জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী ও দলীয় প্রার্থীদের মধ্যে গড়ে ওঠা বিভেদ আসছে উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হয়েছে আওয়ামী লীগে। দলটির তৃণমূলে এমপি-মন্ত্রীদের প্রভাব যেমন বেড়েছে, তেমনি অদৃশ্য হাতের ইশারায় চলছে প্রতিদ্বন্দ্বি প্রার্থীকে নানাভাবে বসিয়ে দেওয়ার হুমকি-ধমকি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মানা হচ্ছে না কেন্দ্রের কঠোর বার্তাও। ঈদের পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণহীণ হতে পারে বিষয়টি অনুধাবন করে তৃণমূলের নেতাদের ডাকা হচ্ছে ঢাকায়। তবুও বিভেদ নিয়ন্ত্রণে গলদঘর্ম অবস্থা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রের।
এবার দেশের ৪৮১টি উপজেলা পরিষদে ভোট হবে চারটি ধাপে। প্রথম ধাপের ভোট হবে ৮ মে। ইতোমধ্যে প্রথম ধাপে ১৫২টি উপজেলা পরিষদে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে। মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া যাবে ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত। প্রচার শুরু হবে ২৩ এপ্রিল থেকে। চলতি সপ্তাহে দ্বিতীয় ধাপের তফসিল ঘোষণা করবে নির্বাচন কমিশন।
উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের তৃণমূলে অভ্যন্তরীণ রাজনীতির বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রায় সব জায়গায় নিজেদের প্রার্থীকে একক প্রার্থী হিসেবে নিশ্চিত করতে চাইছেন প্রভাবশালী স্থানীয় নেতারা। এক্ষেত্রে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ছেন মন্ত্রী-এমপি-স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য-আওয়ামী লীগের স্থানীয় দায়িত্বশীল নেতারা। এসব নিয়ন্ত্রণে যাদের দায়িত্ব অর্থাৎ কেন্দ্রীয় নেতাদের; এলাকায় প্রভাব রাখতে অনেক জায়গায় তারাও জড়িয়ে যাচ্ছেন বিভেদের রাজনীতিতে। ফলে বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে, এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রভাব বিস্তারেরর ক্ষেত্রে মন্ত্রী-এমপিদের সতর্ক করে দিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, কারোরই কোনো হস্তক্ষেপ মেনে নেওয়া হবে না।
তিনি বলেন, নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও পক্ষপাতহীন করতে চায় সরকার। নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে এমপি মন্ত্রী কারোরই হস্তক্ষেপ মেনে নেওয়া হবে না। আমি এমপি-মন্ত্রী আমার কেউ আছে তাকে জেতানোর জন্য নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করব- এটা কেউ করতে পারবে না।
নির্বাচনে কোন প্রকার হস্তক্ষেপ, প্রশাসনিকভাবে ক্ষমতায় আছে বলে করবে এটা কোন অবস্থায় এলাও করা হবে না। যে উদ্দেশ্যে নির্বাচন উন্মুক্ত করা হয়েছে সেই উদ্দেশ্য ব্যাহত করা যাবে না। উপজেলা নির্বাচনকে সম্পূর্ণভাবে অবাধ, সুষ্ঠু এবং পক্ষপাতহীন করতে চাই।
দায়িত্বশীলদের বক্তব্য নিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাফ জানিয়ে দেন, ফ্রি স্টাইলে দল চলবে না। তিনি বলেন, যার যেমন খুশি যখন-তখন দায়িত্বজ্ঞানহীন বক্তব্য রাখবেন সেটার দায় দল বহন করবে না। একজনের একটা বক্তব্য গোটা দলের শৃঙ্খলার উপর আঘাত হানে- এমন কিছু হলে অবশ্যই ব্যবস্থা নিতে হবে।
