সাক্ষাৎকার

‘মেয়েরা প্রতিযোগিতা করেই নিজের অবস্থান করে নিচ্ছে’

শরীয়তপুর জেলার ভেদরগঞ্জ উপজেলার রামভদ্রপুর ইউনিয়ন। সেখানকার বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মোতালেব সরকার ও আলেয়া বেগম দম্পতির কন্যা মমতাজ বেগম। পাঁচ সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয় তিনি। শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ হেডকোয়ার্টার পাবলিক হাইস্কুল থেকে এসএসসি এবং এমএ রেজা ডিগ্রি কলেজ থেকে এইচএসসি সম্পন্ন করেন। এরপর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। স্নাতক-স্নাতকোত্তর শেষ করেন। ২৯তম বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়ে ঢাকায় কালেক্টরেট হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। ছিলেন নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার নির্বাহী অফিসার। দায়িত্ব পালন করেছেন স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব হিসেবে। বর্তমানে ঢাকার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইটি) হিসেবে কর্মরত মমতাজ বেগম।

মমতাজ বেগম সুখী-সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়ে এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও সমাজে সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পেশাগত জ্ঞান, দক্ষতা, সততা, উদ্ভাবন, ই-ফাইলিং, সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার, শুদ্ধাচার চর্চা বিষয়ক বিভিন্ন সূচকে সন্তোষজনক অর্জনের স্বীকৃতিস্বরূপ জেলা পর্যায়ে রাষ্ট্রীয় শুদ্ধাচার পুরস্কার পান এবং সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখায় তিনি জেলা ও ঢাকা বিভাগের শ্রেষ্ঠ ‘জয়িতা’ হিসেবে পুরষ্কার পান। ৮ মার্চ নারী দিবস উপলক্ষে কথা হয় তার সাথে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মামুন খান।

রাষ্ট্রের একটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় আপনি অধিষ্ঠিত হয়েছেন নিজ কর্মদক্ষতায়। এ পর্যন্ত আসার এই জার্নিটা একজন নারী হিসেবে কতটা মসৃণ ছিল? আর কতটা চ্যালেঞ্জিং ছিল? পরিবার থেকে কেমন সহযোগিতা পেয়েছেন? মমতাজ বেগম: আমরা চার বোন, এক ভাই। পরিবার থেকে সব সময় সহযোগিতায় পেয়েছি। পরিবার থেকে কখনো মেয়ে হিসেবে বড় হইনি, বড় হয়েছি সন্তান হিসেবে। তবে সমাজে কিছু সমস্যা থাকে, যেটা অন্যরাও বিষয়টি উপলব্ধি করে বা সমস্যার সম্মুখীন হয়। মেয়ে হিসেবে সেটি আমরাও করেছি।

নারীদের বিনিয়োগে আসার বিষয়ে আপনার অভিমত জানতে চাই- মমতাজ বেগম: আমি যেহেতু একটা সার্ভিসে আছি। বললেন সমতার কথা, নারী-পুরুষের সমঅধিকার নিয়ে আমাদের প্রধানমন্ত্রী কাজ করে যাচ্ছেন। সফলতার সাথে নারীদের এগিয়ে নেওয়ার জন্য তার যে প্রচেষ্টা সেটা কিন্তু আমাদের কাছে দৃশ্যমান। আমাদের স্পিকার, সংসদ উপনেতা নারী। হুইপ আছেন সেখানেও নারীদের অবস্থান। নারী সচিবও রয়েছেন। সম্প্রতি দেখেছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন প্রতিমন্ত্রী তিনিও নারী। আরও অনেক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী নারী রয়েছেন। এক্ষেত্রে আমরা নারীদের একটা উপস্থিতি দেখতে পাচ্ছি।

