মাহে রমজান রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস। আল্লাহ জাল্লা শানুহু এ মাসে আমাদের ক্ষমা করার জন্য, আমাদের মর্যাদা বৃদ্ধি করার জন্য বিভিন্ন আমল দিয়েছেন। ক্ষমাপ্রাপ্তির জন্য রেখেছেন অবারিত, অফুরন্ত সুযোগ। এই সুযোগগুলোর মধ্যে অন্যতম সুযোগ হলো রমজানের শেষ দশকের এতেকাফ। এতেকাফ যেন আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার জন্য একটি শেষ সুযোগ, যাতে সে রমজানের সমস্ত ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারে।
এতেকাফ আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার জন্য সরকারি দাওয়াত, যেন বান্দা ১০ দিন তার বাড়িতে সরকারি মেহমানরূপে থেকে বেড়িয়ে যায়। আল্লামা ইবনুল কাইয়ুম রহমাতুল্লাহ আলাইহি বলেন, এতেকাফের উদ্দেশ্য হচ্ছে গাইরুল্লাহর সমস্ত বেড়াজাল থেকে মুক্ত হয়ে আল্লাহর সঙ্গে গভীর প্রেমময় সম্পর্ক স্থাপন করা। এতেকাফের মাধ্যমে হৃদয় ও মন এমন এক পবিত্রতা লাভ করে যে, সেখানে আল্লাহর প্রেম ও ভালোবাসা ছাড়া অন্য কিছুই স্থান পায় না। এতেকাফের নিঃসঙ্গতা ও নির্জনতা মানুষকে পরকালীন একাকীত্বকে স্মরণ করিয়ে দেয়। স্মরণ করিয়ে দেয় কবরের নিঃসঙ্গতা ও নির্জনতা।
রমজানের শেষ দশকের সর্বোত্তম আমল হলো এতেকাফ। এতেকাফের ফজিলত ও মর্যাদার জন্য তো এটাই যথেষ্ট যে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতি রমজানের শেষ দশক খুব গুরুত্বের সঙ্গে এতেকাফ করেছেন, ইন্তেকাল-পূর্ব বছর রমজানে ২০ দিন এতেকাফ করেছেন। তার ওফাতের পর নবীপত্নীগণ এতেকাফ করেছেন । বোখারি, হাদিস নং ২০২৬।
এতেকাফের ফজিলত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত হয়েছে, যদি কেউ তার ভাইয়ের প্রয়োজন মেটাতে হাঁটে তবে তা তার জন্য দশ বছর এতেকাফ করার চেয়েও উত্তম। আর যে ব্যক্তি একদিন আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে এতেকাফ করবে আল্লাহ তার ও জাহান্নামের মধ্যে তিনটি পরিখার দূরত্ব সৃষ্টি করবেন। প্রত্যেক পরিখার প্রশস্ততা দুই দিগন্তের চেয়েও বেশি। মুসতাদরকে হাকিম ৪/৩০০।
অপর এক হাদীসে নবীজি বলেছেন, যে ব্যক্তি এতেকাফ করে সে তো আসলে গুনাহ থেকে দূরে থাকে। আর তার জন্য সমস্ত নেক আমলকারীর সমান নেকি জারি করা হয়। ইবনে মাজাহ, হাদিস নং ১৭৮১।
এতেকাফ দামি হওয়ার পিছনে আরেকটি কারণ হলো, রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোর মধ্যে এমন একটি রাত রয়েছে, যার এবাদত হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। কোরআনে কারীম যে রাতকে লাইলাতুল কদর নামে অবহিত করেছেন। হযরত আবু হুরায়রা রাঃ বলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি ঈমান ও সাওয়াব অর্জনের আশায় লাইলাতুল কদরে কিয়াম করবে (তথা সালাত আদায় করবে ) তার পিছনের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে। বুখারি হাদিস নং ১৯০১।
এতেকাফ তিন প্রকার ১. ওয়াজিব এতেকাফ ২.সুন্নাতে মুয়াক্কাদায়ে কিফায়া এতেকাফ ৩. মুস্তাহাব বা নফল এতেকাফ
ওয়াজিব এতেকাফ হলো মান্নতের এতেকাফ। কেউ মান্নত করল আমার অমুক কাজটা সমাধান হয়ে গেলে দশ দিন বা বিশ দিন এতেকাফ করব। উক্ত কাজটি সম্পূর্ণ হয়ে গেলে তাকে ওই নির্দিষ্ট দিনগুলোতে রোজা রেখে অবশ্যই এতেকাফ করতে হবে।
সুন্নাতে মুয়াক্কাদায়ে কিফায়া রমজানের শেষ দশকের এতেকাফ। অর্থাৎ ২০ রমজানের সূর্য ডোবার আগে মসজিদে প্রবেশ করে শাওয়াল মাসের চাঁদ দেখা পর্যন্ত এতেকাফ করা। কোন মহল্লা বা গ্রামবাসীর পক্ষে এক বা একাধিক ব্যক্তি এতেকাফ করলে সকলের পক্ষ থেকে আদায় হয়ে যাবে। যদি কেউ তা আদায় না করে তাহলে পুরা মহল্লাবাসী সুন্নতে মুয়াক্কাদা পরিত্যাগ করার গুনাহে গুনাহগার হবে।
মুস্তাহাব বা নফল এতেকাফের জন্য কোন দিন বা সময়ের পরিমাপ নেই এবং রোজাও শর্ত নয় । যে কোনো সময় যে কোনো পরিমাণে করা যায়। আজ খুব আফসোস হচ্ছে মুসলিম জনপদগুলোর অবস্থা এমন হয়েছে যে, আল্লাহর ঘরের দাওয়াত কবুল করার মানুষ এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না। ভাড়া করে একজন দুজনকে দিয়ে এতেকাফ করিয়ে মহল্লাবাসীর বোঝা তাদের কাঁধে চাপিয়ে দেওয়া হয়। কোথায় মুসলিম যুবকেরা? কোথায় তোমরা হে নবীন, হে নওজোয়ান? তাকিয়ে দেখো আল্লাহর ঘর তোমায় হাতছানি দিয়ে ডাকছে।
রমজানের শেষ দশকে আল্লাহর ক্ষমাপ্রাপ্তির আশায় তার ঘরে বিছানা ফেলানোর চেয়ে আর উত্তম আমল কি বা হতে পারে? আল্লাহ আমাদের সকলকে এতেকাফ করার তৌফিক দান করুন।
লেখক : খতিব ও ইসলামী আলোচক