উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে যে চিন্তায় প্রার্থী দিচ্ছে আওয়ামী লীগ প্রতীক ছাড়া, সেই কৌশলে নিজেদের মধ্যে বিভেদ বেড়ে নেতাকর্মীরাও হতে পারেন ঐক্যহারা। ভোটের আগেই পাল্লা দিয়ে যেভাবে বাড়ছে সংঘাত, আরও কয়েকদিন পর সেটা সামাল দিতে কেন্দ্রীয় নেতারা হতে পারেন কুপোকাত।
তবে শেষ পর্যন্ত সংঘাত এড়িয়ে নেতাদের প্রত্যাশা, নির্বাচনে হবে অংশগ্রহণমূলক। তাই প্রতীক ছাড়াই নির্বাচন করে প্রমাণ করতে চান, সিদ্ধান্তটি সঠিক। এজন্য শিগগিরই কেন্দ্রীয় বার্তা যাচ্ছে তৃণমূলে। সেখানে কঠোর বার্তা থাকছে। যার যার মতো করে নির্বাচন করার বার্তাসহ সংঘাতে লিপ্ত হলে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি থাকছে।
যেমনটি বলেছেন দলের সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল। তিনি রাইজিংবিডিকে বলেন, জনপ্রিয় নেতারা যাতে জনমতে ভোটের জিতে আসেন, সেই ভাবনা থেকেই আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা প্রতীক ছাড়া নির্বাচনের কথা বলছেন। একে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক ভোট হবে বলে আমরা প্রত্যাশা করছি।
‘কিন্তু নির্দেশনা না মেনে কেউ যদি ব্যক্তি স্বার্থে সংঘর্ষ, সংঘাতে জড়িয়ে পড়েন সেটি কঠোরভাবে দমন করা হবে। অবশ্যই শাস্তিমূলক সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
এবার উপজেলা নির্বাচন হবে চার ধাপে। প্রথম ধাপে ১৫২টি উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এসব উপজেলায় ভোটগ্রহণ হবে আগামী ৮ মে। দ্বিতীয় ধাপের ভোটগ্রহণ হবে ২৩ মে। তৃতীয় ধাপের ভোটগ্রহণ হবে ২৯ মে এবং চতুর্থ ধাপের ভোট হবে ৫ জুন।
দেশে উপজেলার সংখ্যা ৪৯২। সর্বশেষ ২০১৯ সালে পাঁচ ধাপে দলীয় প্রতীকে ৪৭৩ উপজেলা পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বিএনপি ওই নির্বাচন বর্জন করে। ভোটার উপস্থিতি ছিল ৪০ দশমিক ২২ শতাংশ।
২০১৯ সালে সর্বশেষ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ৪৭৩টি উপজেলার মধ্যে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা নৌকা প্রতীকে ৩২০টিতে চেয়ারম্যান পদে জয়ী হন। এর মধ্যে ১১৫ জন নির্বাচিত হন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে চেয়ারম্যান হন ১৩৬ জন, এর বেশির ভাগই আওয়ামী লীগের নেতা ও সমর্থক। বিএনপিরও অনেকে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র বলছে, প্রতীক উঠিয়ে দিয়ে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে বেশ কয়েকটি সফলতা পেতে চাইছে আওয়ামী লীগ। এর মাধ্যমে তৃণমূলে একটি উৎসবমুখর ভোট হবে। অনেক প্রার্থী হওয়ায় নির্বাচন তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হবে। যারা জনপ্রিয় তারাই জিতে আসবে। এছাড়া বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাকর্মীরা নির্বাচনের উৎসবে শামিল হবে। এক্ষেত্রে কেন্দ্রের নির্দেশনা না মেনেই অনেকেই নেমে পড়বে নির্বাচনী লড়াইয়ে। বেশ কয়েকটি পৌরসভা নির্বাচনে বিএনপি নেতারা নির্বাচনের মাঠে ছিলেন। কয়েকটিতে জয়ীও হয়েছেন। তবে আওয়ামী লীগের জন্য চ্যালেঞ্জ হবে নির্বাচনকে সংঘাতমুক্ত রাখা। কারণ এরই মধ্যে নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে অভ্যন্তরীণ সংঘাতের খবর আসছে গণমাধ্যমে।
সম্প্রতি আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ‘প্রার্থীতা উন্মুক্ত’ করে দেওয়ার ঘোষণা দেন আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই নির্বাচনে অংশ নিয়ে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাদের নিজ নিজ যোগ্যতা প্রমাণের আহ্বান জানান তিনি। তবে ওই নির্বাচনে যেন কোনো সংঘাত না হয় সে বিষয়েও সবাইকে সতর্ক করেছেন দলীয়প্রধান।
উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের যেসব নেতারা প্রার্থী হতে চান তাদের উদ্দেশ্যে শেখ হাসিনা বলেন, ‘১৫ বছর ক্ষমতায় থেকে সাধারণ মানুষের জন্য কতটুকু কাজ করেছেন, কারা করতে পারেননি, সেটাও যাচাই-বাছাই হয়ে যাবে। জনগণের কাছে কার গ্রহণযোগ্যতা, সেটাই দেখব।’
তিনি আরও বলেন, ‘কোনো রকম সংঘাত চাই না। যিনি এর সঙ্গে জড়িত থাকবেন, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতীক ছাড়া নির্বাচনে তৃণমূলে দ্বন্দ্ব আরও প্রকট হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। সংসদ নির্বাচনে যে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে, তা আরও বিস্তৃত হওয়ার আশঙ্কা আছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মাঝে যে বৈরিতা তৈরি হয়েছিলো, তা আরও প্রকট আকার ধারণ করতে পারে। বিশেষ করে যে আসনগুলোতে স্বতন্ত্র প্রার্থী জয়ী হয়েছেন সেসব আসনে পরিস্থিতি চরম আকার ধারণ করতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
যদিও দলের দায়িত্বশীল নেতারা মনে করেন, শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ বা সংঘর্ষ-সংঘাত থাকবে না। এ নিয়ে ঈদের পর বসতে পারে দলের দায়িত্বশীল নেতারা। সংঘাত নিয়ন্ত্রণে রাখতে বিশেষ কমিটি করে দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়ার বিষয়টিও ভাবনায় রয়েছে বলে জানান তারা।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট কামরুল হাসান রাইজিংবিডিকে বলেন, দলের সভাপতি বিচার-বিশ্লেষণ ও চিন্তা-ভাবনা করেই জানিয়েছেন উপজেলায় প্রার্থী থাকবে না। কোথাও কোথাও এই ধরনের সংঘাতের ঘটনা ঘটছে, এটা ঠিক। কিন্তু তারপরও জনগণকে ভোটের মাঠে আনার জন্য একটি গ্রহণযোগ্য, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করার জন্য দলীয় প্রতীক ছাড়া নির্বাচন আয়োজন মন্দ না। তবে পরিস্থিতি যাতে নিয়ন্ত্রণের বাইরে না যায়, সেজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।