দুর্নীতি আর অনিয়মকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ডিপিডিসি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নিয়োগে বিপুল পরিমাণ অর্থ নিয়ে মাঠে নেমে ব্যর্থ হয়ে এখন নতুনভাবে তৎপর হয়েছে একটি চক্র। উদ্দেশ্য, নতুন এমডির কাজে ব্যাঘাত ঘটানো আর তাকে ব্যর্থ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। এ নিয়ে কোম্পানির নির্বাহী পরিচালকদের মধ্যে চক্রান্তের বার্তা দেওয়া হচ্ছে। একইসঙ্গে ক্ষমতা আর অর্থের দাপট দেখিয়ে পছন্দের জায়গায় বদলিও নেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। ডিপিডিসির বিশ্বস্ত সূত্রে এসব খবর মিলেছে।
ডিপিডিসির সূত্র বলছে, এসবের নেতৃত্ব দিচ্ছে বারবার নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের শিরোনাম হওয়া প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আহসান-উল-ইসলাম-সরকার। যিনি বর্তমানে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা এনওসিএসে কর্মরত।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মূলত অনিয়ম আর দুর্নীতিতে সিদ্ধহস্ত ডিপিডিসির এই কর্মকর্তা যেখানেই যান, সেখানেই গড়ে তোলেন কালোটাকার সাম্রাজ্য। এজন্য যেখানে টাকার গন্ধ পান, সেখানেই বদলি নিতে মরিয়া হয়ে ওঠেন তিনি। বিপুল পরিমাণ টাকা ঘুষ দিয়ে বাগিয়ে নেন নিজের পছন্দের এলাকায় বদলি। এরপর শুরু হয় দুর্নীতি আর অনিয়ম। এ কাজে তিনি গড়ে তুলেছেন বিশাল সিন্ডিকেট। এতে কাউকে পথের কাঁটা মনে করলে, তাকে ম্যানেজ করেন। মূলত নিজের ইচ্ছেমত দুর্নীতি করতে ডিপিডিসি’র ব্যবস্থাপনা পরিচালকের চেয়ারে নিজের পছন্দের ব্যক্তিকে চেয়েছিলেন তিনি।
সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র জানায়, ডিপিডিসিতে পছন্দের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগের জন্য মাঠে নেমেছিলেন আহসান সরকারের নেতৃত্বে সাউথ বেল্টের বেশ কয়েকজন নির্বাহী প্রকৌশলী ও বিভিন্ন স্তরের কয়েকজন প্রকৌশলী-চক্র। যদিও তাদের সেই স্বপ্ন লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে। যাকে নিয়ে তারা এমডির রেসে নেমেছিলেন, তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠানটির সাবেক প্রধান প্রকৌশলী ও জিটুজি প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক (পিডি) মো. মাহবুবুর রহমান।
ডিপিডিসিতে কর্মরত থাকাকালে প্রকৌশলী মাহবুবের দুর্নীতি ও লুটপাটের বিষয়টি ছিল ‘ওপেন সিক্রেট’। নানা কারণে ছিলেন নেতিবাচক শিরোনামে সমালোচনার তুঙ্গে। তিনি কানাডার স্থায়ী নাগরিক। তাকে এমডি পদে বসাতে নির্বাহী প্রকৌশলী আহসান সরকার নিজে ২৫ লাখ টাকা দিয়ে অন্যদের কাছ থেকে আড়াই কোটি টাকা তুলেছিলেন যে কোনো মূল্যে মাহবুবুর রহমানকে এমডি পদে বসাতে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল, দুর্নীতি ও অনিয়মকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়ে ‘চুরির সাম্রাজ্য’ গড়ে তোলা। এ নিয়ে তৎকালীন সময়ে বিভিন্ন হোটেলে তার বৈঠকও করেছেন। কিন্তু সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে এখন অন্য পথে নেমেছেন ‘আহসান সিন্ডিকেট’। নতুন এমডিকে অসহযোগিতা করতে নতুন চক্রান্ত নিয়ে মাঠে নেমে তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের কুৎসা রটাচ্ছেন এবং সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন।
