ক্যাম্পাস

বিরূপ আবহাওয়াসহিষ্ণু ফসলের জাত উদ্ভাবনে গ্রিনহাউস প্রকল্প

কৃষি এ দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড। এটি দেশের মানুষের খাদ্য সুরক্ষা এবং নিরাপত্তার নিশ্চয়ক। খাদ্য সুরক্ষা ছাড়াও জিডিপিতে প্রায় ১২ শতাংশ অবদান রাখে কৃষিখাত। কৃষি পণ্যের উৎপাদনশীলতা পুরোপুরিভাবে তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত, তীব্রতা, বিকিরণ এবং রৌদ্রের সময়কালের মত জলবায়ুর উপাদানগুলোর ওপর নির্ভর করে।

বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে লবণাক্ততা, ঝড়, খরা, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, উচ্চতাপমাত্রা, আকস্মিক বন্যা ইত্যাদির তীব্রতা ত্বরান্বিত হচ্ছে। ফলে দেশের কৃষিতে এর ব্যাপক বিরূপ প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে দেশের জলবায়ুর এই ব্যাপক পরিবর্তনে বিপুল জনসংখ্যার জন্য খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একদিকে প্রতিনিয়ত আবাদি জমি হ্রাস পাচ্ছে, আরেকদিকে ব্যাপকহারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই বহুমুখী সমস্যার মুখোমুখি অবস্থানে জলবায়ু বিরূপ প্রভাব সহিষ্ণু ফসলের জাত উদ্ভাবন করা সম্ভব না হলে খাদ্য চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হবে না।

এরই প্রেক্ষিতে দেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বাকৃবি) প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে অত্যাধুনিক গ্রিনহাউস। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের 'কৃষি আবহাওয়া তথ্য পদ্ধতি উন্নতিকরণ' প্রকল্পের আওতায় ও বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে বাকৃবির অ্যাগ্রোমেটিওরোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. এ বি এম আরিফ হাসান খান রবিনের নেতৃত্বে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এর প্রধান উদ্দেশ্য হলো প্রাকৃতিক বিরূপ প্রভাব সহিষ্ণু ফসলের নতুন জাত উদ্ভাবন করা।

গত বছরে শুরু হওয়া এই প্রকল্পের আওতায় ইতোমধ্যেই স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা বিরূপ আবহাওয়া সহিষ্ণু বিভিন্ন ফসলের জাত উদ্ভাবনে গবেষণা কাজ শুরু করেছেন।

আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির যতগুলো লাভজনক, সময় উপযোগী ও কৃষি উপযোগী প্রজেক্ট আছে তার মধ্যে গ্রিনহাউস বা পলি হাউজ বা পলি টানেল প্রযুক্তিগুলো সারা বিশ্বেই বেশ জনপ্রিয়। এটি হচ্ছে মূলত একটি ঘর যেখানে প্রাকৃতিক বিভিন্ন উপাদান যেমন- তাপ, আলোর দৈর্ঘ্য, পানি, লবণাক্তা, আর্দ্রতা ইত্যাদির মাত্রা নিয়ন্ত্রিত রেখে বিভিন্ন ফসলের উপর এর প্রভাব বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা করা হয়। যার ফলে বছরের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ফসলের উৎপাদন অব্যাহত রাখা যায়।

গবেষণার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত ওই গ্রিনহাউসে রয়েছে আটটি সাধারণ চেম্বার, একটি কোল্ড চেম্বার এবং একটি হিট চেম্বার। গবেষণার জন্যে সব চেম্বারে রোপণকৃত প্রতিটি চারায় পানির পরিমাণ, বিভিন্ন সারের পরিমাণ, পানি ও সার প্রয়োগের সঠিক সময়সহ সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করা হয় একটি কেন্দ্রীয় প্রোগ্রামিং রুমের মাধ্যমে।

কাজটি করা হয় তুরস্ক থেকে নিয়ে আসা সেন্সর নির্ভর ‘এনআরআই ক্রপ টেকনোলজি’ মেশিনের মাধ্যমে। প্রতিটি চারার জন্য যেহেতু পুষ্টি উপাদানের পরিমাণ সমান নয়, তাই সেন্সর নির্ভর এই মেশিনের মাধ্যমে প্রতিটি চারার জন্য পরিমিত পরিমাণ পুষ্টি উপাদান সরবরাহ করা হয়। এছাড়া মেশিনের মাধ্যমে বাহ্যিকভাবে, রোপণকৃত চারায় পতিত আলো, আলোক তরঙ্গের দৈর্ঘ্য, তাপমাত্রা, চারার পানি সহিষ্ণুতা, লবণাক্ততা ইত্যাদি পরিবর্তন করে সৃষ্ট পরিবেশ সহিষ্ণু জাত উদ্ভাবনের গবেষণা করা হচ্ছে।

