নাসরীন জাহান প্রথিতযশা লেখক, ঔপন্যাসিক এবং সাহিত্য সম্পাদক। জন্ম ১৯৬৪ সালের ৫ মার্চ; ময়মনসিংহ জেলার হালুয়াঘাটে। আশির দশকের শুরু থেকেই লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সমাজ বাস্তবতা নাসরীন জাহানের শিশুমনে, চিন্তায় আমূল পরিবর্তন এনে দেয়। সৌন্দর্যপ্রিয় এক শিশু কীভাবে লেখক হলেন সেই গল্পও দারুণ রোমাঞ্চকর! এই সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে তার ছেলেবেলার কথা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন স্বরলিপি।
আপনার ছেলেবেলা, বেড়ে ওঠার সময় বর্ণময়। সরিষা বনে শুয়ে আসমানের মেঘ দেখার দিনগুলো সম্পর্কে জানতে চাই।
নাসরীন জাহান : আহা সর্ষেফুল! তখন আমি খুব ছোটো। গ্রামে তো কেউ ছোটো বাচ্চাদের দেখে রাখে না। ফলে আমি করতাম কি হেঁটে হেঁটে মাঠে চলে যেতাম। তখনও অতো বোধ-বুদ্ধি হয়নি আমার। চলে যেতাম সরিষা ক্ষেতে। ফুলের গন্ধ পেয়ে ক্ষেতেই শুয়ে থাকতাম। আমার বয়স তখন তিন, সাড়ে তিন। ওই বয়সেই আমি আকাশ দেখতাম। অবাক হয়ে মেঘেদের বদলে যাওয়া দেখতাম। আব্বা আমাদের বাড়ির খুব কাছেই চাকরি করতেন। ঘরে ফিরে তিনি আমার খোঁজে এসে দেখতেন, আমি ক্ষেতের ভেতর শুয়ে আছি। আব্বা বলতেন, তুমি কী দেখ আকাশে? আমি বলতাম, মেঘ ভেঙে হাতি হয়ে যায়, ঘোড়া হয়ে যায়। আমার যা যা মনে হয় মেঘ যেন তাই হয়ে যায়। তারপরেও আমি যে কেন আকাশ দেখি সেটা আব্বাকে কিছুতেই বোঝাতে পারতাম না। শুধু চোখ বন্ধ করে একটা শব্দ করতাম পু...। এই ফিলিংসটা ছিল অসাধারণ!
মাত্র নয় বছর বয়সে আপনি ছড়া লিখলেন। ছড়া লেখার গল্পটা জানতে চাই।
নাসরীন জাহান : আমার আব্বাকে বলা যায় বিরাট শিশু। তার মধ্যে শিশুসুলভ সৌন্দর্য ছিল। ছোটো বেলায় আমার কোষ্ঠী গণনা করিয়েছিলেন। জানতে পেরেছিলেন আমার মধ্যে সাহিত্য-কবিত্ব আছে। ওই কারণে তিনি বারবার বলতেন- ও লিখছে না কেন, লিখছে না কেন? আমার যখন একটু একটু করে বোধ তৈরি হচ্ছিল, তখন আব্বার এই কথাটা আমার কাছে তিরস্কার মনে হতো। তখন ‘ঠাকুরমার ঝুলি’ পড়তাম, বিভিন্ন ছড়া পড়তাম- এই করে করে স্কুলে ভর্তি হয়ে গেলাম। পাঠ্যবইয়ের কবিতাগুলো এমন রিদমে পড়তাম, ছন্দ-মাত্রা সব নিজের অজান্তে আয়ত্ত করে ফেলেছিলাম। কথা বলতাম ছন্দে-ছন্দে। একবার স্কুলে বসন্ত উৎসব হলো, তখন কাজিনের সঙ্গে স্কুলে যেতাম। আমার কাজিন মিসকে বলল- ও লিখতে পারবে। তখন মনে হলো একটা ছড়া লিখলে মনে হয় আব্বা খুশি হবে। এরপর ছড়া লিখলাম। ওই সময় যেসব ছড়া লিখেছি তখন যারা পড়েছিলেন তারা বলেছিলেন- মাত্রায় কোনো হেরফের হয়নি। মাত্রাবৃত্ত ছন্দে লিখেও আমি তখনও জানতে পারিনি এটা মাত্রাবৃত্ত ছন্দের কবিতা।
‘চাঁদের হাট’ সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন কীভাবে? সে সময় ওই সংগঠনের কার্যক্রম কেমন ছিল?
