ভিক্ষুক-শ্রমিক থেকে ধনী শিল্পপতি সবাই এক কাতারে বসে করেন ইফতার। ভিক্ষুক এবং শিল্পপতির থালাতে থাকে একই ইফতার। এখানে ধনী গরিবের কোনো পার্থক্য নেই। প্রতিদিন একই সঙ্গে বসে ইফতার করেন তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার মানুষ। এই অভূতপূর্ব দৃশ্য চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদের। এই মসজিদে প্রতিদিন ইফতারে ব্যয় হয় ২ থেকে ৩ লাখ টাকা। কিন্তু, এই বিপুল পরিমাণ অর্থের যোগান কে বা কারা দেন তা জানেন না কেউ। আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদে গোপন দানেই হাজার হাজার মানুষের ইফতার আয়োজন চলছে ২০০১ সাল থেকে প্রতিদিন।
চট্টগ্রাম মহানগরীর প্রাণকেন্দ্র আন্দরকিল্লা এলাকাতেই অবস্থিত আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ। এই মসজিদটি প্রতিষ্ঠিত হয় মোগল আমলে। মসজিদটি মোগল বিজয়ের স্মারক হিসেবেই নির্মিত হয়েছে বলে ইতিহাসে বর্ণিত আছে। কালের পরিক্রমায় বর্তমানে আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদের খতিবের দায়িত্ব পালন করছেন মাওলানা ছাইয়্যেদ মুহাম্মদ আনোয়ার হোসেন তাহের জাবেরী আল মাদানী। ১৯৯৬ সাল থেকে দায়িত্ব পালনকারী এই খতিবের উদ্যোগেই ২০০১ সাল থেকে মসজিদে গণ ইফতারের আয়োজন হয়ে আসছে। প্রথম দিকে ২০০/৫০০ জনের ইফতারের আয়োজন হলেও বর্তমানে প্রতিদিনের ইফতারের আয়োজন দাঁড়িয়েছে ২ থেকে ৩ হাজার মানুষের। কখনো কখনো তা ৪ থেকে ৫ হাজারও ছাড়িয়ে যায়।
খতিব মাওলানা ছাইয়্যেদ মুহাম্মদ আনোয়ার হোসেন তাহের জাবেরী আল মাদানী বলেন, সম্পূর্ণ গোপন অনুদানেই এখানে হাজার হাজার মানুষের ইফতারের আয়োজন করা হয়।
তিনি আরও বলেন, এই রমজানের প্রথমদিকে এখানে দিনে এক থেকে দেড় হাজার মানুষের সমাগম হলেও গত কয়েকদিনে এখানে তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার মানুষ এক সঙ্গে বসে ইফতার করছেন। প্রতিদিনের ইফতারে যত লাখ টাকা ব্যয় হয় সবই দেন গোপন দানকারীরা। তারা কেউ তাদের নিজেদের নাম পরিচয় প্রকাশে আগ্রহী নয়। প্রতিদিন লাখ লাখ টাকার ইফতারি তারা দুপুরের পর থেকেই মসজিদে পৌঁছে দেন। কেউ দেন ছোলা-পেঁয়াজু, কেউ দেন খেজুর, মুড়ি, কেউ করেন হাজার হাজার মানুষের শরবতের আয়োজন। এখানে ইফতারে কোনো ভেদাভেদ নেই। এখানে যিনি লাখ লাখ টাকা অনুদান দিয়ে ইফতারে সহায়তা করেন তিনিও ভিক্ষুক, দিনমজুর, শ্রমিক সবার সঙ্গে বসে ইফতার করেন। কিন্তু, কেউ জানে না কার টাকায় এতো বড় ইফতারের আয়োজন হচ্ছে।
স্বেচ্ছাশ্রমে ইফতার আয়োজনের সঙ্গে সম্পৃক্ত আবদুর রহমান নামের একজন বলেন, আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদে ইফতারের সময় এক অভূতপূর্ব দৃশ্য সৃষ্টি হয় প্রতিদিন। ধনী-গরিব সব শ্রেণি পেশার মানুষ এক সঙ্গে বসে এখানে ইফতার করেন। সওয়াবের উসিলায় দূর দূরান্ত থেকেও স্বচ্ছল মানুষরাও এখানে দল বেঁধে ইফতার করতে আসেন। যত মানুষই আসুন এখান থেকে কেউ কখনো না খেয়ে ফিরে যান না। সবার জন্যই থাকে ইফতার। কোনো প্লেটে একজন, কোন প্লেটে ১০/১২ জন বসে ইফতার করেন। ইফতারের মেনুতে থাকে ছোলা, পেঁয়াজু, মুড়ি, বেগুনি, খেজুর, শরবতসহ আরও বিভিন্ন ধরনের খাবার।
তিনি আরও বলেন, প্রতিদিন দুপুরের পর থেকেই রোজাদারদের জন্য ট্রাকে ট্রাকে ইফতার সামগ্রী আসতে থাকে মসজিদে। এরপর প্লেটে সাজিয়ে পরিবেশনের জন্য তৈরি করেন স্বেচ্ছাসেবকরা। ইফতারের রান্না থেকে সব আয়োজন করে যারা পরিবেশন করেন কেউ তাদের পারিশ্রমিক নেন না। সবাই কাজ করেন স্বেচ্ছাশ্রমে।
চট্টগ্রামের চান্দগাঁও থেকে আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদে নিয়মিত ইফতার করতে আসা মোহাম্মদ সালাউদ্দিন বলেন, আমরা মোটামুটি স্বচ্ছল পরিবারের। কিন্তু, হাজারো মানুষের সঙ্গে ইফতার করতে প্রতিদিন এই মসজিদে চলে আসি। এখানে ইফতারে যে আনন্দ, তা আর কোথাও খুঁজে পাই না। এখানে ধনী-গরিবের কোনো ভেদাভেদ নেই। এখানে আল্লাহর রহমত আছে। এখানে ইফতারে একটা অন্যরকম ভালো লাগা আছে। এই সওয়াব থেকে বঞ্চিত থাকতে চাই না।