দুর্নীতি আর অনিয়মমুক্ত যুগোপযোগী স্মার্ট ডিপিডিসি গড়ে তোলার ঘোষণা দেওয়ার পর থেকেই আহসান সরকারের মতো নির্বাহী প্রকৌশলীরা রয়েছেন আতঙ্কে। কারণ, আহসান সরকারের অতীত রেকর্ড ভালো নয়। যেখানে গিয়েছেন, ফিরেছেন দুর্নীতিবাজ তকমা নিয়ে। গত ছয় বছরের নিজের পছন্দের ছয়টি এলাকায় বদলি হয়েছেন তিনি। এর মধ্যে ভালো না লাগলে একমাসের মধ্যে পরিবর্তন করেন জায়গা। বর্তমানে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় কর্মরত ডিপিডিসির এই কর্মকর্তার চোখ পড়েছে রাজধানীর শ্যামপুরে বদলি হয়ে আসার। এজন্য ২০ লাখ টাকার আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। বিষয়টি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ডিপিডিসিতে। কারণ চার বছর আগে ২০২০ সালেও তিনি শ্যামপুরে ছিলেন। ওই সময়ে সেখানে তিনি ব্যাপক দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত বছরের ১ নভেম্বর রাজধানীর মানিকনগর থেকে বদলি হয়ে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় যান আহসান সরকার। তিন মাস না যেতেই শ্যামপুরে আসতে চান তিনি। এজন্য ২০ লাখ টাকা ঘুষ দিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। যদিও এক জায়গায় বদলি হওয়ার পর অন্তত তিন বছর আগে বদলি না হওয়ার কথা বলছেন প্রতিষ্ঠানটির এডমিন অ্যান্ড এইচ আর বিভাগের প্রধান সোনা মনি চাকমা।
তিনি রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘আর্থিক লেনদেনের বিষয়টি আমি জানি না। আর ডিপিডিসিতে নির্বাহী প্রকৌশলীদের তিন বছরের আগে বদলি হওয়ার সুযোগ নেই।’
তবে, এডমিন অ্যান্ড এইচআর প্রধানের এই তথ্যকে একাধিকবার বুড়ো আঙুল দেখিয়েছেন আহসান সরকার। তার বায়োডাটা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ডিপিডিসি হওয়ার আগে আহসান সরকার ২০০৮ সালের ১ জুলাই ডেসকোর তেজগাঁও জোনে সহকারী ম্যানেজার (টেকনিক্যাল) হিসেবে যোগ দিয়ে চাকরি জীবন শুরু করেন। এরপর ২০১১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর শ্যামপুরে বদলি হন। এরপর ২০১৪ সালের ৩ মার্চ নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে যোগ দেন শ্যামপুর জোনে। ২০১৬ সালে কোম্পানি সেক্রেটারিয়েট হিসেবে বদলি হয়ে পরের বছর নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে যোগ দেন ডিপিডিসির শ্যামলী এনওসিএস-এ। পরে ২০১৮ সালে জুনে শ্যামলী এনওসিএস-এতে যোগ দেওয়ার ১৪ দিনের মাথায় মুগদাপাড়া এনওসিএস-এতে বদলি হন তিনি। পরের বছর ২০১৯ সালের আগস্টে বনশ্রীতে, ২০২০ সালের নভেম্বরে শ্যামপুরে, ২০২২ সালের আগস্টে মানিকনগরে বদলি হন আহসান সরকার। সর্বশেষ নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় গত বছরের ১ নভেম্বর বদলি হয়ে আসেন তিনি। তিন মাস না যেতেই আবারো শ্যামপুরে বদলি হয়ে যেতে চান তিনি।
বারবার কেন এনওসিএস (কর্মরত এলাকা) পরিবর্তন করতে চান আহসান সরকার— এ নিয়ে ডিপিডিসির সংশ্লিষ্ট বিভিন্নজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শ্যামপুর ইন্ডাস্ট্রি এলাকা হওয়ায় এখানে অনিয়ম আর দুর্নীতির সুযোগ বেশি। ২০২০ সালে শ্যামপুরে থাকাকালীন ব্যাপক দুর্নীতি আর অনিয়মে ডিপিডিসিতে আলোচিত নাম ছিলেন এই আহসান সরকার। তার সময়ে নতুন বিদ্যুৎ সংযোগ নিতে টাকার আর্থিক লেনদেন ছাড়া কল্পনা-ই করা যেত না। মিটার টেম্পারিং, অবৈধ লাইন উৎসাহিত করে সেখান থেকে মাসিক টাকা নেওয়া, ট্রান্সফরমার দুর্নীতিতে একসময়ে সবচেয়ে সমালোচিত নাম এই আহসান। বারবার তার বিরুদ্ধে এসব অনিয়মের কারণে তদন্ত কমিটিও হয়েছে।
ডিপিডিসিতে আহসান সরকারের অনিয়ম, দুর্নীতি এবং চক্রান্ত নিয়ে জানতে চাইলে এসব বিষয় ‘ঠিক নয়’ বলে মন্তব্য করেন তিনি। আহসান সরকার বলেন, ‘এসব তথ্য ভিত্তিহীন।’
বদলিতে আর্থিক লেনদেন সম্পর্কে জানতে চাইলে ডিপিডিসি’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী আবদুল্লাহ নোমান রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘কিছুদিন হলো আমি নতুন দায়িত্ব নিয়েছি। বিষয়টি নিয়ে অবশ্যই খোঁজখবর নেওয়া হবে। কোনও ধরনের অনিয়ম সহ্য করা হবে না। ডিপিডিসি হবে অনিয়ম আর দুর্নীতিমুক্ত একটি স্মার্ট প্রতিষ্ঠান।’