কামরুল হাসান শায়কের প্রধান পরিচয় তিনি প্রকাশক। দেশের প্রকাশনাকে সমষ্টিগতভাবে বিশ্বমানে উন্নীত করে আন্তর্জাতিক প্রকাশনাপ্রবাহে সংযুক্ত করার লক্ষ্যে তিনি কাজ করছেন। দেশ এবং দেশের বাইরে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বইমেলায় বাংলাদেশের সরব উপস্থিতি নিশ্চিত করতে তার রয়েছে প্রশংসনীয় অগ্রণী ভূমিকা। কামরুল হাসান শায়ক বর্তমানে পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন। পাঠকের প্রত্যাশা পূরণে প্রতিষ্ঠানটি ফিকশন, নন-ফিকশন, ফ্যান্টাসি, সায়েন্স ফিকশন, হরর, কমিক্স, অটোবায়োগ্রাফি, অনুবাদ ইত্যাদি বই নিয়ে কাজ করছে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন স্বরলিপি
অমর একুশে বইমেলার সময় প্রায় ফুরিয়ে এলো। এ বছর পাঞ্জেরীর আয়োজন কেমন ছিল?
কামরুল হাসান শায়ক : অমর একুশে বইমেলা উপলক্ষে পাঞ্জেরীর আয়োজন বরাবরের মতোই বর্ণাঢ্য, তবে এবার অনেক বেশি সমৃদ্ধ। সব ধরনের পাঠকের কথা মাথায় রেখে সেরা লেখকের সেরা পাণ্ডুলিপির একশো পনেরোটি শিরোনামের বই এবার প্রকাশ করেছে পাঞ্জেরী।
‘সেরা পাণ্ডুলিপি’র কথা বললেন। অর্থাৎ আরো অনেক পাণ্ডুলিপি থেকে সেগুলো নিশ্চয়ই বাছাই করতে হয়েছে। পাণ্ডুলিপি নির্বাচনে পাঞ্জেরী কীভাবে কাজ করে?
কামরুল হাসান শায়ক: পাণ্ডুলিপি নির্বাচনে পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স বহুমাত্রায় কাজ করে। আমাদের একুইজিশন টিম প্রতিষ্ঠিত ও জনপ্রিয় লেখকদের সঙ্গে যোগাযোগ তো রাখেই, সেইসঙ্গে নতুনদের মধ্যে যারা ভালো লিখছেন, তাদের প্রতিও একটা গভীর পর্যবেক্ষণ রাখে। আবার অনেক সম্মানীত লেখক স্বেচ্ছায় পাণ্ডুলিপি জমা দেন প্রকাশের অভিপ্রায়ে। পাণ্ডুলিপি নির্বাচনে আমাদের সম্পাদনা পর্ষদ মূলত যে বিষয়গুলো বিবেচনায় নেন, সেগুলো হচ্ছে - লেখার বিষয়বস্তু, লেখার মান, লেখকের প্রোফাইল, পাঠক উপযোগিতা, প্রকাশ উপযোগিতা ইত্যাদি।
বাংলা ভাষার অনুবাদ সাহিত্যের সামগ্রিক উন্নয়ন ও বিকাশের লক্ষ্যে (বিটিএফ) ও পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি. একসঙ্গে কাজ শুরু করেছে। এটা দারুণ ব্যাপার! এই কাজের ক্ষেত্র এবং ধরণ আসলে কেমন হবে?
কামরুল হাসান শায়ক : বাংলা ভাষায় অনুবাদ সাহিত্যের সামগ্রিক উন্নয়ন ও বিকাশের লক্ষ্যে পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি. প্রায় এক দশক আগে থেকেই কাজ শুরু করে। লক্ষ্য বাস্তবায়নে সমষ্টিগতভাবে সৃজনশীল প্রকাশক সমিতিকেও আমরা উদ্বুদ্ধ করি এবং পরবর্তী কালে সরকারকেও অনুপ্রাণিত করি। ২০১৩ সালে এ লক্ষ্য বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যেই তৎকালীন সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির সভাপতি জনাব ওসমান গনিকে সঙ্গে নিয়ে ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় অংশগ্রহণ এবং সেইসঙ্গে ইন্টারন্যাশনাল পাবলিশার্স অ্যাসোসিয়েশনের কংগ্রেসে যোগদান করে প্রকাশনার বিশ্বসভায় বাংলাদেশকে পৌঁছে দেয়ার জন্য নিরলস কার্যক্রম শুরু করি। পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স ২০১৫ ও ২০১৬ সালে ফ্রাঙ্কফুর্ট এবং লন্ডন বুক ফেয়ারে দুটি বইয়ের ইংরেজি অনুবাদের আন্তর্জাতিক রাইট বিক্রয় করতে সক্ষম হয়। অনুবাদ নিয়ে বিশাল কর্মযজ্ঞের অংশ হিসেবে বাংলা বা অন্য যে কোনো ভাষা থেকে ইংরেজি অনুবাদের বই প্রকাশের জন্য পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স আরও একটি ডেডিকেটেড প্রকাশনা সংস্থা গড়ে তোলে ২০২০ সালে। এটির নাম- ওয়ার্ডস অ্যান্ড পেইজেস। সম্প্রতি বিটিএফ তথা বাংলা ট্রান্সলেশন ফাউন্ডেশনের কিছু কার্যক্রম আমাদের চোখে পড়ে। গত বছর একুশে বইমেলার সময় পাঞ্জেরীর প্যাভিলিয়নে বিটিএফ-এর আনিসুজ্জামান, শাহাব আহমেদ এবং মোজাফফর হোসেনের সঙ্গে কাজ করার বিষয়ে প্রাথমিক কথাবার্তা হয়। তারই ধারাবাহিকতায় এক বছরের যৌথ কার্যক্রমের দৃশ্যমান অংশ হলো অনুবাদক সম্মেলন, পুরস্কার এবং অনুবাদ সাহিত্য পত্রিকা ‘যুক্ত'র প্রকাশ।