স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী তানজিম আহমেদ কাজ করছেন জলবায়ু সহিষ্ণু ভুট্টার জাত উদ্ভাবন নিয়ে। তিনি দুইটি আলাদা চেম্বারে ভুট্টার একই জাত নিয়ে গবেষণা করছেন। একটি চেম্বারে স্বাভাবিক তাপমাত্রা এবং অন্য একটিতে অতিরিক্ত তাপমাত্রা দিয়েছেন। এই অতিরিক্ত তাপমাত্রার জন্য ভুট্টা গাছের ভিতরে কি কি পরিবর্তন আসে এবং এই পরিবর্তন কিভাবে প্রশমিত করা যায় তা নিয়েই তিনি কাজ করছেন। গবেষণাটি সফল হলে যেসব অঞ্চলে অতিরিক্ত তাপমাত্রা সেসব অঞ্চলেও তাপমাত্রা সহিষ্ণু উচ্চফলনশীল ভুট্টার জাত চাষ করা যাবে।

স্নাতকোত্তর আরেকজন শিক্ষার্থী জাবের সবুজ। তিনি কাজ করছেন লবণাক্ততা ও উচ্চতাপমাত্রা সহিষ্ণু ধানের জাত উদ্ভাবন নিয়ে। এই ধানের জাত দিয়ে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের প্রায় ১৯ টি জেলায় লবণাক্ততার মধ্যেও ধানের চাষ অব্যাহত রাখা সম্ভব হবে।

শীতকালীন সবজি টমেটো যেন গ্রীষ্মকালেও উৎপাদন করা যায় সে লক্ষ্যে কাজ করছেন স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী সিরাজুম মনিরা। তিনি টমেটোর হিট স্ট্রেস ও বেশি তাপমাত্রা সহিষ্ণু জাত উদ্ভাবন নিয়ে কাজ করছেন। গ্রিনহাউজের মধ্যে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে তার ভিত্তিতে টমেটো গাছের শারীরতাত্ত্বিক পরিবর্তন লক্ষ্য করে ওই জাত উদ্ভাবন করা হবে। ফলে গ্রীষ্মকালেও টমেটো উৎপাদন করা সম্ভব হবে।

বাংলাদেশে বোরো মৌসুমে জলাবদ্ধ পদ্ধতিতে ধান চাষে উৎপাদন ভালো হয়। কিন্তু এই পদ্ধতির চাষে একটি বড় সমস্যা হচ্ছে এটি বেশি পরিমাণে মিথেন গ্যাস নিঃসরণ করে, যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকারক। স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী ফারজানা আক্তার কাজ করছেন জলাবদ্ধ পদ্ধতিতে চাষকৃত ধান গাছের ফলন ঠিক রেখে মিথেন গ্যাসের নিঃসরণ কম করে এমন ধানের জাত উদ্ভাবন নিয়ে।

অধ্যাপক আরিফ হাসান খান বলেন, আমরা একটি অত্যাধুনিক গ্রিনহাউস প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছি। এটির মাধ্যমে উচ্চতর গবেষণার দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে। এই গ্রিনহাউসে টমেটো, ভুট্টা, ধানসহ বিভিন্ন ফসলের তাপমাত্রা, লবণাক্ততা, অতিরিক্ত পানি সহিষ্ণু জাত উদ্ভাবন করার জন্যে গবেষণা চলমান রয়েছে। গবেষণা মাধ্যমে স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি শিক্ষার্থীরা জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব সহিষ্ণু ফসলের জাত উদ্ভাবন করতে পারবে বলে আমি আশা করছি। ফলে দেশের খাদ্য ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব হবে। ভবিষ্যতে এই গ্রিনহাউসের মধ্যে হাইড্রোপোনিক পদ্ধতিতে বিভিন্ন ফসল ও শাকসবজি উৎপাদন করার পরিকল্পনাও রয়েছে। এতে করে কীটনাশকমুক্ত বিশুদ্ধ সবজি উৎপাদন নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।