আখতার হুসেন। শিশুসাহিত্যিক। ছড়া, কবিতা, গল্প, উপন্যাস- সাহিত্যের সব শাখায় তাঁর সমান পদচারণা। সাংবাদিকতা দিয়ে কর্মজীবন শুরু। বই সম্পাদনা করে প্রশংসিত হয়েছেন। শিশু একাডেমি থেকে ৫ খণ্ডে প্রকাশিত শিশু-বিশ্বকোষের তিনি অন্যতম সম্পাদক। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের জন্য তিনি গান লিখেছেন। স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার। শুদ্ধতম বিরল এই শিশুসাহিত্যিকের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মুজাহিদ বিল্লাহ
শিশুসাহিত্যিক হিসেবে আপনি দীর্ঘ পথ অতিক্রম করেছেন। লেখালেখির শুরুর কথা জানতে চাই।
প্রথম আমি শুরু করেছিলাম ছোটোগল্প, উপন্যাস দিয়ে। আমি ক্লাস এইট থেকে ইন্টারমিডিয়েট ফার্স্ট ইয়ার পর্যন্ত ১১৩টি ছোটোগল্প এবং চারটা উপন্যাস লিখেছিলাম। যখন একটু বয়স হলো তখন দেখলাম, আমার লেখায় অনেকের প্রভাব আছে। আমার এটা ছাপা ঠিক হবে না। এরপর ১১১টি গল্প আমি ছিঁড়ে ফেললাম। শুধু দুটো গল্প এবং চারটি উপন্যাস রাখলাম। গল্প দুটো এখনও রয়ে গেছে। আমি গ্রন্থভূক্ত করিনি।
ছিঁড়ে ফেলার পর কখনও কি মনে হয়েছে ভুল করলেন। বা পরে তো সেগুলো রিরাইট করা যেত।
কখনও আক্ষেপ হয়নি। বরং তৃপ্তি পেয়েছি। কারণ আমি তখনই বুঝতে পেরেছিলামÑ আমার তো এ রকম করলে চলবে না, আমাকে আমার মতো করতে হবে। আমি যখন শিশুসাহিত্যের দিকে গেলাম ১৯৬৪ সালে, দৈনিক ‘আজাদ’-এর সাহিত্য পাতায় একটি আর্টিকেল ছাপা হলো পাকিস্তানের ছড়াসাহিত্য নিয়ে। সেই পত্রিকায় অনেক বড়ো বড়ো সাহিত্যিকদের ছড়া কাটছাট করা হয়েছে। কারোটা ছাপা হয়েছে চার লাইন, দুই লাইন কিন্তু আমারটা পুরোটা ছেপেছে। এটা আমাকে বিশালভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল। আমাকে দিশারীর মতো পথ দেখিয়েছেন রফিকুল হক দাদুভাই, কবি হাবিবুর রহমান, এ রকম অনেকেই।
নিশ্চয়ই অনেক প্রতিকূল পথ পাড়ি দিতে হয়েছে?
১৯৬৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর অনেক শীতের মধ্যে আমি ঢাকা শহরে আসি। পাতলা ফিনফিনে একটা পাঞ্জাবি এবং স্পঞ্জের স্যান্ডেল পায়ে ছিল। আমার আব্বা রাজনীতি করতেন। আব্বার চাকরি চলে গিয়েছিল, পাঁচ বছর তাঁর চাকরি ছিল না। সে সময় এগারোজন ভাই-বোনের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়ে আমি ঢাকা চলে এসেছিলাম। সংগ্রাম করে করেই আসলে এ জায়গায় এসেছি। এখনো আমার কাছে অনেকে অনেক লেখা চায়। কিন্তু নানান ধরনের ব্যস্ততায় আমি লিখতে পারি না। যদি এসব ব্যস্ততা না থাকতো আমি আরো দুটো উপন্যাস লিখতে পারতাম শিশুদের জন্য। সবসময় আমার মাথায় লেখার থিম ঘুরতে থাকে।
স্বাধীনতার আগেই আপনার বই প্রকাশিত হয়েছে। তখন তো এত প্রকাশক ছিল না। সেটা কীভাবে সম্ভব হলো?
