নদী ভাঙনে মাথাগোঁজার শেষ সম্বল হারিয়ে জীবিকার তাগিদে ফেনী আসেন আছমত আলী। জেলা শহরে এসে শুরুতে রিকশা চালিয়ে বেঁচে থাকার সংগ্রামের পাশাপাশি বিভিন্ন শাকসবজি আবাদ শুরু করেন তিনি। সবজিতে তেমন সফলতা না আসায় কৃষি বিভাগের সহায়তায় শুরু করেন কুল চাষ। মাত্র দুই বছরের মাথায় ভাগ্য বদলে যায় তার। এখন বাগান থেকে দৈনিক ২০ থেকে ২৫ কেজির মতো কুল বিক্রি করছেন এই কৃষক। কেজিপ্রতি ১০০ টাকা দরে এলাকার মানুষজন বাগান থেকে পছন্দ করে কুল কিনতে পারছেন আছমত আলীর কাছ থেকে। চলতি মৌসুমে প্রায় ২ লাখ টাকার মতো কুল বিক্রি করতে পারবেন বলে আশাবাদী এই কৃষক।
আছমত আলী ফেনী সদর উপজেলার পূর্ব ফলেশ্বর আলী আজ্জম ইটভাটা সংলগ্ন এলাকায় থাকেন। পরিবারে তার ৪ ছেলে ও এক কন্যা সন্তান রয়েছে।
কুল চাষের শুরুর পথচলা তুলে ধরে কৃষক আছমত আলী বলেন, লক্ষ্মীপুরের রামগতি থেকে ফেনীতে এসে প্রথমে রিকশা চালিয়েছি। তখন ছোট পরিসরে শাকসবজি আবাদ করতাম। সবজি চাষে তেমন সফলতা পাইনি। পরে কৃষি বিভাগের পরামর্শে তিন বছর আগে ৪০ শতক জায়গায় রাজশাহী থেকে চারা এনে কুল চাষ শুরু করি। সফলতা পেয়ে পরে খুলনা থেকে চারা এনে আরও ২০ শতক জায়গায় আরেকটি বাগান করেছি। প্রথমে করা বাগানটিতে ১০০ চারা লাগালেও কিছুদিন পর প্রায় অর্ধেকের মতো চারা তুলে বাগান ফাঁকা করা হয়। বর্তমানে আমার বাগানে দেড় শতাধিক গাছ রয়েছে। গাছের দূরত্ব কম হলে কুল নষ্ট হয়ে যায়। ফাঁকা রাখলে ফলন ভালো হয়।
তিনি বলেন, বল সুন্দরী জাতের কুল চাষে বেশি সফলতা পেয়েছি। এই জাতের কুল খেতে অনেক মজার। ফলনও ভালো পাচ্ছি। বর্তমানে দুইটি বাগানে বল সুন্দরী ও কাশ্মিরী বাউকুল আছে। এখন বাগান থেকে দৈনিক ২০ থেকে ২৫ কেজির মতো কুল বিক্রি হয়। কেজিপ্রতি ১০০ টাকা করে এলাকার মানুষজন বাগান থেকে কুল কিনতে পারছেন। চলতি মৌসুমে প্রায় ২ লাখ টাকার মতো কুল বিক্রি করতে পারবো।
সমন্বিত চাষ পদ্ধতি নিয়ে আছমত আলী বলেন, দুয়েকমাস ছাড়া বছরের পুরো সময়েই কুল চাষের পাশাপাশি বিভিন্ন সবজি আবাদ করি। এখনো কুল বাগানে আদা ও হলুদ রয়েছে। এছাড়া বছরজুড়ে অন্যান্য ফসলের মতো কুল চাষে খুব বেশি পুঁজি দিতে হয় না। এজন্য লাভের পরিমাণও ভালো।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, পোকা ও পাখির আক্রমণ থেকে রক্ষায় বাগানের চারপাশে মশারি জালের বেড়া দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি গাছের থোকায় থোকায় ঝুলছে লাল-সবুজ রঙের কুল। কুলের ভারে মাটিতে নুয়ে পড়েছে গাছের ডাল। সুস্বাদু কুল নিজেই গাছে থেকে পারতে দেখা যায় কৃষক আছমত আলীকে।
কৃষক আছমত আলীর বড় ছেলে মো. বেলাল বলেন, নদী ভাঙনে বাড়ি হারিয়ে লক্ষ্মীপুর থেকে আমরা ফেনী চলে আসি। তখন রিকশা চালিয়ে বাবা আমাদের অনেক কষ্ট করে বড় করেছেন। বাবা বিভিন্ন শাকসবজি আবাদ করলেও তেমন সফলতা পাননি। পরে এই কুল বাগান করে আমাদের পরিবারে সুদিন ফিরেছে। এখন প্রতিবছর দুইটি বাগান থেকে ২ লাখ টাকার বেশি আয় হয়।
মো. আমজাদ নামে এক ক্রেতা বলেন, ভেজালমুক্ত কুল কিনতে এখানে এসেছি। বাগানে উৎপাদিত কুল কিনতে মানুষের আগ্রহ বেশি। সাধারণত, এভাবে সরাসরি বাগান থেকে কুল সংগ্রহ করা সম্ভব হয় না। তাই এখানে এসেছি।
মো. সজীব উদ্দিন নামে অপর এক ক্রেতা বলেন, এখানে এসে নিজেই গাছ থেকে পছন্দ করে কুল নিতে পারছি। বাজারে কিনতে গেলে ভেজাল নিয়ে শঙ্কার মধ্যে থাকতে হয়। কিন্তু, এখান থেকে ভেজালমুক্ত কুল কিনতে পারছি।
বিজয় নামে স্থানীয় এক যুবক বলেন, কৃষক আছমতের উদ্যোগ আমাদের জন্য শিক্ষনীয়। বিশেষ করে তরুণদের আত্মকর্মসংস্থানের উপযুক্ত ক্ষেত্র হিসেবে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এখানে এসে বাগানের মালিক থেকে কুল চাষের বিষয়ে ধারণা নিচ্ছি। সুযোগ হলে ভবিষ্যতে এমন উদ্যোগ বাস্তবায়নের ইচ্ছে আছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, চলতি মৌসুমে জেলায় ৯০ হেক্টর জমিতে কুলের আবাদ হয়েছে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ১০৮০ মেট্রিক টন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে জেলায় কুলের আবাদ হয়েছিল ৮৬ হেক্টর জমিতে। ফলন হয়েছিল ৯৩৮ মেট্রিক টন।
সদর উপজেলার কাজীরবাগ ইউনিয়নে দায়িত্বরত উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. নাছির উদ্দিন বলেন, কৃষি বিভাগ সবসময় এই কৃষকের পাশে থেকেছে। বিভিন্ন রোগবালাই প্রতিরোধে এবং বাগান পরিচর্যা বিষয়ে পরামর্শসহ দিক-নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। একই জমিতে তিনি (আছমত আলী) কুল চাষের পাশাপাশি বিভিন্ন শীতকালীন সবজিও আবাদ করছেন। এতে লাভবান হচ্ছেন তিনি।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক মো. জগলুল হায়দার বলেন, ফেনীর মাটি ও সামগ্রিক পরিবেশ কুল আবাদের জন্য ইতিবাচক। আগামীতে এ জেলায় কুলের আবাদ আরও বাড়তে পারে। এটি এ জনপদের জন্য আশার আলো। কুল চাষে কৃষক যেমন লাভবান হবেন তেমনি দেশও লাভবান হবে। পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। পাশাপাশি দেশ বাণিজ্যিক কৃষিতে এগিয়ে যাবে।