ফাতিমা জাহানের জন্ম ঢাকায়। বেড়ে ওঠা ভারতের ব্যাঙ্গালুরু শহরে। ১৮ বছর বয়সেই পৃথিবীর সৌন্দর্য দেখতে একা একা ঘুরে বেড়ান দেশ থেকে দেশান্তরে। প্রায় ৫০টি দেশে ভ্রমণ করেছেন। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের নারীদের জীবন-যাপন নিয়ে রয়েছে তার নিজস্ব মূল্যায়ন। ফাতিমা জাহানের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন স্বরলিপি
কয়টি দেশ ভ্রমণ করেছেন? সর্বশেষ কোন দেশ ভ্রমণ করলেন?
আমি আসলে মনের তৃষ্ণা মেটাবার জন্য ভ্রমণ করি। দেশ গুনে ভ্রমণ করি না, ভ্রমণ করি একটা নতুন দেশ জানার আগ্রহে। সেজন্য দেশ গোনার প্রতিযোগিতায় আমি কখনো যাইনি। তবে পঞ্চাশটির মতো দেশ তো ঝোলায় আছেই। সর্বশেষ আমি ভ্রমণ করেছি মরিশাস।
বিভিন্ন দেশে নারীর জীবন-যাপন কেমন দেখেছেন?
একেক দেশের নারীদের জীবন-যাপন, স্বাধীনতা, পেশা, মূল্যায়ন একেক রকমের। এটি একটি বিশাল পরিসরে আলোচনার বিষয়। তবে আমার মতে ভারত উপমহাদেশ ও মধ্যপ্রাচ্যের অল্প কিছু দেশ ছাড়া অন্যান্য দেশগুলোতে নারী স্বাধীনতা, অধিকার, জীবন-যাপন উদারভাবে উপভোগ করতে পারেন।
একটি দেশের পরিবেশ কীভাবে নারীবান্ধব হতে পারে?
নারীকে মানুষ বলে মনে করলে নারীর জন্য আলাদা কোনো দেশের প্রয়োজন নেই। আজকের দিনে পুরুষ যে অধিকার, স্বাধীনতা, ক্ষমতা, নিশ্চয়তা উপভোগ করেন নারীকেও যদি তা সমানভাবে দেওয়া হয় তাহলে আলাদা দেশের প্রশ্নই আসেনা।
নারী পর্যটককে অনেক সংকটের মুখে পড়তে হয়, কিন্তু নারী হিসেবে কি কোথায় বিশেষ সম্মান বা সুবিধা পাওয়া যায়?
এটা আমাদের ভুল ধারণা যে নারী পর্যটককে অনেক সংকটের মুখে পড়তে হয়। আমি ১৮ বছর বয়স থেকে একা ভ্রমণ করি। ভারতে পড়ালেখা করার সুবাদে আমাকে ঢাকা থেকে ব্যাঙ্গালুরুতে একা যাওয়া আসা করতে হয়েছে। বাইরের দেশে বাংলাদেশকে বলা হয় সবচেয়ে ‘অনিরাপদ’ দেশ কিন্তু আমার তেমন অসুবিধা হয়নি। যদিও ভ্রমণ একা করিনি; বাসে, ট্রেনে একা যাওয়া-আসা করা ছাড়া। একমাত্র বাংলাদেশ ছাড়া অন্য সব দেশে আমি একা ভ্রমণ করেছি। কোথাও কোনো সমস্যার সম্মুখীন হইনি। আর কত দেশে যে ভ্রমণের সময় কত ভালো ভালো অভিজ্ঞতা হয়েছে তা বলতে গেলে একটা বই লিখে ফেলা যাবে। তবে নারী হিসেবে বিশেষ সুবিধা অনেক জায়গায় পেয়েছি। তাঞ্জানিয়ায় মধ্যরাতে আমাকে ট্যাক্সি ঠিক করে দেয়া থেকে শুরু করে তুরস্কে রোজার মাসে অপরিচিত একজনের বাড়িতে ইফতার গ্রহণ, জর্ডানের এক সামান্য পরিচিত পরিবারের সাথে ঈদ উদযাপন, উজবেকিস্তানে উদ্যানে বেড়াতে গিয়ে একদল স্থানীয় মানুষের সঙ্গে চা পান করে আসা বা আমেরিকায় কোনো এক অপরিচিত মানুষ আমাকে রাস্তা বাতলে দিয়ে বলে ওঠা 'উই আর ফ্যামিলি'। কত কত মধুর অভিজ্ঞতা, কোনটা রেখে কোনটা বলি! তবে আমার মনে হয়, নারী হিসেবে সম্মানের চেয়ে আমি মানুষ হিসেবে সম্মান পেয়েছি সব জায়গায়। একজন নারীকে মানুষ হিসেবে গন্য করলে তাকে আলাদা সম্মান দেবার প্রয়োজন পড়ে না।
নারী দিসব পালনের রীতিকে কীভাবে মূল্যায়ন করেন?
বাংলাদেশের খুব কম নারীই নারী দিবসের পেছনের ইতিহাস জানেন। না জেনে, না বুঝে বেশিরভাগ নারী বেগুনি, গোলাপি রঙের পোশাক পরে পুরুষতন্ত্রের পতাকা উড়িয়ে নারী দিবস উদযাপন করেন। এই রীতি যদি বিশেষ রঙের কাপড় পরে, বিশেষ খাবার খেয়ে, নারী বিষয়ক অলীক ভাষণের মাধ্যমে পালন করা হয় তাহলে সে রীতিতে আমার আপত্তি আছে। নারী ২৪ ঘণ্টা ঘরে-বাইরে কাজের পাকে আটকে পড়া প্রাণী। নারী দিবসের আবির্ভাব হয়েছে বেতন বৃদ্ধি, ভোটাধিকার ইত্যাদি বিষয়ে সমান অধিকারের জন্য। বহু নারীর আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা আজ পড়াশোনা, কর্মক্ষেত্রে সামান্য অধিকার পাচ্ছি। তবে আমাদের উপমহাদেশের প্রেক্ষাপটে তা মোটেও সমান নয়। পৃথিবীর অন্যান্য অনেক দেশেও নারীরা আজও অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এর মধ্যে আমার মনে হয়, সবচেয়ে বড় বিভেদ সৃষ্টিকারী বিষয় হলো পিতার সম্পত্তিতে নারীর অংশ। নারী তার ভাইয়ের অর্ধেক অংশ পায়। তাই আমি মনে করি, নারী দিবস পালনকে উৎসব অনুষ্ঠানে পরিণত না করে প্রান্তিক থেকে শুরু করে উচ্চ পর্যায়ের নারীদের সম-অধিকার বিষয়ে আলোচনা, সমাধানের দিকে মনোযোগ দেয়া উচিত। এবং একদিনের জন্য উদযাপন না করে একজন নারীকে কীভাবে একজন মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া যায় সে ব্যবস্থার বাস্তবায়ন করা উচিত। প্রত্যন্ত অঞ্চলে বা সমাজের নিম্নবিত্ত নারীরা কিন্তু নারী দিবস সম্পর্কে অবগত নন। এবং এদের সংখ্যাই বেশি। দেশের অবহেলিত বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে সঙ্গে না নিয়ে, তাদের এ বিষয়ে অবহিত না করে নারী দিবস পালনের কোনো মানে আছে বলে আমি মনে করি না।