আর সমতার কথা কেন বলা হয় আপনারা জানেন, নারীদের সব সময় পিছিয়ে রাখার জন্য চেষ্টা করা হতো। অবশ্যই মেধার দিক থেকে তারা কখনোই কম ছিলো না। নেতৃত্বের দিক থেকেও নারীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় রেখেছেন। সেটা পরিবার থেকেই কিন্তু নেতৃত্বের গুণাবলী রাষ্ট্রের কর্মক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই। সার্ভিসে এসে আমারটুকুই আমি বলবো। আমাদের মেল (পুরুষ) যে অফিসার রয়েছে তারা যে কাজটি পারেন, আমরাও তাদের মতো করে অথবা কখনো কখনো আমরা ভাবি আমি মেয়ে বলে হয়তো কারো মধ্যে সংশয় থাকতে পারে এ কাজটি আমি করতে পারবো কি না। সেজন্য আমাদের চেষ্টাটা আরও বেশি থাকে। লক্ষ্য করবেন, আমরা যারা মহিলা কর্মকর্তা রয়েছি, নিজেরাই বলতে পারি সমাজও স্বীকৃতি দিবে যে আমাদের অবদান তাদের চেয়ে কোনো অংশে কম নই। আমাদের প্রচেষ্টাও তাদের চেয়েও অনেক বেশি থাকে। সেক্ষেত্রে কখনো কখনো তাদেরকেও আমরা ছাপিয়ে যাচ্ছি।

আপনারা স্বীকার করবেন কিনা জানি না। তবে আমরা সে পর্যায়ে কিন্তু এসেছি। আর বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আমরা যেহেতু ছেলেদের সাথে তাল মিলিয়ে কাজ করে যাচ্ছি অবশ্যই এখানে বিনিয়োগের একটা বিষয় রয়েছে, আমাদের অবদান এখানে। যেমন পরিবার থেকে একটি বিনিয়োগের সুযোগ আছে, কর্মক্ষেত্রেও আমরা সেই জিনিসটি ইতিমধ্যে প্রমাণ করেছি। আমরা ঘরও সামলাই, রাষ্ট্রকেও সহায়তা করি সরাসরি কাজের মাধ্যমে।

নারী দিবস আসলে নারীর ক্ষমতায়ন, পদায়ন- এ বিষয়গুলো চলে আসে। আপনার কাছে কী মনে হয়েছে রাষ্ট্র যোগ্যতা-সমঅধিকারের ক্ষেত্রে গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছে? মমতাজ বেগম: একটি বিষয় লক্ষ্য করলে দেখবেন, একটি মহল বেশ কিছুদিন আগে আন্দোলন করেছিল কোটাবিরোধী। সেখানে মহিলা কোটা থাকবে না এরকম বিষয়টিও আছে। সেটি কিন্তু এখন আর নেই। মেয়েরা প্রতিযোগিতা করেই তাদের অবস্থান করে নিচ্ছে। যেহেতু রাষ্ট্র সুযোগ দিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী সুযোগ দিয়েছেন যে উপজেলা নির্বাহী অফিসার মেয়ে হবে, এসিল্যান্ড মেয়ে হবে। বিসিএস ক্যাডারে মেয়েরা আসতে পারবে। পুলিশ, আর্মি অফিসার মেয়ে হবে। এমপি মেয়ে হবে। মন্ত্রীত্ব দিলেও মেয়েরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। স্পিকারও সুন্দরভাবে পার্লামেন্ট চালাতে পারেন। তো সেক্ষেত্রে কোটা কিন্তু তুলে দেওয়ার পরেও মেয়েদের অবস্থান প্রশংসনীয় এবং মহিলা কর্মকর্তা হিসেবে আমি বলবো, রাষ্ট্র তো অবশ্যই আমাদের সহযোগিতা করে। আমরা সমাজের কাছ থেকেও সহযোগিতা পাচ্ছি। পাশাপাশি পরিবার থেকেও কিন্তু আমরা বড় সহযোগিতা পাচ্ছি।

সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে রাষ্ট্র অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী সুযোগ করে দিয়েছেন। এটা আমাদের একটা ইন্সপায়রেশনের একটা জায়গা যে হ্যাঁ, আমি চেষ্টা করলে হয়তো বা ভালো জায়গায় যেতে পারবো। সেদিক থেকে আমরা বলতেই পারি, আমরা সমতা না এখন আমরা মানুষ হিসেবে সমাজে নিজেদের কর্মে মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছি। দেখবেন এখন বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাগুলোতে ফিমেল স্টুডেন্টরা কিন্তু এগিয়ে আছে। এখানেও সমতা না, আমি বলবো যাদের মধ্যে মেধা আছে তারা যদি চেষ্টা করে থাকে মানুষ হিসেবে তারাও অবশ্যই সমাজে স্বীকৃতি পাবে। আমরা সে অবস্থানে এখন চলে এসেছি।

প্রশাসনে সরকারি দপ্তরে কাজ করে যাচ্ছেন। নারীর কাজের জায়গাটা কতটা সহজ বলে মনে হয়? মমতাজ বেগম: নারীর কাজের ক্ষেত্রে এখন যে সরকারের ব্যবস্থাপনা রয়েছে, আমাদের অফিসের প্রত্যেকটা রুমে গেলেই দেখবেন সবার জন্য যেমন সুযোগ-সুবিধা রয়েছে আমার জন্যও একই সুযোগ সুবিধা রয়েছে। কর্মক্ষেত্রে তারাও (পুরুষরা) যে কাজগুলো করে থাকেন আমরাও সেই কাজগুলি করি। আমাদের কঠিন কঠিন কিছু বিষয় থাকে যেমন মোবাইল কোর্ট, সুরতহাল, গার্ড অব অনার দেওয়া বা চ্যালেঞ্জিং অনেক ক্ষেত্রে দাঙ্গা। এগুলোর ক্ষেত্রেও কিন্তু আমরা পিছিয়ে নেই। প্রত্যেকটা কাজেই আমাদের পুরুষ কর্মকর্তারা যেভাবে কাজ করে যাচ্ছে আমরাও সেভাবে কাজ করে যাচ্ছি।  কাজের ক্ষেত্রে ফিমেইল, মেইল হিসেবে এখন আর কেউ ট্রিট করে না। আমার জায়গা থেকে অন্তত এটা বলতে পারি।

কর্মক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা কী কী? মমতাজ বেগম: আমরা যারা মায়েরা কাজ করি ঘর থেকে বের হয়ে এসে কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমাদের সন্তানদের সেভাবে সময় দিতে পারি না। অনেক দিন ধরেই বলার চেষ্টা করছি, আমরা যারা মায়েরা আমাদের বাচ্চাদের সময় দিতে পারি না। অথবা শিক্ষার যে সময়টাকে বাচ্চাদের আমাদের বেশি প্রয়োজন তখন আমাদের কর্মক্ষেত্রে সময় দিতে হয়। রাষ্ট্রের কাছে আহ্বান, যারা নীতিনির্ধারণী জায়গায় আছেন, আমাদের প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করবো, উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে ডে কেয়ার সেন্টার রয়েছে।  উন্নত দেশগুলোর আদলে আমাদের দেশেও ডে কেয়ার সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা দরকার। আমাদের স্কুলগুলোতে এমন পরিবেশ আনা দরকার যেখানে বাচ্চারা সারাদিন থাকতে পারে। সেখান থেকেই তারা পাঠ্যক্রম শেষ করে তাদের সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়বে। ইদানীং ইলেকট্রনিক ডিভাইসের প্রতি বাচ্চাদের আসক্তি বেড়ে গেছে। ডিভাইস ছাড়া অন্য কিছুতে খেয়াল রাখে না। আমি নীতি-নির্ধারকদের কাছে অনুরোধ জানাই, যাতে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় কিছুটা পরিবর্তন এনে আমাদের স্কুলগুলোতে সুন্দর একটা পরিবেশ তৈরি করেন যেখানে আমাদের বাচ্চারা পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলাসহ অন্যান্য সামাজিক কার্যক্রমে অংশ নিতে পারে। তাদের বেড়ে ওঠার সুন্দর পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারলে আমরা আমাদের কর্মক্ষেত্রেও নিশ্চিন্তে কাজ করতে পারবো। এই জায়গাটাই আমার কাছে মনে হয় একটু চ্যালেঞ্জিং। কারণ আমার মা আমাকে যতটুকু সময় দিতে পেরেছেন আমি কিন্তু ততটুকু দিতে পারছি না।