নাসরীন জাহান : ক্লাস টু’র বন্ধু পারুল সুলতানা। ও নিজেও কথাসাহিত্যিক। ওর মামা ছিলেন কথাসাহিত্যিক রাহাত খান। ও কোনোভাবে চাঁদের হাটের সঙ্গে যুক্ত ছিল। আমাকেও বললো, চল আমরা চাঁদের হাটে যুক্ত হই। এই যুক্ত হওয়া আমার জীবনে অনেক পজিটিভ ইফেক্ট ফেলেছে। যেমন আমরা ক্লাস সেভেন, এইটে পড়ার সময় চাঁদের হাটের বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানে ঢাকায় চলে এসেছি। তিন-চার দিন থেকেছি। আমার আব্বা-আম্মা কিছুই বলেননি। সেখান থেকে বন্ধুবলয়টা বড়ো হয়েছে। আমরা একসঙ্গে আড্ডা দিয়েছি, খাওয়া-দাওয়া করেছি। উৎসব করেছি। একসঙ্গে নেত্রকোনা গিয়েছি। আব্বা বলতেন, লেখালেখির জন্য যাচ্ছে যাক। বিশ্বাস করলে বিশ্বাস ভাঙা যায় না। সেই পরিবেশ যে কোনো শিশুকেই আত্মবিশ্বাসী আর স্বনির্ভরশীল করে তুলতে পারে। নেত্রকোনায় অনেক সিনিয়রদের সঙ্গে একই প্যারালালে মঞ্চে কথা বলার সুযোগ হতো। ময়মনসিংহে যারা লেখালেখি করতেন তাদের কাছ থেকে দেখার সুযোগ হতো। স্বপ্ন বোনা, অনুপ্রাণিত হওয়া, শিশুর জন্য বিস্মিত হওয়ার সুযোগ তৈরি হতো। চাঁদের হাটের যখন অনুষ্ঠান হতো তখন ঢাকা থেকে অনেক সাহিত্যিক যেতেন। আমরা অনেককে দেখার সুযোগ পেতাম। কবি আল মাহমুদ, শামসুর রাহমানসহ অনেককে দেখেছি। সাহিত্যের অনুষ্ঠান আমাদের কাছে ঈদের থেকেও বড় অনুষ্ঠান ছিল। নেত্রকোনার সাহিত্য সংগঠনের মাধ্যমে অনেক সাহিত্যিক বন্ধু পেয়েছি। আবু হাসান শাহরিয়ার, সৈয়দ আল ফারুক, লুৎফর রহমান রিটন ওরা আমার কিশোরবেলার বন্ধু।
‘শিশু’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় আপনার লেখা প্রকাশিত হয়েছিল। এটা কীভাবে সম্ভব হলো?
নাসরীন জাহান : ওরা স্কুলগুলোতে চিঠি পাঠিয়েছিল, ‘শিশু’ নামে একটি পত্রিকা বের হবে। আমি তখনও গল্প লিখিনি, ছড়া লিখছি। আমার শিক্ষক বললেন, গল্প লিখতে। তিনি বলেছিলেন, যে ছড়া লিখতে পারে সে গল্পও লিখতে পারবে। তখন আমি গল্প লিখলাম। গল্পটা এমন- একটি মেয়ে যে বাঁচবে না। সে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে বিষণ্ন রোদ। সে চায় মৃত্যুর আগে তার একটা গল্প ছাপা হোক। ফলে সে একটি গল্প লিখতে থাকে। তখন আমি ক্লাস সিক্সে পড়ি। আমার গল্পের মেয়েটা যে গল্প লেখে ওইটাই কিন্তু গল্প। গল্পটার নাম হচ্ছে ‘ছাপানো গল্পটা’।
শিশুকিশোর সাহিত্যে নীতিবোধের প্রকাশ কি খুব জরুরি- আপনি কী মনে করেন?
