অমর একুশে বইমেলা ২০২৪ এ পাঠক সমাবেশ প্রকাশ করেছে দ্রাবিড় সৈকতের গবেষণা গ্রন্থ ‘বঙ্গীয় শিল্পকলা: দেহতত্ত্বের দার্শনিক উত্তরাধিকার’।
বইয়ের ফ্ল্যাপে লেখা হয়েছে, শিল্পকলা নিয়ে আমাদের অজস্র প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। শিল্পের সংজ্ঞা, ষড়ঙ্গ, দর্শন, সৌন্দর্য, শিল্পের বিজ্ঞান, তাল, মান, প্রকৃতি, শিল্পী ও কারিগর, শিল্পীর যোগ্যতা, শিল্পী ও তাত্ত্বিকের ব্যাধি, নগ্নতা, অলংকার, দেহ, শরীর, নারী-পুরুষ, উত্তরাধিকার, পরম্পরা, রাজনীতি বিষয়ে কোনো সাধারণ ধারনা না নিয়েই আমরা নিজেদের রসিক-ভোক্তা-শিল্পী-তাত্ত্বিক-সমালোচক ইত্যাদি অভিধায় চিহ্নিত করছি। এমন প্রশ্নহীন মূক ও বধির অবস্থার সুযোগ যারা নেবার কথা তারা নিচ্ছে।
ছুরি মেরে ভুঁড়ি নামিয়ে দেয়ার দক্ষতা, কূটকৌশল ও প্রতারণায় জয়ী পক্ষকে বর্বর-হিংস্র-অসভ্য-ডাকাত-লুটেরা-লুম্পেন-পিশাচ-পাষণ্ড-অমানুষ না বলে তাদের সভ্যতা ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে শ্রেষ্ঠ মনে করার প্রায় অচিকিৎস্য হ্যালুসিনেশনে আমরা নিমজ্জিত। শিল্পকলা, শরীর এবং দেহতত্ত্ব এরা দর্শনগত দিক থেকে আদতে আলাদা নয়; আমরা আলাদা করে ভাবতে বাধ্য হচ্ছি, আমাদের প্রচলিত বিদ্যায়তনিক সংকীর্ণ পশ্চিমা জ্ঞানকাণ্ড এদের পৃথকভাবে, বিশেষায়িত ভঙ্গিতে দেখতে শিখিয়েছে তাই। বিশেষায়িত করার আধুনিক লোগোসেন্ট্রিজম একই সাথে বিচ্ছিন্নতারও উৎসভূমি। বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডকে দেহস্থিত করে আয়ত্ত করার রীতি বৃহৎবঙ্গের একটি স্বকীয় বৈশিষ্ট্য।
বাঙলা অঞ্চলে তত্ত্বের সাথে প্রয়োগের সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে; যেটি ইউরোপীয় জ্ঞানচর্চা থেকে স্বতন্ত্র। উপমহাদেশের সকল দর্শন-প্রস্থানই অন্তর্মুখীতার মধ্য দিয়ে বাইরের পৃথিবীকে অবলোকন করায় শরীর ও শিল্পকলা সম্পর্কিত ভাবনাগুলো এই অঞ্চলে স্বকীয়তায় ভাস্বর। অন্তর্মুখীতার অর্থ কোনোভাবেই আধ্যাত্মিকতা নয় বরং উল্টোটাই সঠিক অর্থাৎ বাস্তববাদিতা। বঙ্গীয়শিল্পের মূলধারায় মানবদেহ অঙ্কনের ভিত্তি ও মানদণ্ড হচ্ছে উত্তম নবতাল। এখানে শিল্পগুরুর নাম শুক্রাচার্য, যিনি আর্যসাহিত্যে অসুরদের দেবতা হিসেবে চিহ্নিত। নবতাল অর্থ হচ্ছে নয় তাল অর্থাৎ উত্তম বা আদর্শ দেহ নয় তাল। নয় তালে ১০৮ আঙুল। আদর্শ দেহের দৈর্ঘ্য ১০৮ আঙুল ধরে অপরাপর অঙ্গের আনুপাতিক আকার উল্লেখ করা হয়েছে শিল্পশাস্ত্রে। ভিঞ্চির হাজার বছর আগে এখানে বিস্তারিত মাপজোখের বর্ণনা ও ব্যবহার করা হয়েছে।
বঙ্গীয় শিল্পকলাকে উপলব্ধি করার প্রধান সূত্র নিহিত রয়েছে বাঙলার দেহাত্মবাদী মতাদর্শের অভ্যন্তরে। দেহকে বাদ দিয়ে, আত্মাকে বাদ দিয়ে, প্রকৃতি-পুরুষের দর্শন ও ভাণ্ড-ব্রহ্মাণ্ডের সংযোগের চেতনাকে বাদ দিয়ে এদেশের শিল্পকে বুঝতে যাওয়া পণ্ডশ্রমের বাইরে অন্য কিছু হবার পথ নেই। এ যাবৎকালে বিভিন্ন ঔপনিবেশিক প্ররোচনায় শিল্পকলাকে তার দর্শন বিচ্যুত করে দেখার চেষ্টা করা হয়েছে, যা আমাদের ভুল গন্তব্যে পৌঁছে দিয়েছে। বঙ্গীয় শিল্পের বিচার তাই আত্মাশূন্য বা প্রাণহীন জড়পদার্থে রূপায়িত হয়েছে। নিজের স্বরূপ সম্বন্ধে জ্ঞানলাভ করতে পারলেই মুক্ত হওয়া যায়। তাই সহরপাদ বললেন,-‘উজুরে উজু ছাড়ি মা লেহুরে বঙ্ক।/ নিঅড়ি বোহিমা জাহুরে লাঙ্ক॥/ হাথে রে কাঙ্কণ মা লেউ দাপণ।/ আপনে অপা বূঝ ত নিঅমণ॥’ (চর্যা-৩২)। আত্মজ্ঞানের শৈল্পিক রূপায়ণকে বঙ্গীয় ঘরানায় বলা হয়েছে শিল্পকলা। বঙ্গীয় শিল্পকলা তাই বঙ্গসন্তানদের প্রাণ থেকে উৎসারিত, বাস্তব পৃথিবীর প্রয়োজনের উদ্দীপনায় তার জীবনাদর্শের সাথে সম্পৃক্ত, সমাজাচরণের অংশ হয়ে বহুল প্রচারিত দেহতত্ত্বের দার্শনিক এবং নান্দনিক উত্তরাধিকার ও পরম্পরা।
মুদ্রিত মূল্য ৬৫০। পৃষ্ঠা সংখ্যা ২৮৮।