আমার প্রথম বই ছাপা হলো ১৯৭০ সালে; ‘সমুদ্র অনেক বড়’। আমি তখন এতোটাই খুশি হয়েছিলাম যে, আনন্দে কেঁদেছিলাম। একটা ব্যাপার বলতে চাই, বইটির আদ্যোপান্ত দেখে দিয়েছিলেন আমাদের গুরু অর্মত্য সেনের মামা সত্যেন সেন। আমি সৌভাগ্যবান, আমার প্রথম বই তাঁর সংস্পর্শে এসেছে। বইটি ছাপা হয় খান ব্রাদার্স থেকে। সে সময় খান ব্রাদার্স খুব নামী-দামি ছাপাখানা। এখান থেকেই তখন নির্মলেন্দু গুণের ‘প্রেমাংশুর রক্ত চাই’ ছাপা হয়েছিল। এরপর যুদ্ধ শুরু হলো। স্বাধীনতার পর একে একে কিশোর কবিতা, ছড়ার বই প্রকাশ হতে শুরু করলো। আমার সব মিলিয়ে মৌলিক বইয়ের সংখ্যা সত্তুর হবে। সেখানে আমি লিখে অতৃপ্ত নই। আমি আরো লিখতে না পারার জন্য অতৃপ্ত। লেখার সুযোগ না পাওয়ার জন্য আমার মধ্যে অতৃপ্তি কাজ করে। ‘মুক্তধারা’ যখন আত্মপ্রকাশ করল তখন আমাদের বই প্রকাশের একটা নতুন পথ উন্মোচন হলো। তখন আমার পরপর তিনটি বই ছাপা হলো। বই প্রকাশের জন্য তাদের এডিটর ছিলেন, প্রুফ রিডার, এমনকি পাণ্ডুলিপি সিলেকশন করার জন্যও লোক ছিলেন। গ্রন্থ সম্পাদক আর কোথায় পাবেন? এক আমাদের এখানে (প্রথমা) আর হয়তো ‘ইউপিএল’, আর কোথাও পাবেন বলে আমার মনে হয় না। অনেকে বাইরে থেকে চুক্তিতে কাজ করিয়ে নেয়- এই বইটা আপনি দেখে দেবেন, আপনাকে এত টাকা দেব। আমিও বই সম্পাদনা পেশায় রয়েছি। ফলে অফিস শেষ করে যখন বাসায় যাই তখন শরীর ভেঙে পড়ে। কাজ করতে ইচ্ছা হয় না।
বইমেলার শুরুর সময়টা আপনি দেখেছেন। কতটা পরিবর্তন চোখে পড়ছে?
আমাদের বইমেলা দিনের পর দিন উন্নতি হয়েছে। কিন্তু একটা জিনিস করা উচিত- আরেকটা বইমেলা। যেমন ফ্রাঙ্কফুর্ট বুক ফেয়ার। ওটার স্থায়িত্ব খুব বেশি দিনের নয়। সেখানে দেশ-বিদেশের সমস্ত রাইটাররা আসে। সেখানে বই শো করে। সেখানে বই বিক্রি হয় না। সেখানে মূলত বুক এজেন্টরা কাজ করে। আপনার বই কত ভাষায় ছাপা হবে এজেন্টরাই এগুলোর দেখভাল করে। তোমার বই আমি কত ভাষায় ছেপে দেব, তুমি আমাকে কতো টাকা দেবে- এই হলো ব্যাপার। তারাই প্রকাশক ঠিক করে। আমাদের বই কেন বিদেশে যাবে না, ছাপা হবে না? ইংরেজি, ফরাসি, স্প্যানিশ ভাষায় আমাদের বই ছাপা হওয়া উচিত। আমাদের আন্তর্জাতিক বইমেলা করা উচিত।
বাংলা একাডেমি তাদের মতো করে চেষ্টা করছে।