কর্মপরিবেশ কতটা নারীবান্ধব? মমতাজ বেগম: দেশ স্বাধীনের পর থেকে রাষ্ট্র পরিচালনায় নারীদের অংশগ্রহণ ক্রমবর্ধমান। এখানে কাজের ক্ষেত্রে সুযোগের সমতা বিরাজমান। আমি মনে করি নারীদের জন্য কর্মপরিবেশ যথার্থ মানানসই। আগে যেখানে শুধু সরকারি চাকরিজীবী নারীরা দুই মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটি পেত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেটা ছয় মাস করেছেন। বেসরকারি চাকরিজীবী নারীদের জন্যও একই নীতিমালা রয়েছে। এটা কর্মজীবী মায়েদের সুবিধার জন্য একটা মাইলফলক। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে নিজেদের অবস্থান নিজেদের তৈরি করে নিতে হয়। কেউ কাউকে সুযোগ করে দিবে না। নিজের মেধা ও যোগ্যতা দিয়ে প্রমাণ করতে হবে আমরাও কোন অংশে কম নই। লক্ষ্য করলে দেখবেন কর্মক্ষেত্রে সততার জায়গায়, স্বচ্ছতার দিক থেকে নারীরা কিন্তু অনেক এগিয়ে।

নারীদের এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে আপনার ব্যক্তিগত অভিমত কী? মমতাজ বেগম: আমাদের কর্মের মাধ্যমেই যোগ্যতার প্রমাণ দিতে হবে। যেহেতু নারীদের জন্য আলাদা কোনো কোটা নেই। আমদেরকে আমাদের আচার আচরণ, মেধা কাজে লাগিয়েই অবস্থান করে নিতে হবে। জন্মলগ্ন থেকেই আমাদের অধিকার ও সুযোগের সমতা রয়েছে। রাষ্ট্র আমাদের অধিকার ও সুযোগ নিশ্চিত করেছে। সেই সুযোগটাক কাজে লাগাতে পারলেই সফলতা অর্জন করা সম্ভব। কাউকেই কেউ সুযোগ দিবে না। আমাদের পর্যাপ্ত সুযোগ রয়েছে। সেই সুযোগটুকু কাজে লাগিয়ে কর্মের মাধ্যমে নিজেদের যোগ্যতার প্রমাণ দিতে হবে।

এ প্রজন্মের মেয়েদের প্রতি আমার বক্তব্য হচ্ছে রাষ্ট্র যেহেতু সুযোগ দিচ্ছেই। নিজেদের একটা লক্ষ্য ঠিক করে মেধা ও মনন কাজে লাগিয়ে সেই লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে হবে। যার যার অবস্থান থেকে তার সম্মান বজায় রাখার জন্য নিজেকেই চেষ্টা করতে হবে। এবং আমি বলতে চাই, আমরা যেহেতু মেয়ে হয়ে জন্মেছি আমাদের কিছু কিছু বিষয়ে নিজের সম্পর্কে সচেতন হতে হবে যাতে আমরা বিপদে না পড়ি। এই বুদ্ধিমত্তা নিয়ে চললে আমি মনে করি কাউকে কোনো সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে না। নারীদের কাজ করার সুযোগ আছে। তবে সাহসী হতে হবে।