স্থানীয় নেতাকর্মীদের তথ্যানুযায়ী, রংপুরের বদরগঞ্জে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য আবুল কালাম মো. আহসানুল হক চৌধুরী বর্তমান চেয়ারম্যান ফজলে রাব্বীকে (সুইট) দলীয় প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন। কক্সবাজার সদরে মাহমুদুল করিমকে সমর্থন জানিয়েছেন হুইপ সাইমুম সরওয়ার কমল। তেঁতুলিয়া উপজেলার এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেওয়ার সময় পঞ্চগড়-১ আসনের সংসদ সদস্য নাঈমুজ্জামান ভূঁইয়া তেঁতুলিয়া উপজেলার চেয়ারম্যান প্রার্থী হিসেবে কেন্দ্রীয় কৃষক লীগের সহসভাপতি আবদুল লতিফকে সমর্থন দেন। স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরাও পিছিয়ে নেই। ময়মনসিংহ ১ এর সংসদ সদস্য মাহমুদুল হক ধোবাউড়া উপজেলায় যুবলীগ নেতা আসাদুজ্জামানকে প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা দেন। মঠবাড়িয়া উপজেলায় সংসদ সদস্য শামীম শাহনেওয়াজ তার ভাই রিয়াজ উদ্দিন আহমেদকে চেয়ারম্যান প্রার্থী ঘোষণা দিয়েছেন। সাভার উপজেলার বর্তমান চেয়ারম্যান মঞ্জুরুল আলমকে সমর্থন দিয়েছেন ঢাকা-১৯ (সাভার-আশুলিয়া) আসনের সংসদ সদস্য মুহাম্মদ সাইফুল ইসলাম।
পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলা পরিষদে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. মহিববুর রহমান ‘দলীয় প্রার্থী’ হিসেবে চেয়ারম্যান পদে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল মোতালেব তালুকদার এবং ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে উপজেলা আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক মো. ইউসুফ আলীকে ঘোষণা করেন । তার এই ঘোষণায় এলাকার নেতাকর্মীদের সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে। তার এই ঘোষণার পর যারা প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন তারা বিষয়টিকে কেন্দ্রের নির্দেশনা অমান্য হিসেবে দেখছেন। শুধু এসব এলাকায় নয়, প্রত্যেক উপজেলায় এমন ঘটনা ঘটছে। ঢাকার কেরানীগঞ্জে বর্তমান চেয়ারম্যান ও দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি শাহীন আহমেদ বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের সমর্থিত এবং কেরানীগঞ্জ মডেল থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আলতাফ হোসেন সাবেক খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলামের সমর্থিত প্রার্থী হিসেবে পরিচিত। অনেক জায়গায় আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যরা প্রকাশ্যে কোনো প্রার্থী ঘোষণা না করলেও ভেতরে ভেতরে নিজেদের পছন্দের ব্যক্তিদের সমর্থন দিচ্ছেন।
আওয়ামী লীগের তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মী বলছেন, উপজেলা নির্বাচনে সংসদ সদস্য, মন্ত্রী ও স্থানীয় নেতারা তাদের পছন্দের প্রার্থীদের জয় নিশ্চিত করতে দলীয় প্রার্থী হিসেবে পরিচয় দিচ্ছেন। কিন্তু নেতাকর্মীরা জানেন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দলীয় কোনো প্রার্থী নেই। এতে নেতাকর্মীরা পড়েছেন দ্বন্দ্বে। কার পক্ষে কাজ করবেন সেটি নিয়ে উভয় সংকটে রয়েছেন তারা। ঈদের পর পরিস্থিতি কি হয় সেটি নিয়েও আশঙ্কা প্রকাশ করে তারা বলছেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগের তৃণমূলে সৃষ্ট বিরোধ আরও বাড়ছে। সে সময় কোথাও কোথাও ক্ষমতাসীনদের এই বিরোধ সংঘাতে রূপ নেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রের কঠোর হস্তক্ষেপ চাইছেন তারা।
