সাক্ষাৎকার

‘পাঁচ বছরের মধ্যে বসুন্ধরা একাডেমির ফুটবলার দিয়ে দল গড়তে চাই’

‘করপোরেট ব্যক্তিত্ব’ পরিচয় ছাপিয়ে তিনি এখন দেশের সবচেয়ে আলোচিত ফুটবল সংগঠক। সাফল্যের বৃত্তে ঘুরতে থাকা ফুটবল ক্লাব বসুন্ধরা কিংসের প্রেসিডেন্ট ইমরুল হাসান নিজেকে শুধু ক্লাবে সীমাবদ্ধ  রাখেননি, বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের একজন শীর্ষ নীতি নির্ধারকও তিনি। বর্তমানে তিনি সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। সাফল্যের জোয়ারে ভেসে, ভক্তদের আনন্দে ভাসিয়ে এগিয়ে চলেছে  বসুন্ধরা কিংস। এই ক্লাবের গড়া দৃষ্টিনন্দন কিংস অ্যারেনা দেশের ফুটবলে নব জাগরণের প্রতীক হয়ে  থাকবে। ক্লাব ছুঁয়েছে শততম ম্যাচে খেলার মাইলফলক। সেই ম্যাচ খেলার দিনই ইমরুল হাসান রাইজিংবিডিকে শুনিয়েছেন ক্লাবের অতীত-ভবিষ্যতের গল্প। শুধু তাই নয়, দেশের ফুটবল নিয়েও নিজের মত ব্যক্ত করেছেন সাবলীলভাবে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাইফুল ইসলাম রিয়াদ।  

রাইজিংবিডি: শততম ম্যাচ খেলার মাইলফলক ছুঁয়েছে বসুন্ধরা কিংস। এ মুহূর্তে আপনার কোনো বড় লক্ষ্য আছে যেটি আপনি ক্লাবের জন্য অবশ্যই পূরণ করতে চান?

ইমরুল হাসান: অবশ্যই বড় একটা লক্ষ্য থাকতে হবে। যে লক্ষ্য নিয়ে আমরা ফুটবলে এসেছিলাম, ফুটবলে যারা দর্শক মাঠ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে তাদের মাঠে ফিরিয়ে আনা। আমার মনে হয় এই সময়ে কিছুটা হলেও সফল হতে পেরেছি। পাশাপাশি নিজেদের এশিয়ার আরও উপরে দেখতে পাব, এএফসিতে চেষ্টা করব যাতে আরও ভালো করতে পারি। আমাদের আরেকটা লক্ষ্য হচ্ছে- আগামী পাঁচ বছরের মধ্য  বয়সভিত্তিক দলকে যেন এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি। আগামীতে একাডেমি চালু করার ইচ্ছা আছে। একাডেমিতে বয়সভিত্তিক দল থাকবে। আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে আমরা যেন একাডেমি ও বয়সভিত্তিক দল থেকে বসুন্ধরা কিংসের দল গড়তে পারি। 

রাইজিংবিডি: শততম ম্যাচ বিশেষ কিছু ছিল আপনার কাছে?

ইমরুল হাসান: আসলে শততম ম্যাচ একটা সংখ্যা, যদি মাইলফলক বা কোনোকিছু বলেন এই সময়ের মধ্যে শততম ম্যাচ খেলে কী অর্জন করেছি সেটা বলতে পারেন। এর মধ্যে চারটা শিরোপা জিতেছি, পাশাপাশি এই সময়ের মধ্যে নিজস্ব মাঠ তৈরি করেছি। আমি বলব শততম ম্যাচের পাশাপাশি এগুলোও প্রাপ্তি আমাদের এই সময়ের জন্য।

রাইজিংবিডি: শুরু থেকে এখন পর্যন্ত সময়টা কেমন ছিল?