না বাংলা একাডেমি অত কাজ আসলে করতে পারবে না। তাদের নিজেদের হচ্ছে গবেষণার কাজ। বাংলা একাডেমির বইমেলার পক্ষে আমি না। যখন এটা হচ্ছে চলুক। ভবিষ্যতে এটা অন্য কারো মাধ্যমে হলে ভালো হয়। এটা একটা ব্যাপার। হঠাৎ করে তো এটা পাল্টানো যায় না, এটা ঐতিহ্য দাঁড়িয়ে গিয়েছে। লোকজন যদি বলে যে, বাংলা একাডেমির মাধ্যমে সবকিছু শৃঙ্খলাপূর্ণভাবে হচ্ছে তাহলে সেটা মানতে হবে। এখানে বিতর্কের কোনো ব্যাপার নেই। এখন আমাদের লেখালেখির মান বাড়াতে হবে। এই যে এত পাবলিশার আপনি কি মনে করেন সবার বই সমানভাবে বিক্রি হয়? তাদের সবার বই কি সমান মানের হয়? হয় না। এই জায়গাটায় আমাদের কঠোর হতে হবে। মেলা শুধু বড়ো করে করার অর্থ এই নয় যে, লোক দেখানো, এটা লোক দেখানো বিষয় নয়। বই বিক্রি কিন্তু কমে গেছে। কেন এটা হলো ভাবতে হবে। সবাইকে খুব সিলেক্টিভ হয়ে বই প্রকাশ করতে হবে।
অনেক সময়ই শোনা যায়- শিশুসাহিত্যের মান পড়ে যাচ্ছে। এর ঐতিহ্যগত যে ধারা আমরা ধরে রাখতে পারছি না।
আমাদের কিছু গ্যাপ রয়েছে। যেমন ভারতে যদি আপনি সাহিত্যিক দেখেন, তাঁরা নাটকও লিখছে, আবার কবিতাও লিখছে। হাসির গল্প, ভূতের গল্প, অ্যাডভেঞ্চার লিখছে। আমাদের কয়জন এটা করে? সুকুমার রায়ের কথা যদি আপনি বলেন। আরো যদি আপনি অনেককে দেখেন, তাহলে দেখবেন তাদের লেখার ব্যাপ্তিটা আসলে চারপাশে ছড়ানো। আমাদের এখানে সেটা নেই। এটা একঘেঁয়েমি, যে ছড়া লিখছে সে ছড়াই লিখছে, যে উপন্যাস লিখছে সে উপন্যাসই লিখছে। আমাদের পূর্ণাঙ্গ শিশুসাহিত্যিক প্রয়োজন। এখন জাফর ইকবাল উপন্যাস লিখছে। সে এখন পয়সা পাচ্ছে লিখছে। ভূতের গল্প লিখছে। হাসির গল্প লিখছে। তাঁর হাসির গল্প কি হয় আমি জানি না। হলে তো ভালোই। আমি খুব যে পড়ি এমন নয়। কিন্তু ম্যাক্সিমাম তরুণ লেখক আর যাই বলেন তাঁরা ওই ছড়া কবিতা, কিশোর কবিতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আমাদের নাটক লিখতে হবে, হাসির গল্প লিখতে হবে, আমাদের গান লিখতে হবে ছোটোদের জন্য। আমাদের ভূতের গল্প লিখতে হবে, রোমাঞ্চকর গল্প লিখতে হবে। পূর্ণাঙ্গ শিশুসাহিত্যিক আমাদের নেই।
আমাদের ছড়া এবং কিশোর কবিতার একটা মান আছে। একটা বড়ো সাম্রাজ্য আছে। এমন সাম্রাজ্য ভারতেও নেই। কিন্তু অন্যান্য ক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে আছি। এসব ক্ষেত্রে খুব দুর্বল এবং গরিবানা হাল আমাদের। আমি যেটা বারবার বলছি নাটক, গান এসবের খুব অভাব আমাদের। এখন যারা লিখছে তাদের লেখা যে খুব মানসম্পন্ন এমন বলা যায় না। এটা সমালোচনার মতো শোনালেও ধ্রুব সত্য। সেসব লেখার দিকে আমাদের অবশ্যই জোর দিতে হবে।