এদিকে উপজেলা নির্বাচনে তৃণমূল নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ করে সংঘাতবিহীন একটি সুন্দর ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন উপহার দিতে তৃণমূল নেতাদের ঢাকায় ডাকছেন কেন্দ্রীয় নেতারা। এরই মধ্যে গত ৩০ মার্চ রংপুর বিভাগের নেতাদের ঢাকায় ডেকে বৈঠক করেছেন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক দায়িত্বশীল নেতারা। সেখানে তৃণমূলের নেতারা পরিস্থিতি বর্ননা করে তাদের মতামত দিয়েছেন। তারা বলেছেন, উপজেলা নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত প্রকাশ্যে অংশ না নিলেও ব্যক্তিগতভাবে অংশ নেবেন স্থানীয় নেতারা। সেখানে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ বিভেদ আর অনেক প্রার্থী। এতে নির্বাচনে বিভিন্ন জায়গায় বিএনপি-জামায়াতের সুযোগ তৈরি হতে পারে বলে মনে করেন তারা।
আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিষয়টি নিয়ে দলের ব্যাপক পরিকল্পনা ও কৌশল রয়েছে। ধারাবাহিকভাবে সব বিভাগগুলো তৃণমূল নেতাদের নিয়ে বৈঠক করবে কেন্দ্র। আগামী ৪ এপ্রিল খুলনা বিভাগের জেলা নেতা ও সংসদ সদস্যদের সঙ্গে কেন্দ্রীয় নেতাদের বৈঠকের তারিখ ঠিক করা হয়েছে। ময়মনসিংহ বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী জানিয়েছেন, তার বিভাগের বৈঠক হবে ২২ এপ্রিল। ঢাকা, রাজশাহী ও সিলেট বিভাগের বৈঠকও ঈদের পর অনুষ্ঠিত হবে বলে জানা গেছে।
উপজেলা নির্বাচনে দলের বিভেদ ও কৌশল জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকা ৮ আসনের সাংসদ আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, উপজেলায় মাই ম্যান সৃষ্টির যে প্রবণতা, এটা তো সম্পুর্ণ অগণতান্ত্রিক। আওয়ামী লীগের মতো ঐতিহ্যবাহী দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে যারা আছে অথবা যারা জনপ্রতিনিধি হিসেবে এমপি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন, তাদের নেতাকর্মীদের সকলকে একই জায়গায় একই ছাতার নিচে রাখার প্রচেষ্টা চালানোই দায়িত্ব। সেক্ষেত্রে এই কাজগুলো করে যারা দলীয় ঐক্য নষ্টের চেষ্টা করবে বা ক্ষতিগ্রস্ত করার চেষ্টা করবে, তাদেরকে নেতিবাচকভাবেই দেখা হবে।
কেউ যাতে কোনো বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় থেকে বলয় সৃষ্টি করতে না পারে সেজন্য পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আরো কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হবে এবং কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে জানিয়ে আওয়ামী লীগের এই নেতা বলেন, ‘আমরা আশা করি, নেতাকর্মীরা একটি অবাধ, সুন্দর ও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন আয়োজনে সহযোগিতা করবে। যেখানে মানুষ তার পছন্দের প্রার্থীকে নিঃসংকোচভাবে ভোট দিয়ে শান্তিতে বাড়ি যাবে। এটা আমরা চাই।’
তিনি বলেন, ‘স্বাধীন নির্বাচন কমিশন কিন্তু হুমকি-ধমকি আর অগ্নিসন্ত্রাসের মতো ঘটনার পরও একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণভাবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ ভোট করেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই এটা সম্ভব হয়েছে। স্থানীয় সরকার নির্বাচন আরও ভালোভাবে হবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। এজন্য প্রতীক দেইনি। এতে জনপ্রিয় আর ভালো এবং জনগণের পছন্দের প্রার্থী নির্বাচিত হবে। প্রতীক না দেওয়ার সিদ্ধান্ত ছেলে ভাগিনা, শালা অথবা দুলাভাইকে নির্বাচিত করার জন্য, বলয় সৃষ্টি করার জন্য হয়নি। এসব করে যারা দলীয় ঐক্য বিনষ্ট করবে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’