ইমরুল হাসান: জার্নিটা অবশ্যই কঠিন ছিল বলা যায়; অনেক প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়েছে। আভ্যন্তরীণ বাহ্যিক  বা বৈশ্বিক কিছুটা প্রতিবন্ধকতা ছিল। যেহেতু আমরা নতুন দল, কিছুটা চাপ তো ছিলই। আসলে শুধু পরিকল্পনা করলে হবে না, সেটা বাস্তবায়নের জন্য সঠিক জায়গায় সঠিক লোককে দায়িত্ব দিতে হবে। আমি মনে করি আমাদের সাফল্যের পেছনে খেলোয়াড়দের অবদান আছে। পাশাপাশি কোচিং স্টাফ যারা আছে সাপোর্ট স্টাফ যারা আছে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় কিন্তু আমরা এগিয়েছি। সঠিক জায়গায় সঠিক লোক বসাতে পেরেছি।

রাইজিংবিডি: দেশে ভালো করলেও এএফসি কাপের যা ফল এসেছে তাতে আপনি সন্তুষ্ট?

ইমরুল হাসান: আসলে আমাদের যে লক্ষ্য ছিল এএফসিতে ভালো করার, সে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারিনি। বাংলাদেশি ক্লাব হিসেবে লক্ষ্যমাত্রার কথা যদি বলেন আমাদের ফল যে খারাপ সেটা না। আমরা আমাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি। আগামীতে আমরা ভালো করতে পারব।

রাইজিংবিডি: বসুন্ধরা কিংস যেহেতু বিদেশি ক্লাবগুলোর সঙ্গে লড়েছে, দুই দেশের ক্লাবের মধ্যে পার্থক্য কোথায় ছিল?

ইমরুল হাসান: আসলে এএফসিতে আমরা চারবার খেলেছি, তার মধ্যে করোনার কারণে বাতিল হয়েছে একবার। আমি মনে করি কাঙ্ক্ষিত যে ফলটা পাইনি তার পেছনে রেফারির সিদ্ধান্তকে দায়ী করবো না, তবে আমাদের ফুটবলারদের অদূরদর্শিতার কারণে দুটো লাল কার্ড খেয়েছি। যে দুটো ম্যাচ আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল, সেই দুটো ম্যাচে লাল কার্ড খেয়ে আমরা দশজনের দলে পরিণত হয়েছি।

রাইজিংবিডি: দেশের ফুটবল পিছিয়ে আছে। তবুও আপনার সংগঠক হিসেবে আসার কারণ কী? 

ইমরুল হাসান: পিছিয়ে থাকা ফুটবলটাকে অগ্রসর করার জন্য মূলত আসা। আমরা যখন ফুটবলে আসি দুটো লক্ষ্যমাত্রা ছিল। একটি ছিল স্বল্প মেয়াদী আরেকটা দীর্ঘ মেয়াদী। স্বল্প মেয়াদি যেটা বললাম, দর্শক যেন মাঠে আসে। গত কয়েকবছর দেখেন আগের তুলনায় মাঠে দর্শক বৃদ্ধি পেয়েছে। এদিক দিয়ে আমরা সফল। আর দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা দেশের ফুটবলের অবকাঠামো। এটা আসলে দীর্ঘমেয়াদী কাজ। সেই লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি।

রাইজিংবিডি: ক্লাবের পেছনে প্রচুর অর্থ খরচ করা হয়, কতটা লাভজনক?

ইমরুল হাসান: বাংলাদেশের আর্থসামাজিক যে অবস্থা, ফুটবলের যে অবস্থা, শুধু ফুটবল না এখন, আমার মনে হয় ক্রিকেট থেকেও যারা সংগঠক আছে, বা কোনো ক্লাবের পক্ষে লাভের চিন্তা করা বাতুলতা। এ কারণেই বাংলাদেশের মার্কেট এখন বড় হয়নি। হয়তোবা ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে আনা সম্ভব কিছুটা। আমরা আসলে বসুন্ধরা গ্রুপ পুরোটাই সামাজিক দায়বদ্ধতার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে থাকি। পাশাপাশি ফুটবল থেকে হয়তো আমি আর্থিকভাবে লাভবান হই না, কিন্তু আমাদের যে ব্র্যান্ডিং হয় সেটা আর্থিক ক্ষতির চেয়েও বেশি কিছু।

রাইজিংবিডি: ক্রিকেটের অর্থনৈতিক কাঠামো শক্তিশালী, ফুটবল তার উলটোটা। ফুটবল কেন বাজার ধরতে পারছে না?   

