কার্যকরভাবে করারোপের মাধ্যমে তামাকপণ্যের দাম বাড়ালে রাজস্ব আয় বাড়বে, তামাকের ব্যবহার এবং তামাকজনিত রোগে সরকারের চিকিৎসা ব্যয় কমবে। আসন্ন ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে তামাকপণ্যের দাম বাড়িয়ে বিশেষ করে নিম্নস্তরের সিগারেটের করহার ও দাম বাড়িয়ে তরুণ ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ক্রয় ক্ষমতার বাইরে নিয়ে যেতে হবে।
সোমবার (১ এপ্রিল) রাজধানীর বিএমএ ভবনে অনুষ্ঠিত ‘তামাক কর ও মূল্য পদক্ষেপ: বাজেট ২০২৪-২৫’ শীর্ষক সাংবাদিক কর্মশালায় এসব আলোচনা উঠে আসে। গবেষণা ও অ্যাডভোকেসি প্রতিষ্ঠান প্রজ্ঞা (প্রগতির জন্য জ্ঞান) এবং অ্যান্টি টোব্যাকো মিডিয়া অ্যালায়েন্স (আত্মা) যৌথভাবে কর্মশালাটি আয়োজন করে। কর্মশালায় প্রিন্ট, টেলিভিশন এবং অনলাইন মিডিয়ায় কর্মরত ২৭ জন সাংবাদিক অংশগ্রহণ করেন।
কর্মশালায় জানানো হয়, বাংলাদেশে সব ধরনের তামাক পণ্য অত্যন্ত সস্তা এবং নিত্যপণ্যের তুলনায় এগুলো আরও সস্তা হয়ে পড়ছে। কৃষি বিপণন অধিদপ্তর থেকে প্রাপ্ত ৭টি মহানগরীর (ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, সিলেট, বরিশাল এবং রংপুর) নিত্যপণ্যের গড় খুচরা মূল্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০২১ সালের (৪ জুলাই) তুলনায় ২০২৩ সালে (৪ জুলাই) খোলা চিনির দাম বেড়েছে ৮৯ শতাংশ, আলু ৮৭ শতাংশ, খোলা আটা ৭৫ শতাংশ, পাঙ্গাস মাছ ৪৭ শতাংশ, ডিম ৪৩ শতাংশ, সয়াবিন তেল ৩৪ শতাংশ, গুঁড়ো দুধ ৩০ শতাংশ, এবং ব্রয়লার মুরগির দাম বেড়েছে ২৭ শতাংশ। অথচ একইসময়ে বিভিন্ন স্তরের সিগারেটের দাম বেড়েছে মাত্র ৬ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত।
কর্মশালায় আরও জানানো হয়, অন্যান্য স্তরের তুলনায় নিম্ন স্তরে সিগারেটের খুচরা মূল্য ও সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধি তুলনামূলকভাবে স্বল্প আয়ের তামাক ব্যবহারকারীকে ধূমপান ছাড়তে উৎসাহিত করবে। বর্তমানে সিগারেট ব্যবহারকারীদের প্রায় ৭৫ শতাংশই কমদামি সিগারেটের ভোক্তা এবং এই স্তরে সম্পূরক শুল্কহার মাত্র ৫৮ শতাংশ।
আসন্ন বাজেটে তামাকপণ্যের কর ও মূল্যবৃদ্ধি সংক্রান্ত যেসব প্রস্তাব কর্মশালায় তুলে ধরা হয় সেগুলো হচ্ছে, নিম্ন স্তরে প্রতি ১০ শলাকা সিগারেটের খুচরা মূল্য ৪৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৬০ টাকা নির্ধারণ করে ৬৩ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা। মধ্যম স্তরে ১০ শলাকা সিগারেটের খুচরা মূল্য ৬৭ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৮০ টাকা, উচ্চ স্তরে ১০ শলাকা সিগারেটের খুচরা মূল্য ১১৩ টাকা থেকে ১৩০ টাকা এবং প্রিমিয়াম স্তরে প্রতি ১০ শলাকা সিগারেটের খুচরা মূল্য ১৫০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৭০ টাকা নির্ধারণ করা। এই তিনটি স্তরে সম্পূরক শুল্ক ৬৫ শতাংশ বহাল রাখা।
ফিল্টারবিহীন ২৫ শলাকা বিড়ির খুচরা মূল্য ২৫ টাকা এবং ফিল্টারযুক্ত ২০ শলাকা বিড়ির খুচরা মূল্য ২০ টাকা নির্ধারণ করে ৪৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা। প্রতি ১০ গ্রাম জর্দার খুচরা মূল্য ৫৫ টাকা এবং ১০ গ্রাম গুলের খুচরা মূল্য ৩০ টাকা নির্ধারণ করে ৬০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা। এছাড়া সব তামাকপণ্যের খুচরা মূল্যের ওপর ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) এবং ১ শতাংশ স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ বহাল রাখা।
কর্মশালায় জানানো হয়, তামাকবিরোধীদের কর ও মূল্য প্রস্তাব বাস্তবায়ন করা হলে ১০ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত রাজস্ব আয় অর্জিত হবে। এই বর্ধিত রাজস্ব চলমান আর্থিক সংকট মোকাবেলায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। একইসাথে দীর্ঘমেয়াদে প্রায় পাঁচ লাখ তরুণসহ মোট এগার লাখের অধিক মানুষের অকাল মৃত্যু রোধ করা সম্ভব হবে।
কর্মশালায় সাংবাদিকদের সামনে মূল উপস্থাপনা তুলে ধরেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বাংলাদেশের ন্যাশনাল প্রফেশনাল অফিসার (এনসিডি) ডা. সৈয়দ মাহফুজুল হক এবং প্রজ্ঞা’র তামাক নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক প্রকল্প প্রধান হাসান শাহরিয়ার। আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ক্যাম্পেইন ফর টোব্যাকো ফ্রি কিডস (সিটিএফকে) এর প্রোগ্রামস ম্যানেজার (বাংলাদেশ) মো. আব্দুস সালাম, অ্যান্টি টোব্যাকো মিডিয়া অ্যালায়েন্স- আত্মা’র কনভেনর লিটন হায়দার, কো-কনভেনর মিজান চৌধুরী এবং প্রজ্ঞা’র নির্বাহী পরিচালক এবিএম জুবায়ের।
উল্লেখ্য, তামাক ব্যবহারজনিত রোগে প্রতি বছর ১ লাখ ৬১ হাজারের অধিক মানুষ মৃত্যুবরণ করেন। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তামাক ব্যবহারের অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা, যা একই সময়ে তামাক খাত থেকে অর্জিত রাজস্ব আয়ের (২২ হাজার ৮১০ কোটি টাকা) চেয়ে অনেক বেশি। তামাকের দাম বেশি হলে তরুণ জনগোষ্ঠী তামাক ব্যবহার শুরু করতে নিরুৎসাহিত হয় এবং বর্তমান ব্যবহারকারী বিশেষ করে দরিদ্র জনগোষ্ঠী তামাক ছাড়তে উৎসাহিত হয়।