তবে আমাদের আরও অনেক বেশি কার্যকর কার্যক্রম আরও গতিশীলতার সঙ্গে অগ্রসর করানো উচিত। অনুবাদের এই অগ্রযাত্রা বেগবান করে লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে সামগ্রিক সমষ্টিগত উদ্যোগ বাড়াতে হবে। দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক প্রকাশক সমিতিকে সংযুক্ত করতে হবে, দেশ-বিদেশের অনুবাদক, লেখক, প্রকাশকের অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেতে হবে। অর্থাৎ এর সফল বাস্তবায়নে আমাদের আরও দীর্ঘপথ মেধা, দক্ষতা ও যোগ্যতার সঙ্গে পাড়ি দিতে হবে। পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স এ কাজগুলো দীর্ঘদিন ধরে এগিয়ে নিচ্ছিল, বিটিএফ যুক্ত হওয়ায় আমাদের কাজের গতি আরও ত্বরান্বিত হবে বলে আশা করি।
বাংলাদেশের একজন প্রকাশক; যিনি ইংরেজি ভাষায় বই প্রকাশ করেন না, তিনি কীভাবে আন্তর্জাতিক বইমেলায় অংশগ্রহণ করতে পারেন? আমি মূলত সেখানে অংশগ্রহণের নিয়ম-কানুন সম্পর্কে জানতে চাচ্ছি।
কামরুল হাসান শায়ক : বাংলাদেশের যে কোনো প্রকাশক যাবতীয় নিয়ম-কানুন মেনে আন্তর্জাতিক বইমেলায় অংশগ্রহণ করতে পারেন। অংশগ্রহণের নিয়ম-কানুন আয়োজকদের ওয়েবসাইটে দেওয়া থাকে। তবে অংশগ্রহণের আগে প্রকাশককে তার লক্ষ্য স্থির করে নেওয়া উচিত। পৃথিবীতে মূলত তিন ধরনের বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। ১. পাবলিক বুক ফেয়ার ২. প্রফেশনালস বুক ফেয়ার ৩. প্রফেশনালাস অ্যান্ড পাবলিক বুক ফেয়ার। যেমন কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলা হচ্ছে পাবলিক বুক ফেয়ার। এখানে প্রকাশক বই খুচরা এবং পাইকারি বিক্রি করতে পারেন। ফ্রাঙ্কফুর্ট বুক ফেয়ার মূলত প্রফেশনালস বুক ফেয়ার। এখানে বই বিক্রি হয় না, বিক্রি হয় বইয়ের আন্তর্জাতিক রাইট। লন্ডন বুক ফেয়ারে বইয়ের রাইটও বিক্রি হয়, খুচরা-পাইকারি বইও বিক্রি হয়। অর্থাৎ এটি প্রফেশনালস অ্যান্ড পাবলিক বুক ফেয়ার। প্রকাশক মেলার এই ধরন স্টাডি করে তার জন্য সবচেয়ে লাভজনক আন্তর্জাতিক বইমেলায় অংশগ্রহণ করবেন। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতিও প্রকাশকদের সহযোগিতা করে।
এখন যে কথাটির চর্চা খুব বেশি হয়- বই প্রকাশ হচ্ছে, সে তুলনায় পাঠক কম। আসলে সমৃদ্ধ রিডিং সোসাইটি কীভাবে গড়ে উঠতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
কামরুল হাসান শায়ক : শক্তিশালী রিডিং সোসাইটি গড়ার লক্ষ্যে নিম্নলিখিত কর্মপরিকল্পনা নেওয়া যেতে পারে। ক. মানসম্মত পাণ্ডুলিপি নির্বাচন করে পেশাদারীত্বের সঙ্গে বইয়ের প্রকাশনা ও বিপণন নিশ্চিত করা। খ. দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাৎসরিক ক্যালেন্ডারে বছরে কমপক্ষে একবার সপ্তাহব্যাপী বইমেলার আয়োজন নিশ্চিত করা। গ. দেশে-বিদেশে বইমেলা আয়োজনের চর্চা বাড়াতে হবে। ঘ. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আধুনিক পাঠাগার ব্যবস্থাপনা এবং সক্রিয় ও কার্যকর কার্যক্রম নিশ্চিত করা। প্রতি শ্রেণিকক্ষে বয়সভিত্তিক বই কর্নারের ব্যবস্থা করা। ঙ. দেশের সরকারি-বেসরকারি পাঠাগারের প্রসার ও বিদ্যমান পাঠাগারের কার্যক্রম যুগোপযোগী ও আধুনিকায়নের মাধ্যমে এগুলোর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণ করা। চ. দেশে পাঠ্যাভ্যাস আন্দোলন বেগবান করার লক্ষ্যে সুচিন্তিত গবেষণা, কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা।
আরেকটি বিষয়ে জানতে চাই। যে কথাটি এখন হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, বই প্রচারের দায়িত্ব মূলত কার- লেখক না প্রকাশকের?