ইমরুল হাসান: ক্রিকেটে বাংলাদেশ অনেক আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলে থাকে। কিন্তু আপনি যদি আমাদের লোকাল লিগের কথা চিন্তা করেন ক্রিকেটের চেয়ে ফুটবল অনেক এগিয়ে। ক্রিকেটে লোকাল লিগ কখন হচ্ছে কারা খেলছে অনেক মানুষ কেন, আপনারা সাংবাদিকরাও সেটা অনেকসময় বলতে পারবেন না। মাঠে গুটিকয়েক ক্লাবসংশ্লিষ্ট লোক ছাড়া দর্শকের উপস্থিতি নেই। ফুটবলে আমি মনে করি এদিক থেকে অনেক এগিয়ে আছে। বড় দলগুলোর খেলাতে ভালো দর্শক আসা শুরু করেছে। যেহেতু ক্রিকেট প্রচুর পরিমাণ আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলে থাকে সেখান থেকে রয়্যালটি পেয়ে থাকে ,তাই তহবিল অনেক স্থিত যেটা আমাদের ফুটবলের পক্ষে কঠিন। আর্থিক দিক থেকে ফুটবল দরিদ্র হলেও আমি মনে করি বাংলাদেশের ফুটবল অন্যান্য সব খেলা থেকে সবচেয়ে জনপ্রিয়। এটা আমাদের দুর্ভাগ্য জনপ্রিয় খেলাটাকে নগদায়ন করতে পারিনি। এ ক্ষেত্রে বাফুফের যেমন ব্যর্থতা আছে, আমরা যারা সংগঠক আছি, আমরা যারা ক্লাব চালাই, আমরা যারা জেলা লিগ চালাই, সবাই সমানভাবে দায়ী।

রাইজিংবিডি: দর্শকদের নিয়েও আপনারা কাজ করে থাকেন। এ ক্ষেত্রে আপনাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কী?

ইমরুল হাসান: দর্শকরা যে কোনো খেলার প্রাণ। আমরা ফুটবলে নতুন এসেছি, দেশে অনেক জনপ্রিয় ঐতিহ্যবাহী ক্লাব আছে। তাদের ভক্তদের দল সারাদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সে সমস্ত দলগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আপনি যত ভালো খেলাই খেলেন না কেন, নিজের দল ব্যাতিরেকে অন্য দলকে সমর্থন করে না। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল নতুন প্রজন্মকে ফুটবলমুখি করার জন্য, আবাহনী মোহামেডানের দর্শক হয়তো আমরা টানতে পারবো না। আমরা যদি নতুন প্রজন্মের দিকে হাত বাড়াই তাড়া ঝুঁকে পড়বে। এ জন্য আমরা দেশের বিভিন্ন জায়গাতে সমর্থক গোষ্ঠী গঠন করেছি, এখন যেটা মনে হয় বসুন্ধরা কিংস কোনো অংশে অ-জনপ্রিয় নয়। আরেকটা দিক হলো সারাদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সমর্থকগোষ্ঠীর  মাধ্যমে প্রতিভা খুঁজে আনা। তাদের দৃষ্টিতে স্থানীয় পর্যায়ে ভালো ভালো ফুটবল প্রতিভার সন্ধান থাকে, যেটা শহরে আমরা বসে থেকে পাই না। আমরা তাদের মাধ্যমে প্রতিভা তুলে আনছি। আমাদের মূল্য উদ্দেশ্য এটা। 

রাইজিংবিডি: গত বছর শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে দলের তারকা ফুটবলারদের শাস্তি দিয়েছেন। সিদ্ধান্তটা কতটা কঠিন ছিল? 

