রাহক ঋণসীমা (সিঙ্গেল ব্রোয়ার এক্সপোজার লিমিট) কোনোক্রমেই অতিক্রম না করার ব্যাপারে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হবে।
ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি দূর করতে, পরিচালনা পর্ষদ শক্তিশালী করতে এবং প্রশাসনিক ব্যয় কমাতে কয়েকটি দুর্বল ব্যাংক অপেক্ষাকৃত সবল ব্যাংকের সাথে একীভূত করা হবে। তবে, শর্ত থাকবে—একীভূত করার পরবর্তী তিন বছর কোনো কর্মচারিকে চাকরিচ্যুত করা যাবে না।
ব্যাংকগুলোতে সার্বিক সুশাসন প্রতিষ্ঠায় ব্যাংক কর্মকর্তাদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে মৌলিক প্রশিক্ষণ এবং ব্যাংকিং প্রফেশনাল পরীক্ষা পাস বাধ্যতামূলক করা হবে। এর ফলে ব্যাংকিং সেক্টরে দক্ষ কর্মকর্তার অভাব পূরণ হবে এবং সার্বিক সুশাসন প্রতিষ্ঠা হবে।