কামরুল হাসান শায়ক : বই প্রচারের দায়িত্ব প্রকাশকের। লেখক যদি প্রচারণা করেনও, সেটাও প্রকাশকের বিপণন পরিকল্পনার অংশ হিসেবে করবেন এবং লেখকের প্রচারণার অংশটি অবশ্যই প্রকাশকের বিপণন পরিকল্পনার সঙ্গে সিন্কোনাইসড হতে হবে। লেখক- প্রকাশকের বিচ্ছিন্ন প্রচারণা বা বিপণন বইটি সম্পর্কে পাঠককে অনেক সময় ভুল বার্তা দিতে পারে, যা লেখক ও প্রকাশক উভয়ের জন্যই ক্ষতিকর।
দেশের বাইরে বাংলাদেশের বইয়ের রাইট বিক্রয়ের ক্ষেত্রে সংকট আসলে কোথায়?
কামরুল হাসান শায়ক : বাংলাদেশের বইয়ের রাইট বিক্রয়ের ক্ষেত্রে ভয়াবহ সংকট ভালো পাণ্ডুলিপি, ভালো অনুবাদ। প্রকাশনা বিশ্বে বইয়ের রাইট বিক্রয়ের বিপুল সম্ভাবনা থাকার পরও ভালো অনুবাদ আর সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ সহযোগিতার অভাবে আমরা ভীষণ পিছিয়ে পড়ছি। ফ্রাঙ্কফুর্ট এবং লন্ডন বইমেলার ধরন সম্পর্কে একটু আগে আমি বলেছি। আমাদের দেশে বইমেলা আয়োজনের ধরন হচ্ছে পাবলিক বইমেলার। আমাদের দেশে আমরা লন্ডন বুক ফেয়ার আদলে একটি আন্তর্জাতিক বইমেলার আয়োজন করতে পারি। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এখনই প্রফেশনাল বইমেলা না করে বরং প্রফেশনাল অ্যান্ড পাবলিক বুক ফেয়ার অর্থাৎ লন্ডন বুক ফেয়ার স্টাইলে বছরে একবার একটি আন্তর্জাতিক বইমেলা করার প্রয়োজনিয়তা অনস্বীকার্য।
পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি. সৃজনশীল বইয়ের ডিজিটাল প্রচারণা করছে- চমৎকার উদ্যোগ! এর প্রভাব কেমন বলে মনে করছেন?
কামরুল হাসান শায়ক : সৃজনশীল বইয়ের ডিজিটাল প্রচারণা হতে পারে- এটা যে সময় কেউ কল্পনাও করেনি, ঠিক তখন আমরা অত্যন্ত সৃজনশীল কায়দায় বইয়ের ডিজিটাল প্রচারণা করে সবাইকে অবাক করে দিয়েছিলাম! অনেকে সমালোচনা করেছেন তখন। কিন্তু আজকের বাস্তবতা হচ্ছে সবাই বইয়ের ডিজিটাল প্রচারণায় নেমে পড়তে বাধ্য হয়েছে। ডিজিটাল প্রচারণা ছাড়া বইয়ের ব্যাপক বিক্রি আজ কেউ কল্পনা করতে পারছে না। মজার ব্যাপার হচ্ছে পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স এখন আর প্রচারণা পর্বে বসে নাই। পাঞ্জেরী বই নিয়ে প্রবেশ করেছে ডিজিটাল মার্কেটিং এবং ই-কমার্সের বিপুল সম্ভাবনার দুনিয়ায়। আমরা সবসময় এগিয়ে থাকি। ফলাফল ভালো বলেই আমাদের দেখানো পথ অনেকেই এখন অনুসরণ করছেন।