ইমরুল হাসান: এটা খুব কঠিন সিদ্ধান্ত ছিল আমাদের জন্য। কারণ আমরা যখন এই সিদ্ধান্ত নেই তখন আমাদের এএফসি কাপ চলছিল। আমাদের কি খেলোয়াড় ছিল ওরা। তবে আমরা আসলে চেয়েছিলাম সাময়িক অসুবিধা হলেও ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে শৃঙ্খলার সঙ্গে আপোষ না করতে। কারণ এটা একটা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে, যাতে ভবিষ্যতে কোনো খেলোয়াড় আর শৃঙ্খলা ভঙ্গ বা অনৈতিক কাজ করার সাহস না পায়।  সাময়িক ক্ষতি হলেও দীর্ঘমেয়াদি... শুধু আমাদের ক্লাবের জন্য নয়, বাংলাদেশের ফুটবলের জন্যও।

রাইজিংবিডি: আমাদের দেশে ‘গুরু পাপে লঘু দণ্ড’ দেওয়া হয় সচারচর। আপনারা এই পথ থেকে বেরিয়ে এসেছেন। 

ইমরুল হাসান: ওই যে বললাম না, ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেই এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। অবশ্যই আমাদের লস হয়েছে। জিকো আমাদের সেরা গোলরক্ষক, তপু আমাদের বেস্ট খেলোয়াড়, মোরসালিনও গুরুত্বপূর্ণ... এদের বাইরে রাখাটা খুব কঠিন ছিল। কিন্তু আমরা ভবিষ্যতের ফুটবলের কথা চিন্তা করেছি। 

রাইজিংবিডি: শাস্তির কবলে পড়া দেশসেরা গোলরক্ষক আনিসুর রহমান জিকো, যিনি কিংসের সাফল্যের অন্যতম সাক্ষী, জাতীয় দলে জায়গা হারিয়ে এখন হতাশায়। তাকে অনুপ্রেরণা দেবেন কিভাবে? 

ইমরুল হাসান: জিকো অবশ্যই বাংলাদেশের সেরা গোলরক্ষকদের একজন। কিন্তু একটা দুর্ঘটনার কারণে ও দল থেকে বাইরে ছিল। স্বাভাবিকভাবেই কেউ অনেকদিন বাইরে থাকলে কোনো কোচই তাকে প্রথম একাদশে সুযোগ দেবে না। জিকোর সামনে এখনও সুযোগ আছে নিজেকে প্রমাণের। আমরা চাই জিকো ফিরে আসুক, সেজন্য চাই সে লিগগুলোতে নিয়মিত খেলুক। লিগের পারফর্মেন্স দিয়েই সে একাদশে ফিরে আসতে পারবে।

রাইজিংবিডি: শেষ করতে চাই ‘কিংস অ্যারেনা’র তৈরির গল্প শুনে, যেটা নিয়ে বাফুফের সঙ্গেও আপনাদের মন কষাকষি ছিল।  

ইমরুল হাসান: শুরুতে যেটা বলেছি আমরা দুটি উদ্দেশ্যে ফুটবলে আসি। দীর্ঘমেয়াদি উদ্দেশ্য যেটা ছিল বাংলাদেশ ফুটবলের মান-উন্নয়ন করতে হবে। কিন্তু লিগের মান না বাড়ালে ফুটবলের মান, জাতীয় দলের মান বাড়বে না। লিগের মান বাড়াতে হলে ক্লাবগুলোকে অবকাঠামো উন্নয়ন অবশ্যই করতে হবে। আমরা সেটা চিন্তার করেই আমাদের নিজস্ব মাঠ, কমপ্লেক্স তৈরি করেছি। আরও যদি দুয়েকটা দল অবকাঠামো উন্নয়ন করে, আমি মনে করি, ধীরে ধীরে হারানো জনপ্রিয়তা ফিরে পাবে ফুটবল।