নাসরীন জাহান : নীতিবোধের সঙ্গে উদারতার মিশ্রণ থাকলে কোনো কিছুই কোনো সমস্যা নয়। নীতিবোধ শুধু ছাপানো অক্ষরে শেখানো হলে কোনো কিছুরই বিকাশ হবে না। নীতিবোধ তো একজনের কাছে একেক রকম। যেমন আমার মেয়েকে ছোটোবেলা থেকে কখনও বলিনি যে- মিথ্যা বলো না। আমি তাকে ছেড়ে দিয়েছি। বলেছি যে, তোমার যদি পড়তে ইচ্ছা করে পড়। আমার নিজের বেলায় দেখেছি, ছোটোবেলায় বড়োদের উপন্যাস হাতে নিলাম, যতদূর পড়তে পেরেছি ততদূর পড়েছি। কিন্তু যতদূর পড়তে পারিনি সেটা আমার কোনো ক্ষতি করেনি। একটি শিশু কোনো বই পড়তে শুরু করলে তাকে কোনোভাবেই আটকানো ঠিক না। পৃথিবীর সব কিছু বুঝে বুঝেই সে বড় হবে। বরং গোপন করে যাতে বড়ো না হয়, বইটা যাতে অন্য বইয়ে কভার মলাট করে না পড়তে হয়, সেই রকম একটি পরিবেশ শিশুর জন্য থাকা দরকার। উদারতা, ন্যায়-নীতি মুখে বলে হয় না।
যে মানুষটা ছোটোবেলার সরিষা ফুলের কথা মনে রেখেছে সেই মানুষটা নিশ্চয় ছোটোবেলার প্রিয় ফ্রকের কথাও মনে রেখেছে। অথবা প্রিয় হাস্নাহেনার কথা?
নাসরীন জাহান : আমার প্রিয় হাস্নাহেনা নয়, আমার প্রিয় ফুল শিউলি। সেই গল্পটা তো মারাত্মক! তখন নয়-দশ বছর বয়স। সেই বয়সে পরির গল্প শুনে জেনেছি যে, পরি এসে সুন্দর-সুন্দর বাচ্চাদের নিয়ে যায়। যারা দেখতে সুন্দর, শুধু তাদের নেয়। আমাকে সবাই সুন্দর বলত। আমার ডাকনামও ‘বিউটি’। একাত্তরের যুদ্ধে বাসার বাস্তবতা একটু পাল্টে যায়। শহরে চলে আসে আমার পরিবার। বাস্তবতার সঙ্গে কিছুতেই মানাতে পারছিলাম না। ওই বয়সেই আমার মনে হয়েছিল পরি এসে যদি আমাকে নিয়ে যেত। তাহলে চলে যেতাম। ফেরার সময় সব কিছু নিয়ে আসতাম। বাড়িতে যা যা নাই, তার সব কিছু। পোশাক-খাবার আর যা যা দরকার সব। একদিন ভোরে পরিদের উদ্দেশে বের হই। চোখে কাজল দিয়ে সেজেছিলাম। ঘর থেকে যখন বের হচ্ছিলাম আমার বুকটা তখন ফেটে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল আমি ফিরে আসতে পারবো তো! গল্পে শুনেছি পরিরা বাচ্চাদের নিয়ে যায় আজানের আগে আগে। সেই সময় শিউলি গাছের নিচে গিয়ে বসতে হয়। শিউলি গাছ আমার ভীষণ প্রিয়!
তো শিউলি গাছের নিচে ভোরে বসে আছি। অন্ধকারে টুপ-টাপ শিউলি পড়ছে। দু-একটা পাতা পড়ছে। আর আমার মনে হচ্ছে যে কোনো সময় পরি এসে আমাকে নিয়ে যাবে। আকাশে চলে যাবো। এখন মনে পড়লে বুক কাঁপে কিন্তু সেই বয়সে পেরেছি। আস্তে আস্তে ভোর হলো, রোদ উঠল। কিন্তু পরি এলো না। বাসার সবাই আমাকে শিউলিতলায় খুঁজে পেল। বুঝতে পারলাম গল্পের পরি বাস্তবে নেই। অভাব পূরণে কখনো কোনো পরি আসে না।
প্রিয় একটা ফ্রকের কথাও মনে করিয়ে দিলে। ঈদে আমার নানা একটি ফ্রক দিয়েছিলেন। সবুজ জমিনে বেগুনী প্রিন্ট। ওই ফ্রকটা পরলে নিজেকে পরি পরি লাগতো। ঈদ উপলক্ষে পাওয়া সেই ফ্রকটাই আমার কাছে সেরা হয়ে আছে। ততদিনে আমি কাজল পরা শিখে গিয়েছিলাম।